শীতের এই শুরুর দিকে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠা এক যন্ত্রণা। সারা গায়ে কেমন এক শ্বৈত্যীক আলস্য। বিছানা ছেড়ে উঠতে মন চায় না। কোনমতে উঠে একবার পাখাটা বন্ধ করতে পারলেই কম্ম সাড়া। আমি শীত-গ্রীষ্ম কোন ঋতুতেই পাখা না ছেড়ে ঘুমাতে পারিনা। কালকে রাতে সামুতে কাল্পনিক_ভালবাসা’র স্টিকি পোস্ট “ক্ষমতার লড়াই কিংবা সহিংসতা নয় আমরা চাই মনুষ্যত্বের রাজনীতি” থেকে জেনেছি আজ শাহবাগে ‘সহিংসতা প্রতিরোধে জনতা’ স্লোগান নিয়ে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছে। তাই ঝটপট উঠে পরলাম, আজ তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে হবে। হাতে জমে থাকা কাজগুলো দ্রুত শেষ করে একটু আগে আগে অফিস থেকে বেড়িয়ে শাহবাগ চলে যাব। পা বাড়ালাম বাথরুমের দিকে।
বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি গত কয়েকদিনের মতই গাড়ি নেই, খেটে খাওয়া আমার মত মানুষগুলো দাঁড়িয়ে আছে; রিকশা নিয়ে ফার্মগেট চলে এলাম। গুলশানগামী ফাঁকা বাস পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম এবং কি সৌভাগ্য আমার, জানালার পাশে একটি সিটও পেয়ে গেলাম। কানে হেডফোন গুঁজে প্রতিদিনকার মত গান শুনছি, এমন সময় আমার পাশের যাত্রীর হাতের ধাক্কায় কান হতে হেডফোন খুলে তার দিকে তাকালাম। সে জানালা বন্ধ করতে বলছে, কেননা জানালা বন্ধ থাকলে কিছুটা সুরক্ষা হবে কোন ঢিল বা বোমা ছুড়ে মারলে! মনে মনে কষ্টের হাসি হাসলাম, তারপরও জানালাটা টেনে দিলাম। গত কয়েকদিনে জনমনে কি ভয়ানক অগ্নি ত্রাস ছড়িয়েছে! আমি নিজেও গত কয়েকদিনে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ভাবনার জগত এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রতিবাদের ভাষা কিছুই জানা নেই, শুধু ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে লেখনী দিয়ে ঝড় তোলার বৃথা চেষ্টা ছাড়া। মাঝে মাঝে ভাবি, একি শুধুই আমাদের গুটিকতেক লোকের নিষ্ফল হাহাকার নয়? যাদের তরে আমাদের এই প্রতিবাদ, আহবান; তারা কি কখনো এগুলো পড়ে দেখে?
অফিসে এসে ডেস্কে বসতে না বসতেই পাশের ডেস্কের জাকির ভাই জানালেন আমাদের আরেক সহকর্মী ইশতিয়াকের বাবা অবরোধে পিকেটারদের ধাওয়ায় গাড়ি উল্টিয়ে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। উনার একটি হাত কেটে ফেলতে হয়েছে, কপাল হতে ঘাড় পর্যন্ত অসংখ্য সেলাইয়ে জোড়া দিতে পেড়েছে বিদীর্ণ মস্তক। উহ! কি ভয়াবহ। এ কোন নরকে আজ আমরা বাস করছি। নিজের অজান্তে চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল, টিস্যু দিয়ে মুছে নিলাম। কেমন গা গুলাচ্ছে, পেটের ভেতরটা কেমন পাঁক দিয়ে উঠলো। চেয়ার ছেড়ে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালাম। কোনমত বেসিন পর্যন্ত পৌঁছলাম, নাড়িভুঁড়ি যেন উগড়ে চলে আসবে। সকালে তাড়াহুড়োয় নাস্তা করিনি, খালি পেট হতে পানি ছাড়া আর কিছুই বের হল না। চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে চেয়ারে এসে বসলাম। টেবিল ফ্যানটা ছেড়ে দিলাম, এসির বাতাসেও গরম লাগছে। পিয়ন কে ডেকে এক কাপ লিকার চা দিতে বললাম।
বেলা বারোটার উপর বেজে গেছে, কাজ তেমন কিছুই এগুচ্ছেনা। কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিনা। আজকের পত্রিকাটা তুলে নিলাম, কয়েকদিন পত্রিকা পড়া হয়না। প্রথম পাতায় ঢাকা কলেজের ছাত্র ওহিদুর রহমানের নিউজটা পড়ে আবারো চোখে জল এলো। কি নির্মম, কি নির্মম! পাঁচ দিন অবর্ণনীয় যাতনা ভোগ করে আজ লাইফ সাপোর্টে চলে গেলো ছেলেটি। ওহিদুরের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে শরীরটা কেঁপে উঠলো। বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সামন্ত লালের কথাটি কানে বাজতে লাগল বারেবারে...... “ছেলেটাতো আমার সন্তানের বয়সী। কলেজ পড়ুয়া একটা ছেলের কি অবস্থা হয়ে গেল! তার অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি আগে বলতাম, কেউ যেন এসিডদগ্ধ না হয়। এসিডদগ্ধ কাউকে যেন আমাদের চিকিৎসা দিতে না হয়। এখন বলছি, সহিংসতার আগুনে কাউকে যেন পোড়ানো না হয়।”
লাঞ্চ শেষে বস ডেকে পাঠালো, কাল মান্থলি মিটিং, আজ সব কাজ শেষ করে যেন বাড়িতে যাই। কি আর করার? কর্পোরেট কামলা হওয়ার জ্বালাতো সইতেই হবে। কোনমতে নিজেকে সামলে কাজ করতে লাগলাম। সন্ধ্যা নাগাদ কাজ শেষ করে অফিস থেকে বের হলাম। বাস স্ট্যান্ডে কোন বাস নেই। বাসের জন্য অপেক্ষা করার ফাকে মোবাইলে সামুতে ঢুঁকে কাল্পনিক_ভালবাসা’র স্টিকি পোস্টে দেখি জানা আপু কমেন্টে আজকের প্রতিবাদ সমাবেশের আপডেট দিয়েছে। কেমন বিষাদ ছেয়ে গেল মনে; নিজে সেখানে থেকে প্রতিবাদ করতে না পারায়। এরই মাঝে একটা বাস পেলাম সরাসরি আজিমপুর যাবে। উঠে পড়লাম।
সব মানুষের চোখেমুখে আতঙ্ক। এই জ্বালাও পোড়াও কোথায় গিয়ে থামবে তা নিয়ে কয়েকজন আলোচনা শুরু করে দিল বাসের ভেতর। সকাল থেকে এত মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেলাম যে এদের এই আলোচনা এখন অসহ্য লাগছে। পকেট হতে হেডফোন বের করে কানে দিলাম। একের পর এক গান পাল্টাতে পাল্টাতে কোন ভাবনার জগতে তলিয়ে গেলাম জানিনা। মাঝপথে সিট খালি পেয়ে বসে পড়লাম জানালার পাশে। জানালা দিয়ে ছুটে চলা রাজপথের দিকে চেয়ে চেয়ে ইশতিয়াকের বাবার কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করলাম সাথে চোখে তীব্র আলো। সারা শরীরে জ্বলুনি, তীব্র জ্বলুনি। কেউ যেন আমায় আগুনের সাগরে ছেড়ে দিয়েছে। অনেক মানুষের চিৎকার শুনতে শুনতে আমি আগুনের মাঝে ডুবে যাচ্ছি।
এখন আমার চারিপাশে অনেক মানুষের মিছিল। ঐতো মা’কে দেখা যাচ্ছে।
"মা আমার সারা শরীরে এত জ্বালা কেন? মা আমার কথা কি শুনছো? আমি ঠোঁট নাড়াতে পারছিনা, কিন্তু তুমি বুঝতে পাড়ছোতো মা? আমার ভেতরটা এত শুঁকিয়ে আছে কেন? একটু পানি খেতে পারতাম যদি।"
"আরে বাবা তুমিতো কিছু কর! আমার চামড়া কে যেন টেনেটেনে তুলে নিচ্ছে। উহ কি যন্ত্রণা! মাগো আর পারি না।"
"সামন্ত লাল, আপনি কিছু করেন, আমি আর সইতে পারছি না।"
"মা! তুমি এসব কি বলছো? আমি মরবো কেন? আমার কত কাজ যে বাকি আছে। কাল অফিসে মান্থলি প্রেজেন্টেশন, পরশু রাতে বান্দরবান ট্যুরের মিটিং রফিকের বাসায়, রুবি...আমার রুবিরায় আমার ফোন বন্ধ পেয়ে কত অস্থির হচ্ছে। সামুতে আমার জমিদার বাড়ী সিরিজের লেখার কি হবে? আমি যে আমার ব্লগার বন্ধুদের “জীবন থেকে নেয়া একগুচ্ছ প্রেরণার গল্প” শোনাবো। আহ, কি ভীষণ জ্বালা। আহঃ..."
(ঘটনার প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক)