কয়েকদিন আগে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর আসন্ন বলিঊড অভিষেক নিয়ে লিখেছিলাম।যাই হোক গত দশ জানুয়ারী আওরঙ্গজেব বা বাদশা আলমগীর এর বলিউড অভিষেক হয়ে গেল তানহাজি দ্যা আন্সাং ওয়ারিয়র মুভির মাদ্ধ্যমে।নেট ঘেটে মুভির হল প্রিন্ট ভার্ষন ও দেখে ফেললাম।এই মুভির জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম শুধু সাইফ আলি খান কে দেখার জন্য পতৌদির এই নবাবের পুর্বপুরুষ মুঘল+ব্রিটিশ আমল থেকেই মারাঠাদের পেটাচ্ছে।পর্দায় নিজের পুর্বপুরুষদের ভুমিকা তিনি কিভাবে পালন করেন সেটা দেখার আগ্রহ ছিলো,বাকি ঘটনা তো অনুমিতই ছিল।
প্রথমেই বলি মুভিটা কেমন লাগলো দুই ঘন্টা সাত মিনিটের মুভিটা অনেক গোছান ছিলো,ইনফ্যাক্ট সাম্প্রতিক সময়ে তুমুল আলোচিত ব্যাবসাসফল এবং প্রশংসিত পদ্মাবত মুভির চেয়েও এই মুভিটাকে বেশি গোছানো মনে হয়েছে অর্থাৎ কম সময়ে তারা অনেক বড় একটা গল্প বলতে পেরেছে। অধিকাংশ ফাইটসিন ও যথেষ্ট রিয়েলিস্টিক মনে হয়েছে।তবে যাচ্ছেতাই ভিএফেক্স গুলো সহজেই চোখে ধরা পড়বে বিশেষ করে ঘোড়া গুলো,বিভিন্ন গেমসে ব্যাবহার করা ঘোড়ার চেয়েও নিম্ন মানের।
মারাঠাদের নিয়ে বলার তেমন কিছু নেই বাংলায় মারাঠা শব্দটাই ডাকাতের সমার্থক,তবে ধর্ম নিয়ে এই মুভিতে এত বেশি নাড়াচাড়া করা হয়েছে যে এটা শেষ পর্্যান্ত আর পিরিয়ড ড্রামা থাকে নি একটা প্রোপাগান্ডা মুভি হয়ে গেছে,মুভিতে দেখা যায় শিবাজি এর মা কে পুজা করতে বাধা দিয়ে দুর্গ থেকে বের করে দেয়া হয়।শিবাজি মহারাষ্ট্রের কালচারাল আইডেন্টিটির একটা বিশাল অংশ তার মায়ের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে এতবড় সঙ্ঘাত তো অবশ্যই একটা উষ্কানি,তার উপর মুভিতে আবার দাবি করা হয়েছে শিবাজি নাকি ব্রাম্মনদের পৈতার রক্ষক।মুঘল সেনাপতি উদয় ভান রাঠোরকেও মিশ্র জাতি ধর্মের লোক হিসেবে দেখিয়েছে।হাতি হিন্দুধর্মানুযায়ি খুবই পবিত্র প্রানী মুঘল সম্রাটরাও হাতি ভালোবাসতেন।আকবর প্রায় পাচ হাজার হাতি পুষতেন,পুরো সম্রাজ্যে হাতি হত্যা নিষিদ্ধ ছিলো এই আইন ভাংলে মৃত্যুদণ্ড হত সেনাবাহীনিতে হাতির সংখ্যাছিল বিশহাজার এর কাছাকাছি(তুজুক ই জাহাঙ্গীর)শাহজাহান গরীব ও ছোটজাতের লোকদের হাতিতে চড়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দেন(প্রভাতাংশু মাইতি,ভাঃইঃপঃ)অথচ এই মুভিতে দেখা যায় আলমগীর এর নির্দেশে উদয়ভান শুড় কেটে হাতি হত্যা করছেন।
(মির্জা জয়সিং এর কাছে আত্নসমর্পন করছেন শিবাজি)
মুঘল রাজপুত সম্পর্ক ভারতের ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।মুঘল সম্রাটরা রাজপুতদের বিশবস্ততা নিয়ে কোন সন্দেহ করতেন না আকবর,জাহাঙ্গির,শাহজাহান এমনকি আওরংজেব এর ব্যাক্তিগত রক্ষীদল এ রাজপুত সৈন্যদের সংখ্যাধিক্য সেটাই প্রমান করে।শাহজাহান এবং আওরংজেব এর প্রধান সেনাপতি ছিলেন মির্জা জয়সিং,সম্রাট শাহজাহান এর মায়ের দিক থেকে যিনি আত্নীয় হতেন,এবং সম্রাট শাহজাহান তাকে মির্জা উপাধি দেন যা একমাত্র তৈমুর আর তার বংশধরদের জন্য সংরক্ষিত ছিলো।এই মির্জা জয়সিং ই শিবাজিকে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত করলে সে সন্ধির জন্য রাজি হয়।এই মুভিতে শিবাজি আওরঙ্গজেব এর সাথে সন্ধি করছে এমনটা দেখালেও জয়সিং প্রায় অনুপস্থিত।বরং জয়সিং এর অভিযানকে হিন্দুর বিরুদ্ধে হিন্দুকে ঊষ্কে দেওয়ার মুসলিম ষড়যন্ত্র বলে দাবি করা হয়েছে।মুঘল আমলের অস্ত্র শস্ত্র ও ঠিকভাবে দেখানো হয় নাই।মুভিতে নাগিন নামের এক বিশাল কামান দেখা যায়,যেটা টানতে দুটো হাতির দরকার হয়।বাদশা হুমায়ূন এর অজগর নামের এরকম বিশাল একটা কামান থাকলেও আওরঙ্গজেব এর আমলে হাল্কা কামান বানানোর চল ছিলো সম্রাট আওরঙ্গজেব এমনকি পিতল দিয়েও হাল্কা কামান বানাতেন।আর যে কামান দুটো হাতি মিলে টানতে হয় সেই কামান মারাঠা অজয় দেভগন একহাতে ঠেলে দুর্গের উপর থেকে ফেলে দিল?সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে খোদ সম্রাট আওরঙ্গজেব এর চরিত্রটা এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্যাক্রেড গেমস খ্যাত অভিনেতা লুক কেনি,যিনি একজন এংলো ইন্ডিয়ান অর্থাৎ সম্রাট কে বিদেশী বানানোর কোন চেষ্টা বাদ রাখা হয় নি।কিন্তু সত্যি হচ্ছে সম্রাট এর দাদি(সম্রাট শাহজাহান এর মা) এবং পরদাদি(সম্রাট জাহাঙ্গীর এর মা) ছিলেন রাজপুত হিন্দু।সম্রাটের স্ত্রী এবং ভবিষ্যত সম্রাট বাহাদুর শাহ-১ এর মা, নবাব বাই ও ছিলেন হিন্দু।আবার সম্রাটকে অনেকটা বিদেশি একসেন্টে হিন্দি বলতে শোনা যায়।অথচ সারাজীবন বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র কাটানো আলমগীর পুর্ববর্তী সম্রাটদের তুলনায় ভালো হিন্দী বলতে ও বুঝতে পারতেন।মুভির একদম শেষে বলতে শোনা যায় আলমগীর নাকি দক্ষিন জয় করার চিন্তা বাদ দেন,অথচ সম্রাট,শিবাজীর নিজের রাজ্যসহ প্রায় পুরো দক্ষিন ভারত জয় করেছিলেন,সেই আফগানিস্থানের কাবুল/বালখ থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পর্্যতন্ত বিস্তৃত আলমগীরের সাম্রাজ্যের মোট আয়তন ছিলো চল্লিশলক্ষ স্কয়ার কিলোমিটার ভারতে মৌর্্যর সম্রাজ্য ছাড়া এতবড় সম্রাজ্য আর একটাও নেই।
আওরঙ্গজেব এবং মুঘলরা অনেকদিন থেকেই বিজেপি/ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর আক্রমনের লক্ষবস্তু,কিন্তু ইংরেজদের ব্যাপারে একদম নিশ্চুপ এর কারনও স্পষ্ট আওরঙ্গজেব বা মুঘলদের ভিলেন বানানো গেলে সাম্প্রদায়িক রাজনিতীর একটা ভিত্তি পাওয়া যায় ইংরেজদের ক্ষেত্রে যেটা সম্ভব না
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১০:২৫