সাংবাদিক হিসেবে জীবনে আর কি শিখেছি জানি না তবে আমি প্রায় প্রতিদিনই জীবনের নতুন নতুন সংজ্ঞা শিখি। প্রতিটা দিনই আমার কাছে নতুন মনে হয়। এই যেমন আজকের দিনটা। কি অদ্ধুত একটা দিনই না গেলো। সারাদিন কোন অ্যাসাইনমেন্ট ছিলো না। তাই সকাল থেকে ঘুমিয়ে কাটালাম। বিকেলে অফিস যাবো এমন সময় চীফ রিপোর্টার পিন্টু ভাইয়ের ফোন অফিসে আসতে হবে না, সাভার চলে যান। ইতিমধেই আমি টেলিভিশনের কল্যানে জেনে গেছি রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনা। পিন্টু ভাই বললেন সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাকে নেয়া হয়েছে। সেখানে যেতে হবে। মুহুর্তের মধ্যেই মোটরসাইকেল ঘুরালাম। গন্তব্য সাভার, সিএমএইচ। কিন্তু ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধার হওয়া রেশমার খবর জানার সন্ধানে গিয়ে আমিই আরেকটু হলে নিউজ হয়ে গিয়েছিলাম।
ঘটনাস্থল গাবতলী। আমি মোটরসাইকেল সতর্ক থেকে যতোটা সম্ভব দ্রুত চালাচ্ছি। হুট করে দেখলাম প্রচণ্ড গতিতে একটা ট্রাক আসছে উল্টো দিক থেকে। আমি আমার দিক থেকে চলছি। হুট করে কোথা থেকে দেখলাম এক লোক ওই ট্রাকের সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে আমার মোটরসাইকেলের সামনে পড়তে যাচ্ছে। অবস্থা এমন যে ওই লোকটার উপর দিয়ে আমাকে মোটরসাইকেল চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বোকার মতো আমি হাত-পায়ের সব ব্রেক একসঙ্গে চেপে মোটরসাইকেল থামানোর সর্বান্ত চেষ্টা করলাম। ফলাফল লোকটির কাছাকাছি এসে আমি থামতে পারলেও রাস্তার বালিতে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারালাম। ছিটকে পড়লাম অনেকটা দূরে। এরপর দেখি লোকজন এসে আমাকে উদ্ধার করছে। আমার দুই হাত পায়ে ছিলে রক্তাত্ব চামড়া উঠে আসছে। দৌড়ে আসা লোকটা তখনো হা করে চেয়ে আছে। আমি কিছু বলার আগেই দেখি পাবলিক পারলে তারে মারে। পাবলিকরে শান্ত করলাম। মোটরসাইকেলটা উঠালাম। সামনের দুটো মিররই খুলে গেছে। আমি মোটামুটি আহত। মনে মনে ভাবছি চীফ রিপোর্টারকে ফোন করে ঢাকায় ফিরে আসবো কিনা। না সেই ইচ্ছেটা হলো না। মনে হলো রেশমার সাক্ষাত জরুরী।
অতপর ওই অবস্থায় আবারো মোটরসাইকেল স্টার্ট। সাভার পৌছে মোটরসাইকেলটা ঠিক করালাম। হাসপাতালে ঢুকে নিজের ড্রেসিং করলাম। এরপর রেশমার খোঁজে যাওয়া। তখন আরেক বিস্ময়। সাভার সিএমএইচে যখন প্রচণ্ড কড়াকড়ি তখন এক কর্ণেল আমাকে বলছেন শরিফুল ভাই এখানে! প্রথমে চিনতে পারিনি। এরপর তিনি পরিচয় দিলেন। খুব মজা পেলাম। দূতাবাসে থাকা অবস্থায় কতোবার এই মানুষটার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে। যাই হোক তার অনেক সহযোগিতা পেলাম। সহযোগিতা পেলাম সিএমএইচ-এর একজন ডাক্তারের। তিনি মেজর। তিনি রেশমার সবকিছু জানালেন। সামরিক কর্মকতারা জানালেন, রেশমার সঙ্গে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী মোবাইলে কথা বলেন। এরপর রেশমা নাকি বলে সে প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে চায়। এ কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী নিজেই চলে আসেন। শুনে খুব ভালো লাগে। যাই হোক একে একে রেশমার মা, ভাই, বোন, হাসপাতালের ডাক্তার সবার সঙ্গে একে একে কথা বলা। কিছু ছবি নেয়া। সবার একটাই কথা, এমন বেঁচে থাকা অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য, অলৌকিক। একটি বিষয়-সিএমইচে থাকাকালে সবার সাথে কথা বললেও রেশমার সাথে আমার সরাসরি কোন কথা হয়নি। আমি সেই চেষ্টাও করিনি। আমার যা জানার আমি ডাক্তারদের মাধ্যমেই জেনেছি কারণ আমি ওতো বড় সাংবাদিক নই।
রেশমাকে উদ্ধার করেছেন আর্মি ইঞ্জিয়ারিং কোরেরর দুই মেজর মোয়া্জ্জেম ও দেলোয়ার। মেজর দেলোয়ার যখন রেশমাকে উদ্ধারের ঘটনা বলছিলেন তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিলো কোন সিনেমার গল্প শুনছি। রেশমার খাই জাহিদুল বলছিলেন, তারা আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। লাশের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু তার মা জোবেদা নাকি একটা কথাই বলে আসছিলেন মেয়েকে না নিয়ে তিনি বাড়িতে ফিরবেন না। মনে পড়ে সবাই মিলে চেষ্টা করেও শাহিনাকে বাঁচানো যায়নি। আর কারো সাহায্য ছাড়াই নিজে নিজে বেঁচে আছে রেশমা। তাকে উদ্ধারেও খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। সবার এতো আবেগ আনন্দ দেখে কখনো কান্না পাচ্ছিলো, কখনো আনন্দ। পৃথিবীর আর কোন দেশে কি মানুষের জন্য মানুষের এতো আবেগ আছে! জানি না।
কাজ শেষ করে ঢাকায় যখন ফিরছি তখন রাত ১২ টা। এতোক্ষন কাজের চাপে শরীরের ব্যাথাগুলো টের পাইনি। কিন্তু এবার টের পেতে শুরু করলাম। রাস্তায় শত শত গাড়ি। নিশ্চিন্তে মোটরসাইকেল চালাচ্ছি। ধর্ম-কর্ম না করা এই আমি এতোদিনে একটা কথা বুঝে গেছি উপরওয়ালা যাকে বাঁচাতে চান তাকে নিজ হাতে বাঁচান। আর যাকে মারতে চান তাকে আমরা সবাই মিলে চাইলেও বাঁচাতে পারি না। রেশমা তেমনই একটা উদাহরণ। কাজেই জয় হোক রেশমার। জয় হোক মানবতার। জয় হোক বাংলাদেশের।