আপনি যদি আশাবাদী মানুষ হয়ে থাকেন তাহলে ভালো করে শুনুন। আর যদি হয়ে থাকেন চরম হতাশ মানুষ, যদি মনে করেন আপনার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না, যদি মনে হয় আপনার পাশে কেউ নেই, এমনকি যদি আত্মহত্যাও করতে চান তাহলে গল্পটা শুনতেই হবে। না গল্প কেন বলছি কেন এ তো এক চরম সত্য ঘটনা। আপনি শুনুন আপনার কান্না পাবে, আপনি আবার আশায় বুক বাঁধবেন। যাকে নিয়ে এই গল্প সেই মানুষটি চলতি মে মাসেই প্রথম আলোর সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছে। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে গল্পটা শুরু করছি। আর গল্পের বর্ননার সুবিধার্থে আমি চরিত্রটা আমার।
২০০৯ সালের কোন একদিন। রাত আটটার মতো হবে। প্রথম আলো অফিসে আমি। কাজ করতে করতে গ্রাফিকস রুমে গেছি। বিশাল বাংলা পাতার মেকআপ করছে সহ-সম্পাদক বাকি বিল্লাহ। একটা নিউজে চোখ আটকে গেলো। নিউজটা হলো একটি ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে কিন্তু ভর্তির টাকা নেই, তাকে সাহায্য করতে হবে। যশোরের অভয়নগর প্রতিনিধি মাসুদ আলম ভাই নিউজটা করেছে। আমি বাকি ভাইকে বললাম এই নিউজ ফেলে দেন। এটা দেয়া লাগবে না। বাকি ভাই হতাশকণ্ঠে বললো কেন? আমি বললাম একটা ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ১০-১৫ হাজার টাকা লাগে। এজন্য নিউজ করার দরকার নাই। আপনি ফেলেন। সমস্যার সমাধান হবে। আমি ফোন দিলাম মাসুদ ভাইকে।
আমি বললাম এই নিউজ করার মানে কি? মাসুদ ভাই জানে আমি তাকে কেন ফোন দিয়েছি। আর সে কারণেই মাসুদ ভাই আমাকে ছেলেটির গল্প শোনালো।
ছেলেটি জানে না তার কোথায় জন্ম। কে তার বাবা মা। যশোরের একটি খ্রিষ্টান এতিমখানায় বড় হয়েছে ছেলেটি। ছোটবেলা থেকেই তার লেখাপড়ার ভয়ঙ্কও আগ্রহ। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেলো। এরপর এইটে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই একটু আলো পেলেই বই নিয়ে বসে পড়ে। নিজের বই নিয়ে এর ওর কাছ থেকে ধার করে। তার মেধা থেকে স্থানীয় এক হিন্দু শিক্ষক ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশন করার সময় নিজে ছেলেটির বাবা হলেন। তার স্ত্রীর নাম দিলেন ছেলেটির মা হিসেবে। এসএসসিতে ছেলেটি অসাধারন রেজাল্ট করতো। এরপর উচ্চমাধ্যমিকেও। ছেলেটির ইচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়বে। কিন্তু ওই শিক্ষক চান তা ছেলেটি যশোরেই থাকবে এবং তার ছেলেমেয়েকে পড়াবে। তারই বাসায় থাকবে। মাসুদ ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পেরে বন্ধুসভার ছেলেরা টাকা তুলে ছেলেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ফরম তুলেছে, যাওয়া আসার ভাড়া দিয়ে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। টাকা নেই। দেখার কেউ নেই।
মাসুদ ভাইয়ের গল্প শুনে আমি অনেকক্ষন কাঁদলাম। আমরা যারা সমাজের সুবিধাভোগী কতো ভাবে কতো জায়গায় টাকা খরচ করি। কতো কারণে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ি। আর একটি ছেলে যে জানে না তার বাবা মা কে, যে একা এই পৃথিবীতে অথচ সংগ্রাম করার কি ভয়ঙ্কও ক্ষমতা। আমি মাসুদ ভাইকে বললাম আপনি ছেলেটার ভাইভার আগে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েন।
এরকিছুদিন পর যশোর থেকে ঢাকায় এলো ছেলেটা। আমায় ফোন দিলো অন্য একজনের নম্বর থেকে। আমি তাকে আসতে বললাম সম্ভবত কলাভবনের সামনে। ছেলেটি এলো। ছেলেটি বললো তার সিরিয়াল একদম শুরুর দিকে। আইন, অর্থনীতসিহ আরো অনেক বিষয় পাবে। আমি ছেলেটাকে দেখলাম ভালো করে। না চেহারার বর্ণণাও দিতে চাই না ছেলেটির। আমি তাকে বললাম শোনো তুমি আইন বা অর্থনীতি পড়ে আগাতে পারবে না। তোমার জন্য কঠিন হবে।
ছেলেটা আমাকে স্যার স্যার করছিলো। আমি দিলাম ধমক। বললাম তুমি আর কয়দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হবে। সবসময় মাথা উচু করে চলবে। আর আমাকে ভাই বলো। খুব সস্তায় একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিলাম সম্ভবত আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য। আমি তাকে বললাম আইন বা অর্থনীতি নয় তুমি সাংবাদিকতায় ভর্তি হও। আমি এই কারণেই বলেছিলাম যে আমার মাথায় ছিলো সাংবাদিকতায় ভর্তি হলে ছয় মাস পরেই তাকে একটা চাকুরি দিতে পারবো। মাসুদ ভাইয়ের সাথে কথা হলো। মাসুদ ভাইও আমার সঙ্গে একমত হলো।
এরপর ছেলেটিকে ভর্তি করলাম সাংবাদিকতা বিভাগে। ভর্তি কমপ্লিট কোন ঝামেলা ছাড়াই। তবে ছেলেটির যে হলে অ্যাটাসড হলো সেই হলে সিট পাওয়া কঠিন। আমি তাকে রাজনৈতিকভাবে হলে উঠাতে চাইনি। তাই সেদিনই তাকে নিয়ে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আরেফিন স্যারের কাছে। আরেফিন স্যারের সাথে অনেকদিন ধরেই ঘনিষ্ঠতা। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক থাকার কারণে যে কোন সংকটে স্যারের কাছে যেতাম। স্যারকে সব বললাম। বললাম স্যার আজ থেকেই ওকে হলে রাখতে চাই। আপনি প্রভোষ্টকে বলে দেন। স্যার আমার সামনেই প্রভোষ্টকে ফোন করে বললেন একটা ছেলেকে সিট দিতে হবে। তবে প্রভোষ্টকে ছেলেটি সম্পর্কে জানাতে আমি ভিসি স্যারকে না করলাম। আমি চাইনি ছেলেটির জীবনের কথা সবাই জানুক। ভিসি স্যারকে বললাম স্যার এই ছেলেটিকে আমাদের দেখে রাখতে হবে।
প্রভোষ্ট জানালেন সিট দিতে একটু সময় লাগবে। আমি ওই হলে থাকা আমার এক বন্ধুর রুমে পাঠালাম ছেলেটিকে। বললাম তোর রুমে রাখবি। দেখবি কোন সমস্যা যেন না হয়। ছেলেটিকে ভর্তি করানোর পর আমি আমার অফিসের এক কলিগকে বললাম ছেলেটি সম্পর্কে। তিনি ছেলেটির ঢাকা থেকে যশোরে যাওয়া আসার বাস ভাড়া ফ্রি করে দিলেন এবং এক জায়গায় ছেলেটির একটা চাকুরির ব্যাবস্থা করে দিলেন। আমি এরপর আস্তে আস্তে যোগযোগ কমালাম ছেলেটির কাছ থেকে। চাইলাম ছেলেটা যেন স্বাবলম্বী হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে।
তবে নানাভাবে আমি খোঁজ নেই, ঠিকমতো লেখাপড়া করে কিনা, কি কি করে। আমাকে তারা জানায় ছেলেটার রেজাল্ট খুব ভালো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্ষ্ট ক্লাস পেয়ে যাবে। তবে কিছু সমস্যার কথাও জানায়। তবে আশার কথাই বেশি। ছেলেটা আমাকে হঠাৎ হঠাৎ ফোন দেয়। এরমধ্যেই প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ পেরোয়। ছেলেটি কাজ নেয় একটি সংবাদমাধ্যমে। আস্তে আস্তে ছেলেটা স্বাবলম্বী হয়। অনার্স শেষ হয়। রেজাল্ট বেশ ভালো তবে আমি যতোটা আশা করেছিলাম ততোটা নয়, তবুও বেশ ভালো। আমি যখুনি ছেলেটার ভালো কোন খবর শুনি আমার ভালো লাগে।
অনার্স শেষ করে ছেলেটি শুরু করে চাকুরির পরীক্ষা। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা পরীক্ষায় ছেলেটা প্রথম চারজনের মধ্যে চলে আসে। বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকেও লিখিত পরীক্ষায় চান্স পায়। ছেলেটা ইংরেজিতে অনেক ভালো। এর মধ্যেই মাসখানেক আগে আমার কাছে আসে ছেলেটা। জানায় যেখানে কাজ করছে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আমি বলি প্রথম আলোয় চলে আসো। ছেলেটা একটা সিভি পাঠায়। আমি সেদিনই দিয়ে দেই আমাদের জুয়েল ভাইকে। কয়েকদিন পর যারা সিভি দিয়েছিলো সবার পরীক্ষা হয়। জুয়েল ভাই আমাকে জানায় ছেলেটার পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। আমরা ওকে নেবো। আমি আনন্দের হাসি।
এর মধ্যেই গতকাল আমি যখন নারায়নগঞ্জে ছেলেটা আমাকে মোবাইলে জানায় প্রথম আলো সম্পাদক মতি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে বের হলো। গতকালই প্রথম আলোয় যোগ দিয়েছে। আমি আনন্দের হাসি হাসি। আমি জানি এই ছেলে অনেক ভালো করবে। আজকে হয়তো ৩০ হাজার টাকার বেতন পাচ্ছে একদিন তিন লাখ বেতন পাবে। একদিন প্রতষ্ঠিত হবে এই সমাজে। গুম আর অপহরণের শহর নারায়নগঞ্জে বসে, দেশ জাতি নিয়ে নানা হতাশা আর আতঙ্কের মধ্যেও আমি সেসব স্বপ্ন দেখি। আমার মনটা ভরে যায় অদ্ভুত ভালোলাগায়। আর এভাবেই আমি আমি নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। সেই বাংলাদেশ সংগ্রামের। সেই বাংলাদেশ সাফল্যের। সেই বাংলাদেশকে কেউ পিছিয়ে রাখতে হবে। যে দেশে এমন সংগ্রামি ছেলেরা আছে সেই দেশকে ঠেকিয়ে রাখে কে?
Anisul Hoque ভাই একটা গল্প লিখবেন নাকি ছেলেটাকে নিয়ে?কেন জানি আমার আবারো কান্না পাচ্ছে। তবে ই কান্না আনন্দের। এই কান্না ভালোলাগার। এই কান্না সেই ছেলেটির জন্য। এই কান্না সংগ্রামি সব মানুষের জন্য।