তোমার মনে পড়ে আমার ওমন লাল টুকটুকে পুতুলটার বিয়ে ঠিক করলে দুগ্গাদির কালো ছেলের সাথে। ওমন নাক বোঁচা পুতুল নিয়ে সে কেমন নাক উঁচু করে ছিলো, যে বিয়েতে একমুঠো বাতাসাও আনলো নাকো। তারপর তোমাকে যতবার বলেছি চলো টুকির সংসারটা দেখে আসি, তোমার সেকি আপত্তি! বাপের বাড়ির লোকদের মেয়ের সংসার দেখতে চাওয়াই নাকি বিপত্তির কারণ! প্রতিবার যে আমার সংসারের খোঁজ চাইছো, তুমি কি মেয়ের বাড়ির লোক নও নাকি ধরেই নিয়েছো বিপত্তির বালাই আমার নেই।
প্রিয় নীরুবালা,
আমি মেয়ের বাড়ির লোক নই রে নীরু, আমি মেয়ে। গ্রামের মুখ্যসুখ্য মেয়ে। যার নিজের কোনো ঘর নেই, মানুষ নেই, সুখ নেই, অসুখ নেই, সংগ্রাম নেই। বিয়ের আসর থেকে পালালি, সেদিন আমি তোর সাহস দেখে চমকে উঠলুম। পাড়ার মানুষ গুলো অই এক জিনিস নিয়েই ত বাঁচে, মান সম্মান। মিথ্যে কে মিথ্যে বলে তুই নিজের সত্যের দিকে ছুটলি। দূর দূর দেশে এমন হয় শুনেছি, কিন্তু আমার পাশের বাড়ির নীরুবালা, আমার খেলার সাথী নীরুবালা, আমার চেনা নীরুবালা নিজের ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলো। কই পাড়ার অন্য কোনো মেয়ে ত পারলো না! আমি ত পারলাম না!
যাওয়ার আগে তুই যে বলে গেলি, আকাশ ছুঁতে যাচ্ছিস, হ্যা রে নীরু তোর হাতের মুঠোয় থাকে যে আকাশ সে আকাশের রং কেমন? সকাল বেলার সুন্দর নরম আকাশটা দেখলেই মনে হয় এটাই তোর আকাশ৷ আমার আলো হয়ে থাকা নীরুবালা রাতের অন্ধকার আকাশ নিয়ে জীবন পার করে দিতে পারে না। সে ত আমার মতো কাঁদা-মাটি-জল নয়।
শোন তুই যদি টুকটুকে টুকি, বোঁচা নাক, কালো ছেলেই বলেই ভাববি, তোর জীবন নিয়ে এইযে এত সংগ্রাম সেসব গঙ্গায় ফেলে দিতে পারিস নে?
প্রিয় টগর,
গঙ্গা বুঝি আমার পাশের বাড়ির মাসি? টুকির গায়ের রং যে কারণে টুকটুকে হতে হয়, সে কারণেই ওর বরের কালো রংটা আমার কাছে কালোই। বোঁচা নাকটা বোঁচাই। আমাকে তুমি বর্ণবাদী বলতে পারো। আমি এক চোখা নই। সংগ্রামীও নই। যদি কোনো সংগ্রাম আমার আদৌ থাকতো তবে ফেলেই দিতেম, জানো।
তুমি কি বলো? টুকির বিয়েতে দুগ্গাদি যে ডালিম ফুলের মালা পণ চাইলো, সে জানতো না চৌধুরী বাড়ি থেকে ডালিম ফুল আনা সহজ কাজ নয়? অথচ এটা সহজ কাজ নয় বলেই ওর নাক বোঁচা ছেলেকে নিয়ে সবার অহংকার হলো। আমিও নিজের মানসম্মান বাড়াতে আমার রাঙা মেয়েটার সমন্ধ করলাম ও বাড়িতে। কত ঝক্কি ঝামেলা সয়ে নিয়ে এলাম ডালিম ফুল। তুমি বানালে ডালিম ফুলের মালা। ওরা কোনো সৌজন্যের বালাই না দেখিয়ে টুকিকে নিয়ে চলে গেলো। পাড়ার মেয়েদের সাথে আমরা গর্ব করে বলতে লাগলুম দুগ্গাদির ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, হুহ! হোক না পুতুল খেলা এসব ত মানসম্মানের বড়াই'ই ছিলো। মিথ্যে কে মিথ্যে বলতে আমি পারিনি। আমি যে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছিলাম সেটা আমার মত করে বেঁচে থাকার জন্য ছিলো, সংগ্রামের জন্য নয়। কেউ যদি একে সংগ্রাম বলে সেটা মিথ্যে বলে।
প্রিয় নীরুবালা,
কাল নরেণ কাকুর সাথে দেখা। কথায় কথায় তোর কথা বলল। তোর একলা থাকার কথা, তোর সংসার ভাঙার কথা, চাকরি করার কথা। শেষে বলল, 'ছি! ছি! ওকি মেয়ে মানুষ! নরকেও জায়গা হবে না।' মেয়ে মানুষই থেকে যাওয়া আমার তোকে খুব হিংসে হয়। এত কথা বললি, কই আমায় এইসব ত কিছু বললি নে? তুই চলে যাওয়ার পর মাধবীর বাবা মাধবীকে ওর পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো, সুরঞ্জনাকে ওর বাবা ভর্তি করেছিলো কলেজে। এমন ঘটনা আমাদের পাড়ায় সেবারই প্রথম। একে আর যে যাই বলুক আমি সংগ্রামই বলবো।
#চিঠিপত্র
শুরু থেকে শুরু হয়নি বলে শেষে গিয়ে শেষ হলো না। হলো মাঝামাঝির মাঝখান। হিবিজিবি।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৪:২৫