মানুষ হিসেবে জন্ম নেবার সব থেকে বড় সুবিধা বোধহয় পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা। অতি অতি বৈরী পরিবেশেও মানুষ স্বপ্ন দেখে, ভালবাসে, গুন গুন করে গেয়ে উঠতে পারে প্রিয় কোন গান। আমারও তেমনটা হচ্ছিল, একটু একটু করে বাস্তবতা মেনে নিচ্ছিলাম। দেখতে দেখতে প্রথম মিডটার্ম পরীক্ষার সময় এসে পড়ল। প্রথম সেমেস্টারে ৪টা কোর্স নিয়েছিলাম, এক রিসার্চ ফিলসফি ছাড়া আর বাকি সব সেভেন হান্ড্রেড লেভেলের ম্যাথম্যাটিকস, স্ট্যাটিস্টিক্স সম্পর্কিত কোর্স। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানিজ্য অনুষদের সিলেবাস অনুযায়ী এইসব কোর্সের প্রি-রিকুইজিট কোর্সগুলো আমার করা, কিন্তু আমিতো জানি আমি কি পড়েছি আর আমাকে কি পড়ানো হয়েছে। আমাদের পড়াশোনা আর পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষত আমেরিকার পড়াশোনার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এই তফাৎটুকুর বোঝা কেমন ভারি সে ভার যে নিয়েছে সে-ই জানে। হুমায়ূন আহমেদ ও একই সমস্যায় পড়ে ছিলেন বলে আমি এর নাম দিয়েছি হুমায়ূন সিনড্রোম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে হাত খরচ চালানোর জন্য বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষত ইউরোপের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী ছাত্রদের (যারা পড়াশোনা কম, কাজ বেশি করত) বিভিন্ন assignment আর term project করতাম। সেই সুবাধে স্ট্যাটিস্টিক্সে আমার বেশ ভালোই দখল ছিল, তাই ইকোনমেট্রিক্সে কোন সমস্যাই হয়নি। বাকি থাকল কেবল অ্যাপলায়েড রিস্ক আনাল্যিসিস আর এডভ্যান্সড মাইক্রো-ইকনমিক্স। প্রথমটা কেবল সিমুলেশন সফটওয়ার দিয়ে ডাটা আনাল্যিসিসের কাজ, মাইক্রোসফট অফিসে পারদর্শিতার কারনে এটিও তেমন আহামরি সমস্যা আমার জন্য ছিল না। সমস্যা শুধু এডভ্যান্সড মাইক্রো-ইকনমিক্স নিয়ে। দেশে থাকতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যতসামান্য ইকনমিক্স পড়েছি তার জ্ঞান দিয়ে কোর্স ইন্সট্রাক্টর ডঃ রবার্ট হার্ন ওরফে ববকে খুশি করা গেল না।
মূল গল্পে যাবার আগে বব সম্পর্কে একটু বলি। ববকে এক কথায় বর্ণনা করার মত একটা শব্দই বাংলাতে আমার জানা, তা হল- আজিব। গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টদের থিসিস ডিফেন্স থেকে শুরু করে এক্সপার্ট সেমিনার, প্রশ্ন করার সু্যোগ আছে এমন সব অনুষ্ঠানের বব নিয়মিত শ্রোতা। প্রেজেন্টেশান শেষে যে মানুষটা সর্ব প্রথম প্রশ্ন করার জন্য হাত তুলবে, সে বব। ববের প্রশ্ন করার ধরন অনন্য। দু আঙুল দিয়ে বিস্কিটের গুড়ো নিয়ে তা মুখে দিতে দিতে বব যখন well you said... বলে প্রশ্ন করা শুরু করে, তখন তার মুখের যে ভাব তার সরল বঙ্গনুবাদ হল- আইজ তরে পাইছি। প্রশ্ন শুনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বক্তার অবস্থা হয় ভিক্ষা চাইনা মা কুত্তা সামলা টাইপ।
ঝাড়া ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা, কামানো মাথার বব তখন আমার যম, রাতে ঘুমাতে গেলও ব্যাটাকে স্বপ্নে দেখি। কিঞ্চিৎ আওলা মাথার বব ক্লাসে ঢুকেই ঝড়ের গতিতে যখন ইউটিলিটি মাক্সিমাইজেশন, অপটিমাইজেশন, কনকেভ, কোয়াসি-কনকেভ ফাংশান আরো হাবিজাবি জটিল সব ইকোনমিক থিওরি অংক কষে প্রমানের চেষ্টা করে আমি তখন হতবিহ্বল হয়ে বসে থাকি, আর একটু পর পর আমাকে জিজ্ঞেস করে মোহাম্মদ বোঝা যাচ্ছে? আমি তখন যক্ষা রোগীর মত খুক খুক করে কেশে মাথা নাড়ি। আমার মাথা নাড়ানো দেখে ববও তার চকচকে মাথাটা একটা ঝাকি দেয়। ববের এই এক্সপ্রেশনের একটাই অর্থ তখন আমার কাছে- পোলা ধরা খাইছে। আক্ষরিক অর্থেই আমার তখন ফাঁদে পড়া ইঁদুরের দশা, এই কোর্সে সি পেলেই আমার ইকনমিক্সে পিএইচডি'র স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। ক্লাসমেটদের করুনা দৃষ্টি আর কোর্স ইন্সট্রাক্টরের তোমাকে দিয়ে হবে না জাতীয় মনোভাব আমাকে তখন ভেতর থেকেই শেষ করে দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে আমিও বোধহয় ধরে নিতাম আমাকে দিয়ে হবে না, যদি না এক রাতে আমার মাকে স্বপ্নে দেখতাম।
আমেরিকা আসার যখন সব ঠিকঠাক, তখন আমার মাকে প্রায়ই ফোনে বিভিন্ন জনকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে শুনতাম “রনি আমেরিকা যারগোই, অ্যাঁর ফুয়া ডাকতর অইবু” (রনি আমেরিকা চলে যাচ্ছে, আমার ছেলে ডাক্তার হবে)। আমার নিরক্ষর মা জানতেন না পিএইচডি আর এমবিবিএস ডিগ্রির পার্থক্য, শুধু জানতেন ছেলে “ডাক্তার” হবার জন্য সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিতে যাচ্ছে। স্বপ্নে মাকে বলতে শুনলাম অ্যাঁর ফুয়া ডাকতর অইবু। জানিনা এই স্বপ্ন নাকি অপমানের ভয় কোনটার তেজ বেশি ছিল, পরদিন লাইব্রেরি থেকে একগাদা বই নিয়ে ঢুকলাম নিজের অফিস রুমে। মিডটার্মের দশদিন আগে, আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর আর দীর্ঘ পড়াটা শুরু করলাম। এই দশদিন রাতের চার ঘণ্টা ঘুম ছাড়া আর বাকি সময়টা শুধু পড়া নিয়েই ছিলাম। পরীক্ষার দিন সকালে বব যখন প্রশ্নপত্র দিতে দিতে আমাকে বলল Good luck মোহাম্মদ, তখন আমি মৃদু হেসে ববকে উত্তর দিয়েছিলাম you too. আমার হাসি বব আমাকে ফেরত দিল দুদিন পর, আমার উত্তরপত্র হাতে দেবার সময়, খুলে দেখি একশতে পেয়েছি চুরানব্বই। পরক্ষণেই দেখি নয় আর চার সংখ্যা দুটো কেমন ঝাপসা লাগছে। আমার চোখে কি তখন নোনতা বাণ ডেকেছিল? ঠোটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে কাঁদা যায় নাকি... নাহ্ আমার চশমার কাঁচেই বোধহয় সমস্যা ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ৮:৪৫