বাতাসে দেয়ালের ক্যালেন্ডারটা দোলক ঘড়ির পেন্ডুলামের মত দুলছে। ক্যালেন্ডারের নীচের অংশে আটকানো টিনের চিকন শলাকাটি দেয়ালের সাথে ঘষা খেয়ে কড়াত দিয়ে কাঠ কাটার ন্যায় ঘ্যাচর ঘাচর শব্দ করছে। অনেকটা সময় ধরে মিথিলা একমনে শব্দটা শুনে যাচ্ছে। অন্যসময় হলে এই মাঝরাতে কাঠ কাটার শব্দকে খুব ভৌতিক মনে হত, ভয়ে জমে গিয়ে হয়তো পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাঁথাটি দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে দিয়ে শক্ত কাঠ হয়ে শুয়ে থাকত। কোনমতেই মাথায় ঢুকতো না এই শব্দটা নিরীহ দেয়াল ক্যালেন্ডারের বাতাসে দুলুনি থেকে সৃষ্ট। কঠিন সময়ে হালকা টাইপের মানবিক অনুভূতিগুলো বোধহয় লোপ পায়।
আলো-আঁধারীতে আধো আধো ঘড়ির কাটাটা চোখে পড়ছে। রাত দুটা প্রায় বাজে, চোখে ঘুম আসছে না। বারবার হৃদয়ের চোরা পথে স্মৃতির লাভাগুলো উদ্বগিরিত হচ্ছে। বাবাকে ঘিরে থাকা সব স্মৃতিরা যেন হামলে পড়ছে, আর তারই সাথে চোখে বাণ ডেকেছে নোনা জলের। ঘড়ির টিকটিক শব্দে যেন আঘাত করে চলেছে হৃদয়ের গহীন তন্ত্রীতে।
বাবাকে নিয়ে কত স্মৃতি, কতশত গান কবিতা মিথিলার এই তেইশ বছরের জীবনে। ছোট্ট বেলায় মিথিলা ছিল বাবার খুবই ন্যাওটা, বাবাকে ঘিরে ছিল তার রাজ্যের আবদার-অধিকার। সকালে বাবা অফিসে যাওয়ার আগে মিথিলাকে কোলে নিয়ে মিষ্টি করে বলত, “মাগো, আমায় একটু ছুটি দাও, অফিস হতে ঘুরে আসি?” যেন মিথিলা যেতে না দিলে বাবা অফিসে যাবেন না। ছোট্ট মিথিলা মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করে বলত, “না, আজকে কোন ছুটি নেই। আজ অফিস যাওয়া বন্ধ”। আঁধার রাতের এই বিষণ্ণ ক্ষণে মনে মনে মিথিলা বলে উঠলো, “বাবা তোমার কথা মনে পড়ে...”, কার গান যেন এটি?
প্রাইমারীতে যখন বৃত্তি পেল মিথিলা, বাবা তাকে কোলে নিয়ে নাচা শুরু করেছিল। বাবার খুশী ছিল দেখার মত, ছোট্ট মিথিলা বুঝে উঠতে পারেনি সে কি করবে। বাবা তাকে নিয়ে রিকশায় করে সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছে, কত কিছু যে কিনে দিয়েছিলো তার ইয়াত্তা নেই। বাবা একই কাণ্ড করেছিল এসএসসি এবং এইচএসসি পাশের পরও। বাবা তার প্রতিটি আবদার পূরণে এতটুকু কার্পণ্য করেননি। মনে আছে যখন সে ক্লাস নাইনে পড়ে, মাথায় ভূত চাপলো মিনি সাইজ জ্যামিতি বক্স তার দরকার যার ভেতর থাকবে মিনি সাইজের পেন্সিল, কলম, ইরেজার, শার্পনার, রুলার ইত্যাদি। বাবাকে বলতেই কোথা হতে যে যোগাড় করতে আরম্ভ করলো কে জানে? এই এত্ততুকু ইরেজার, শার্পনার, রুলার এনে হাজির করল মিথিলা’র স্বপ্নের বক্সে। আজো মিথিলা তার ব্যাক্তিগত শোকেসে সাজিয়ে রেখেছে বক্সটি।
আকাশ একটু একটু করে ফর্সা হতে শুরু করেছে। গ্রীষ্মের এই সময়টায় রাত এম্নিতে ছোট হয়, কিন্তু আজ যেন রাত কত দীর্ঘ মনে হল। সারা রাত বাবা’র স্মৃতিরা বারে বারে হামলে পড়েছে মিথিলার চেতনা জুড়ে। বাবা, বাবার স্মৃতি সারা ঘর জুড়ে ছুটে বেড়িয়েছে, দুর্বল করেছে মিথিলার জগতটাকে। আজ এই রাত শেষের আলোতে কান্না ভেজা ফোলা ফোলা ঘোলা চোখে উদাস দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে মিথিলা।
একটু আলো ফুটতেই উঠে দাঁড়ালো, ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বাইরের বারান্দার দিকে। মিথিলা একটু অবাক হয়ে দেখলো ইজি চেয়ারে চোখ বুজে শুয়ে আছে তার বাবা, বুকের উপর একটা মলাট বাঁধা বই, তার উপর বাবার কালো চশমা। আলতোভাবে পা নেড়ে বাবা যেন জানান দিচ্ছে উনি জেগে আছেন।
“বাবা তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও, আমি কখনো তোমায় কষ্ট দেবো না আর...” বলে পেছন হতে ছোট্ট বেলার মত জড়িয়ে ধরলো বাবাকে।
গত কয়েকদিন যাবত নানান টানাপোড়নের মাঝ দিয়ে গেছে মিথিলার জীবন। মিথিলার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু রাশেদ; যার সাথে মিথিলার পরিচয়, বন্ধুত্ব হয়ে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে। রেজাল্ট হওয়ার পরে পারিবারিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় রাশেদ, বাসার সবাই সানন্দে রাজী হলেও বাবা রাজী হয় নাই। সব দিক দিয়ে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বাবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে রাশেদ। কিন্তু কেন? এই জেরা নিয়ে গত একমাস ধরে ঘরে অশান্তি চলেছে, যার শেষাংশ চিত্রায়িত হয়েছে কাল রাত্রে। মা-ভাইয়া’র সাথে বাবার কথা কাটাকাটি, মা’র জেদ ধরে ঘোষণা দেয়া রাশেদের সাথেই তিনি মেয়েকে বিয়ে দেবেন। শেষে বাবার সেই কড়া কথা, “মিথিলা, তুই সানন্দে রাশেদকে বিয়ে করতে পারিস। কিন্তু আমি সেই বিয়ে কখনো মেনে নেবো না। আমি না হয় ধরে নেব আমার মেয়েটি মারা গেছে। যেখানেই থাকুক সে ভালো থাকুক, সুখে থাকুক”। তারপর বাবা বারান্দায় চলে এসেছে, মিথিলা তার নিজের ঘরে।
সারারাত বাবার স্মৃতির সাথে, বাবার ভালবাসার বর্মের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়েছে মিথিলা-রাশেদের ভালবাসা।
“বাবা আমি তোমায় খুব ভালোবাসি যে...। তুমি কীভাবে ভাবলে তোমার মিথু তোমায় কষ্ট দিয়ে নিজের প্রাসাদ বানাবে। বাবা আমায় ক্ষমা করে দাও। আমি আমার জীবন থেকে, হৃদয় থেকে, স্মৃতি থেকে রাশেদকে মুছে দেবো...”
মিথিলার চোখ হতে গড়িয়ে পরা অশ্রু মিথিলার বাবার হাতে পড়তেই মিথিলাকে কাছে টেনে নিলেন মিথিলার বাবা। তার চোখ হতেও দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার পরিধেয় খদ্দেরের পাঞ্জাবীতে। এ অশ্রুর জলে শাণিত হল ভালবাসার নাড়ির বাঁধন।
(মিথিলার বাবার এই দৃঢ় অমতের ব্যাখ্যা মিথিলা কখনো পায় নাই। নিজেকে বুঝিয়েছে এই বলে যে, “বাবা-মা তার সন্তানের জন্য সেরাটাই চান, যা করেন তার ভালো’র জন্যই করেন”।)
==========================================
(গত ৩০শে ডিসেম্বর থেকে সামুতে ঢুকতে পারছি না। প্রায় সপ্তাহখানেক বিচ্ছিন্ন থাকার পর আজ পারলাম। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা ।)