জাপানের এক গ্রামে এক তরুন সন্যাসী বাস করতেন। তিনি খুবই বিখ্যাত ছিলেন এবং তার প্রচুর খ্যাতি ছিল। তাঁর সম্মানে সারা গ্রামে গান গাওয়া হত। কিন্তু একদিন সব কিছু বদলে গেল। সেই গ্রামের এক কুমারী মেয়ে গর্ভবতী হল এবং একটি শিশুর জন্ম দিল। যখন তার পরিবারের লোকজন তাকে প্রশ্ন করল এই শিশুটি কার,তখন সে বলল এই শিশুটি সেই তরুন সন্যাসীর।
গুনমুগ্ধ থেকে শত্রু হতে কতটুকু সময় লাগে? কতটুকু সময়? এর জন্য এক মূহুর্ত সময়ও লাগে না,কারণ প্রতিটি গুনমুগ্ধের মাঝে একজন নিন্দাকারী লুকিয়ে থাকে। মন শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে,এবং যেদিন থেকে মুগ্ধতা শেষ হয় সেদিন থেকে তার নিন্দা শুরু হয়।
যে মানুষেরা আজ শ্রদ্ধা করছে তা এক মিনিটেই অশ্রদ্ধায় পরিণত হতে পারে। যে ব্যক্তি আজ কারো পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে এক মূহুর্তেই সে তার মাথা কাটার জন্য প্রস্তুত হতে পারে। শ্রদ্ধা এবং অশ্রদ্ধার মাঝে কোন পার্থক্য নেই-এ দু’টি একই মুদ্রার দু’টি দিক।
সে গ্রামের সব মানুষ ঐ সাধুর কুড়ে ঘর আক্রমন করে জ্বালিয়ে দিল। দীর্ঘদিন তারা শ্রদ্ধা করে এসেছে কিন্তু এতোদিনে তাদের অবদমিত ক্ষোভ বেরিয়ে এসেছে। এখন তাদের অশ্রদ্ধা করার সুযোগ এসেছে, সূতরাং তারা সবাই সাধুর কুড়ে ঘরে আগুন লাগাতে ছুটে এসেছে। এবং সেই পুঁচকে শিশুটাকেও তারা সাধুর পানে ছুড়ে মারতে দ্বিধা করল না।
সাধু প্রশ্ন করলেন, “ ব্যাপার কি?”
লোকজন চিৎকার করে বলল, “তুমি আমাদের প্রশ্ন করছ ব্যাপার কি? এই শিশুটি তোমার। এই জ্বলন্ত ঘরের দিকে চাও,তোমার হৃদয়ের দিকে চাও,এই শিশুটি আর এর মায়ের দিকে চাও। তোমাকে আর আমাদের বলতে হবে না যে এই শিশুটি তোমার।”
সাধু বললেন, “তাই নাকি? এই শিশুটি আমার?”
শিশুটি কান্না জুড়ে দিলে সাধু গান গেয়ে তাকে থামাতে চেষ্টা করল,এবং গ্রামবাসী ঐ শিশুটি সহ তাকে সেই পোড়া ঘরের পাশে রেখে চলে গেল। তারপর তিনি যথাসময়ে ভিক্ষা করতে গেলেন,বিকেল হয়েছে-কিন্তু কে তাঁকে খাবার দেবে আজ? আজ তিনি যে দরজায় দাড়ালেন সেটিই সজোরে বন্ধ হয়ে গেল। তাঁর পিছু পিছু একদল ছেলেবুড়ো বিদ্রুপ করে চলল,পাথর ছুড়ে মারল।
শেষ পর্যন্ত শিশুটি যে মেয়েটির ছিল তিনি সেই দরজায় এসে বললেন, “আমাকে না হয় খাবার নাই দিলেন,কিন্তু এই শিশুটির জন্য তো একটু দুধ দিন ! আমার দোষ থাকতে পারে কিন্তু এই অবলা শিশুটির কি দোষ?”
শিশুটি কাঁদছিল-চারপাশে লোকজনের ভিড়। এবং এই অবস্থা শিশুটির মায়ের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল। সে তার বাবার পায়ে পড়ে বলল, “আমাকে ক্ষমা করুন,আমি ঐ সাধুর নামে মিথ্যে বলেছি। আমি শিশুটির প্রকৃত বাবাকে বাঁচাতে এই সাধুর নাম নিয়েছি। তাঁর সাথে আমার কোন পরিচয়ও নেই।”
মেয়েটির বাবা হতচকিত হয়ে গেলেন-এতো মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে। তিনি দৌড়ে বাইরে এসে সাধুর পায়ে পড়লেন এবং শিশুটিকে তাঁর কাছে থেকে নিতে চাইলেন।
সাধু প্রশ্ন করলেন, “ব্যাপার কি?”
মেয়েটির বাবা বললেন, “আমাকে ক্ষমা করুণ,বড় ভুল হয়ে গেছে। এই শিশুটি আপনার নয়।”
সাধু উত্তর দিলেন, “তাই নাকি? সত্যি শিশুটি আমার নয়?”
ঐ গ্রামের লোকজন সাধুকে বলে, “ আপনি একটা পাগল!সকালেই কেন আপনি এটা অস্বীকার করলেন না?”
সাধু বললেন, “তাতে কি পার্থক্য হত? এই শিশুটি নিশ্চয় কারো হবে।
এবং ইতোমধ্যে আপনারা একটা ঘর জ্বালিয়েছেন-এখন আর একটা ঘর জ্বালাতে হবে।আপনারা একজন কে অপদস্থ করা উপভোগ করেছেন এখন আর একজনকে অপদস্থ করা উপভোগ করবেন।তাতে কি পার্থক্য হবে?
শিশুটি নিশ্চয় কারো না কারো হবে-আমারও হতে পারত। সুতরাং সমস্যা কি?”
তারা বলে, “ আপনি কি বুঝতে পারছেন না,সবাই আপনাকে দোষারোপ করছে,অপদস্থ করছে,অবমাননা করছে?”
সাধু বলেন, “আমি যদি আপনাদের নিন্দায় উদ্বিগ্ন হতাম তবে আপনাদের শ্রদ্ধা নিয়েও আমাকে উদ্বিগ্ন হতে হয়। আমি যা ঠিক মনে করি তা করেছি,আপনাদের যা ঠিক মনে হয়েছে করেছেন।
গতকাল পর্যন্ত আমাকে শ্রদ্ধা করা ঠিক মনে হয়েছিল, সূতরাং আপনারা তাই করেছেন। আজ আপনাদের মনে হচ্ছে আমাকে শ্রদ্ধা করা ঠিক নয়,করছেন না।কিন্তু আমি আপনাদের শ্রদ্ধা বা অশ্রদ্ধা নিয়ে উদ্বিগ্ন নই।”
তারা বলে, “ওহে মহামান্য সাধু,আপনার খ্যাতি নষ্ট হচ্ছে সে বিষয়টি অন্তত বিবেচনা করতে হত।”
সাধু উত্তর দিলেন, “আমি ভালও নই মন্দও নই। আমি কেবল আমি। আমি ভাল এবং মন্দের এই চিন্তা ছেড়েছি। আমি ভাল হবার সকল চিন্তা ছেড়েছি কারণ আমি যত ভাল হতে চেষ্টা করেছিলাম দেখেছি তত মন্দ হয়েছি। আমি যতই মন্দত্ব থেকে মুক্তি পেতে চাইছিলাম ভালত্ব ততই আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল,সূতরাং আমি এই সব চিন্তা ছেড়েছি।
আমি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হয়েছি। এবং যেদিন নিরপেক্ষ হয়েছি সেদিন বুঝেছি আমার মাঝে ভালত্ব বা মন্দত্ব কিছুই নেই। পরিবর্তে আমার মাঝে নতুন কিছুর জন্ম হয়েছে যা মন্দত্ব এবং ভালত্বের তুলনায় ভাল এবং তার মাঝে মন্দত্বের কোন ছায়াও নেই।”
dc: এটা আমার লেখা না, হাতে পেলাম, তাই ছড়িয়ে দিলাম।