ছোট্ট বেলায় কি হতে চাইতাম? মাঝে মাঝে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই। স্পষ্ট কোন জবাব পাইনা। অর্থনীতিবিদ অন্তত নয়। অতদূরের সালতামামি করছি কেন, ২০০৬ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে ক্লাস শুরু করেছি, তখন ও জানতাম না কি হতে চাই জীবনে। ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে যখন ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকলাম তখন নিশ্চিত জানতাম, আর যাই হোক ব্যাংকার হতে চাই না।
মধ্যবিত্তের সাধ আর সাধ্যের আজীবন টানাপোড়েন যখন একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে, তখন ভাবলাম, এবার তবে অন্য কিছু করি, এমন কিছু যার জন্য জীবনের সায়াহ্নে আমাকে আহারে বলতে হবে না। পড়াশোনা আমার বরাবরই প্রিয়, সে নিরস একাডেমিক বই হোক আর সরেস সাহিত্য হোক। প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ বলে বিশ্ববিদ্যালয়ও বেছে নিলাম, নর্থ ডেকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি। চলে এলাম আমেরিকা (যত সহজে বলছি তত সহজে নয় ব্যাপারটা, বৃত্তি নিয়ে পড়তে গেলে যতটা হ্যাপা পোহাতে হয় তার সবটুকুই সয়েছি)। আর গল্পের শুরু এখানেই...
খুব বেশি বন্ধু আমার কখনোই ছিলনা। দেশে বরাবর একা একাই থেকেছি। সবসময় ভেবেছি আরে আমিতো ২০০৬ থেকে ঘরের বাইরে, একা থাকা আমার জন্য কি কোন সমস্যা? তখন বুঝিনি নিজ ভূমে কেউ আসলে সত্যিকারের একা নয়। আমি টের পাইনি কি গভীর মমতা দিয়ে দেশের আলো, বাতাস, মাটি আর চারপাশের পরিচিত অপরিচিত সমস্ত মানুষ আমাকে ঘিরে রেখেছিল। আমেরিকা এসে সত্যিকারের একা হলাম।
যেদিন হেক্টর এয়ারপোর্টে নামলাম, সেদিনের হাহাকারের সাথে কোন শূন্যতার তুলনা চলে না। এখনও মাঝে মাঝে মনে হয় কেন এলাম এখানে? কি আছে এ বিরানভূমে? তখন রীতিমতো ক্লাস শুরু হয়েছে, চার বছর বিরতির পর একাডেমিক পড়াশোনা শুরু করেছি, দেশে পড়েছি মার্কেটিং, ছিলাম ব্যাংকার, আর এখন পড়ছি ইকোনমিকস। কিছুর সাথেই কিছুর মিল পাইনা। ক্লাসে যাই আর আসি, প্রফেসর গটগট করে হোয়াইট বোর্ডে জটিল জটিল সব অংক কষেন আর আমি হা করে থাকি, প্রশ্ন করলে মাথা চুলকাই, কিংবা আবোল তাবোল উত্তর দিই। পড়া পারিনা, চারিদিকের ভয়াবহ শূন্যতা, মা-বাবাকে মিস করা, আজীবন অন্তর্মুখী এই আমার বন্ধু না বানাতে পারার ব্যর্থতা, সব মিলিয়ে যাকে বলে “বেড়াছেড়া” অবস্থা তখন আমার। সমাধান বের করলাম এই রোগের, আর তা হল হাঁটা, প্লেইন অ্যান্ড সিমপল হন্টন। সপ্তাহে চারদিন দুটো করে ক্লাস, যেহেতু পড়ালেখা করছি না তাই হাতে অখণ্ড অবসর, ক্লাস শেষ করে এক এক দিন অনেক দূর পর্যন্ত হাটতে হাটতে চলে যাই, ক্লান্ত হয়ে গেলে পা ছড়িয়ে বসে পড়ি রাস্তার পাশে, আর কাঁদি। একদিনের গল্প বলি। রাত তখন নয়টা সাড়ে নয়টা হবে, বসে আছি ডাউন টাউন বাস টার্মিনালে, লোক সংখ্যা সাকল্যে ৩-৪ জন। খেয়াল করিনি কখন এক মেয়ে এসে আমার পাশে বসেছে। হাই বলতে পাশ ফিরে দেখি, গাঢ় করে লিপস্টিক দেয়া, আঁটসাঁট কাপড় পরা এক স্বর্ণকেশী। মৃদু হেসে হাই বলতেই, সে নিচু স্বরে বলে উঠল তুমি কি আমার জন্য একটা ড্রিঙ্ক কিনতে পার? ক্যালকুলাস, ম্যাট্রিক্স আলজেব্রা না বুঝলেও, এইটা বুঝলাম, স্বর্ণকেশী কি চায়। আমি বললাম, ড্রিঙ্কস কিনতে পারব না, কিন্তু তোমাকে একটা কবিতা শোনাতে পারব। তোমার জন্যই আমাদের এক বিখ্যাত কবি লিখে গিয়েছেন। মেয়ে খুব অবাক হয়ে বলল আমার জন্য কবিতা? আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম- তবু কি তোর ইচ্ছে করে আলগা খোলা শ্যামবাজারে/ সবার হাতে ঘুরতে ঘুরতে বিন্দু বিন্দু জীবনযাপন?*
স্বর্ণকেশী জিজ্ঞেস করল এর অর্থ কি? জানিনা কেমন দুঃখ তখন আমাকে ছুয়ে গিয়েছিল, বাসে উঠতে উঠতে শুধু তীব্র বিষণ্ণ গলায় বললাম, আমি জানি না আমেরিকা...
** কবি- শঙ্খ ঘোষ, কবিতা- ফুলবাজার
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৮:০৭