'হিমেল শৈশবে বয়সে বড় কাউকে দেখলেই ভাবতো, আহা এমন যদি হতো। ভাবতো বাবার মতো বড় কবে হবে! মায়ের মতো বড় হলে তার গায়েও কি এমন মিষ্টি গন্ধ হবে! এখন বুঝতে পারে শৈশবে কতটা বোকা ছিলো সে। হিমেলের গ্রামের কথা, স্কুলের কথা, মায়ের কথা মনে হলেই দুঃখবোধ হয়। হাসিও পায়। তখন কি ভেবেছে বড় হলে ওর বুকটা ভারী হয়ে যাবে, কাঁধটা শক্ত হয়ে যাবে এমন। মায়ের একটা নতুন শাড়ির জন্য তীক্ষ্ণ ব্যথা হবে মনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর হিমেল ভেবেছে জীবনের একটা অবস্থানে এসে এইবার পৌঁছেছে সে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো। এই সৌভাগ্যের অহংকার তাকে গোপন রাখতে হয়েছে সচেতন ভাবে৷ বাবার খুশি দেখে মনে হয়েছে হিমেল একটা নীলকুরিঞ্জি ফুলের গাছ। প্রথম এই গাছে ফুল ফুটেছে।
সেদিন হিমেলের বিছানায়, তুলে রাখা লাল চাদরটা পেতে দিয়েছিলো মা। বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া এই চাদর সবসময় তোলা থাকে আলমারিতে। জবাফুলের পাতা আঁকা পুরো চাদরটাতে। বয়স যখন ছিলো মাকে খুব জ্বালাতো হিমেল। অবুঝ ছিলো। যেদিন হিমেল বুঝতে শুরু করলো মা যেনো ইশ্বর। সেদিন থেকে ইশ্বরের কৃপা হলে পবিত্র লাগে। ইশ্বর তুষ্ট হলে আনন্দ হয়। সন্ধ্যার আজানের পর জবা পাতার উপর হাত পা মেলে শুয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলো হিমেল স্বস্তিতে।
হিমেলের বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। বাবা বলেন তাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। কলেজে উঠে হিমেল প্রথম বুঝতে পারলো মধ্যবিত্ত শব্দটা একটা ফাঁকি। বাবার নিজেকে দেয়া সান্ত্বনা। ওরা দরিদ্র। হিমেলের জমে থাকা একটা ক্ষোভ রয়েছে বাবার প্রতি। বাবা চাইতেন হিমেল ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে৷ হিমেল নিয়ে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত নাম, যশ, প্রতিপত্তি যা তিনি নিজে ছুঁতে পারেননি অলসতায়। পরিচিত অপরিচিতদের মুখে ছেলের গৌরব শুনার আনন্দ নিয়ে বাবা প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে চাইতেন। এই মিথ্যে সুখের আশায় হিমেলের জিদ হতো। নিজের ভার অন্যের পিঠে চাপিয়ে দেয়া দুর্বল মানুষটার চোখ যখন স্বপ্ন জ্বলজ্বল করতো, বাবাকে লোভী মনে হতো হিমেলের। এই অন্যায় স্বপ্ন না পুরনের জিদ হিমলকে সুখী করতো। ভুলে যেতো নিজের জীবনের কথা। এখন মনে হয়, বাবা যদি সত্যিই পারতেন তাকে অমন বড় করতে, বাবা সুখী হতেন। কি দোষ হতো তাতে! সে নিজেও সুখী হতো। এখন কি সে সুখী? হিমেল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার সুখ মিষ্টি কুমড়া গাছের মতো সহজে গজিয়ে উঠছে যত্রতত্র। অজস্র সুখ।
মায়ের প্রতি হিমেলের কোনো ক্ষোভ নেই। মা মানুষটা সরল রেখার মতো। মায়ের জন্য মমতা আছে। করুনা আছে খানিকটা। মায়ের কোনো বন্ধু নেই। মায়েদের আসলে বন্ধু থাকে না। বাবাদের বন্ধুদের জন্য মায়েদের সম্মান থাকে। মায়েদের সেই গল্প বলার সাথী, যারা হারিয়ে গেলো নকশীকাঁথার মাঠে তাদের জন্য বাবাদের কোনো দুঃখ থাকে না। মায়ের কোনো সখের কথা হিমেল কখনো শোনেনি। ছোটবেলা থকে জেনে এসেছে সখ মূলত বাবারই থাকে। হিমেলের বড় মানুষ হওয়া, শত্রুদের নাকানিচুবানি দেয়ার মতো ক্ষমতাবান হওয়া হিমেলের, মেয়েদের ভালো পরিবারে বিয়ে, বৈকাল হৃদে ঘুরতে যাওয়া। বৈকাল হৃদ বাবা কিভাবে চিনেছে? বাবারা মূলত সম্ভ্রান্ত সৌখিনতায়।'
'ব্যবচ্ছেদ'এর টুকরো অংশ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১:৪৯