সাংবাদিকতা কি আর দশটা পেশার মতো কেবলই একটি পেশা; নাকি নেশা?
এই প্রশ্নটা সবসময় আমি নিজেকে করি, করি অন্য সাংবাদিকদেরও। অনেকেই অনেক কথা বলেন। তবে আমার ব্যাক্তিগত অভিমত হলো, সাংবাদিকতা যতোটা না পেশা তার চেয়ে অনেক বেশি নেশা, ভালোলাগা। এই নেশাটা হচ্ছে দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার নেশা। আমার মনে হয়, একজন চিকিৎসক যেভাবে মানুষের সেবা করতে পারেন তার চেয়ে অনেক বেশি সেবা করতে পারেন একজন সাংবাদিক। কোন সাংবাদিকের এই নেশা কেটে গেলে তিনি তখন যতোটা না সাংবাদিক থাকেন তার চেয়ে বেশি চাকুরিজীবী।
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি বিষয়টির ব্যাখ্যা করছি। একদম ছোট্টবেলা থেকেই সংবাদপত্রের প্রতি আমার এক ধরনের টান আছে। ৮৯ সালের কথা। আমি তখন স্কুল ভর্তি হবো। বানান করে করে বাংলা পড়তে শিখে গেছি। আমার বাবা সরকারি কর্মকর্তা। পোষ্টিং চট্টগ্রামে। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সারকারখানার সরকারি কলোনীতে আমরা থাকতাম। চট্টগ্রাম শহর থেকে জায়গাটা বেশ দূরে। ফলে সেখানে পত্রিকা পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যেতো। যাই হোক, বিকেলের দিকে আমি বারান্দায় বসে থাকতাম হকারের জন্য। হকার যখন পত্রিকা নিয়ে আসতো আর সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেল বাজাতো আমি তখন দৌড়ে দোতালা থেকে নিচে গিয়ে পত্রিকা নিয়ে আসতাম। হকারকে দোতালা পর্যন্ত উঠতে হতো না বলে সেও বেশ খুশি ছিলো। আর আমি বাসার সবার আগে পত্রিকা ধরতে পেরে, নতুন কাগজের গন্ধ নিতে পেরে মহাখুশি ছিলাম। হকারের কাছ থেকে কাগজ এনে আমি অবাক চোখে তাকাতাম। আমি তখন সংবাদগুলো বুঝতাম না, কিন্তু বানান করে করে পড়তে ভালো লাগতো।
একটি বিষয় না বললেই নয়, বাবার যে বেতন সেই টাকা দিয়ে আমাদের পরিবারের খুব স্বচ্ছলভাবে চলার সুযোগ ছিলো না। তাই মাঝে মাঝেই বাবা বলতেন, বাসায় পত্রিকা বন্ধ করে দিতে। কিন্তু একদিন পত্রিকা না এলেই আমার মন খারাপ থাকতো। বাসায় পত্রিকা বন্ধ করার কথা উঠলেই আমি কান্নাকাটি শুরু করে দিতাম। এই কারণেই কখনো পত্রিকা বন্ধ হয়নি। এই যে ছোটবেলা থেকে সংবাদপত্রের প্রতি ভালোবাসা-সেটি আজো আমার আছে।
২০০২ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। থাকতাম জহরুল হক হক হলে। আমার তখন লেখালেখির প্রচণ্ড আগ্রহ। আমাদের হলের মাসুম ভাই (এখন এএসপি-খাগড়াছড়ি) তখন ইংরেজি দৈনিক অবজারভারে কালচারাল রিপোর্ট করতেন। তিনি একদিন আমাকে বললেন, ‘চল তোকে অবজারভার অফিসে নিয়ে যাই’। সেটাই আমার প্রথম কোন পত্রিকা অফিসে যাওয়া। মাসুম ভাই, আমাকে কালচারাল পাতার প্রধানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর আমি অবজারভার পত্রিকার কালচারাল বিষয়ক রিপোর্ট করা শুরু করলাম প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে। ওই পত্রিকায় আমার পোষ্ট কি-বেতন কতো এসব নিয়ে ভাবনার সময় আমার ছিলো না। অমি দেখতাম বড় করে আমার নাম ছাপা হচ্ছে অবজারভারে। আমি তাতেই চরম আনন্দিত হতাম। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ঢাকা শহরে ঘুরতাম।
একটি টাকা না পেয়েও অবজারভারে আমি ছয় মাস টানা কন্ট্রিবিউট করেছি কেবল নেশার জন্যই। এর মধ্যেই নতুনধারা নামে একটি নতুন পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে আগ্রহী হয়ে দরখাস্ত দিলাম। লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভা দেওয়ার পর শুরু হলো জনা পঞ্চাশেক তরুণ-তরুনীর প্রশিক্ষণ। তিন মাস পর ডামি। শুনলাম খুব শিগগিরই পত্রিকা বাজারে আসবে। আমি খুবই আগ্রহ নিয়ে প্রতিদিন অফিসে যাওয়া আসা করি। এর মধ্যেই একদিন শুনি পত্রিকাটি বের হচ্ছে না। আমার খুব কষ্ট লাগে; প্রচণ্ড কষ্ট। তবে সাংবাদিক হওয়ার নেশা আমার ক্রমেই বাড়ছে।
এরই মধ্যে কেটে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি বছর। ২০০৪ সাল। হলেরই আরেক বড় ভাই শাহরিয়ার জানালেন, তিনি বাংলাবাজার পত্রিকায় যোগ দিয়েছেন। আমি চাইলে কাজ করতে পারি। আমার বেতন ঠিক হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। এই প্রথম আমি সাংবাদিকতা করে টাকা পাওয়া শুরু করলাম। বাংলাবাজার পত্রিকায় আমি সহ-সম্পাদক ছিলাম। তবে আমি নানা বিষয়ে কাজ করেছি। বইমেলা থেকে শুরু করে কূটনীতিও।
আমাদের ব্যাচের অনেকেই তখন সাংবাদিকতা করছে। আমার বন্ধু অন্তু, শুভ, শিপু, কচি, কামরুল, রাজিবও আছে এই দলে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন বড় ঘটনা ঘটলেই কাভার করতাম।
মনে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হ্যাপি শাহবাগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে আমরা সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সবাই সারাতিন না খেয়ে কাজ করেছিলাম। আমাদের সবার মধ্যেই তখন কাজ করার নেশা।
শুধু হ্যাপির দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট আন্দোলনই নয়, আমার মনে আছে, হুমায়ুন আজাদ স্যারের আন্দোলনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ঘটনা ঘটলে আমরা আমরা সারাদিন সংবাদের জন্য দৌড়াতাম। তখনো মেইল সিস্টেম ছিলো। মোবইল ছিলো। কিন্তু একজন নিউজ লিখে অন্যকে মেইল করে দেওয়ার কালচার তখনো সেভাবে তৈরি হয়নি। এর বদলে আমরা সারাদিন কাজ করে নিজেদের মধ্যে ঘটনাগুলো শেয়ার করতাম। আমাদের মধ্যে সাংবাদিকতার প্রচন্ড নেশা ছিলো। অথচ টাকার কথা চিন্তা করলে অনেকেরই তখন সাংবাদিকতা করার কথা না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টাররা যা বেতন পায় তা দিয়ে মাস চলা অসম্ভব। কিন্তু তাতে আমাদের সাংবাদিকতার প্রতি আগ্রহ একটুও কমেনি। বরং উল্টো সাংবাদিকতার নেশাটা বেড়েছে।
২০০৫ সালের শুরুতে আমি যোগ দেই বিডিনিউজে। আর ওই বছরেরই শেষদিকে প্রথম আলোতে। জরুরী অবস্থায় রাত জেগে কাজ করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আগস্টের আন্দোলনের ঘটনা কাভার করাসহ আশপাশে কোন ঘটনা ঘটলে আমি নিজ উদ্যোগেই ছুটতাম। ২০০৮ সালে প্রথম আলো সারাদেশের সংযোগ সড়ক ছাড়া সেতুগুলো নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। আমাদের সে সময়ের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী এটির তত্ত্বাবধান করতেন আর আমি সারাদেশের রিপোর্টগুলোর সমন্বয় করছিলাম। সারাদেশ থেকে দুই থেকে আড়াইশ রিপোর্ট আসে। কিন্তু সারা দেশে সংযোগ সড়কহীন মোট কতোটি সেতু আছে সে বিষয়ে আমরা তখন কিছুই জানতে পারছিলাম না। তখন মূল প্রতিবেদনটি করার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। আমি এলজিইডি ও সড়ক-জনপথের অফিসে দিনের পর দিন ঘুরি। সুনির্দিষ্ট তথ্য পাচ্ছিলাম না কিন্তু সাংবাদিকতার নেশা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এর মধ্যেই আমি জানতে পারি সারা দেশে পৌনে তিন হাজার সেতু এভাবে পড়ে আছে। আমি এ সংক্রান্ত সব তথ্য অফিসে জানাই। সাত কলামজুড়ে আমার লিড নিউজসহ সেতু নিয়ে বিশেষ মলাট সংখ্যা প্রকাশ করে প্রথম আলো যা সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুলে। এই সেতুর কাজ করতে গিয়েই অমি জানতে পারি টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর আট-দশটি সেতুর কথা। আবার টাঙ্গাইলে যাই। দিনের পর দিন ঘুরে আবার রিপোর্ট করি। এ সব কিছু নিয়ে আবার প্রথম আলোর বিশাল শিরোনাম হয় ‘টাঙ্গাইল অচল করে রেখেছেন কাদের সিদ্দিকী’।
২০০৮ সালের মাঝামাঝি আমি নরওয়ের স্কলারশীপে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে রিজিওনাল মাষ্টার্সে ভর্তি হই। ২০০৯ সালের জুনে আমার মাষ্টার্সের দুটি সেমিস্টার শেষ হয়ে যায়। বাকি ছিলো কেবল থিসিস। আমি এ সময় থেকেই পুরোপুরি রিপোটিং করার সিদ্ধান্ত নেই। প্রথম আলোতে আমি কাজ করছি সাত বছর ধরে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই সাংবাদিকতা। গত এক দশকে আমার কখনোই মনে হয়নি, সাংবাদিকতা চাকুরি। বরং, নেশার বশেই সাংবাদিকতা করছি।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একটি সংবাদ একজন মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। বদলে দিতে পারে একটি প্রতিষ্ঠান এমনকি কোন কোন সময় সমাজ-রাষ্ট্রও। আমার মনে আছে, বিডিআর বিদ্রোহের সয়ম ১৩ বছরের এক ছোট্ট কিশোর চা বিক্রেতা অকতারও গুলিবিদ্ধ হয়। কয়েকমাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকার পর চিকিৎসা শেষ হওয়ার আগেই হাসপাতাল কর্তপক্ষ তাকে ছেড়ে দেয়। টাকা নেই বলে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ত্বের দিকে যাচ্ছিলো আকতার। একদিন তাকে নিয়ে ছোট্ট একটি নিউজ করি। মানবিক ওই নিউজটি পড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেকে নিয়ে আকতারকে এক লাখ টাকা দেন। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী অ্যাটম নামে এক ভাই আকতারকে সেদেশে নিয়ে সুস্থ্য করে। আকতার দেশে ফিরে আমাকে অস্ট্রেলিয়ার গল্প বলে। ওর বাবা খুশিতে কাঁদে, আমিও চোখের জল লুকাই। সাংবাদিক হিসেবে আমার ভালো লাগে।
এক দশকের সাংবাদিকতা জীবনে এমন অনেক মানবিক ঘটনার স্বাক্ষী আমি। এর মধ্যে গত তিন বছর ধরে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিদের দুঃখ-কষ্ট আর তাদের সমস্যা নিয়ে লিখছি। অনেক সময়েই নিউজের পরইে তাদের সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে। মানুষগুলো হাসি মুখ দেখে আমার ভালো লেগেছে।
২০১০ সালে মালয়েশিয়ায় কয়েকলাখ বাংলাদেশি শ্রমিক অবৈধ হয়ে চরম কষ্টে দিন কাটাতে থাকে। প্রতিদিন তারা ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে ফোন করে বলে, আপনারা এসে একটু আমাদের অবস্থা দেখে যান। অফিস আমাকে সরেজমিন দেখতে পাঠায় তাদের অবস্থা। আমি মালয়েশিয়া থেকে একের পর এক রিপোর্ট করতে থাকি ধারাবাবিহকিভাবে। টনক নড়ে সরকারের। আরো উদ্যোগী হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয় ও মালয়েশিয়ার দূতাবাস। এক সময়ে সরকারের চেষ্টায় ওই শ্রমিকরা বৈধতা পায়। এখনো মালয়েশিয়া থেকে অনেক শ্রমিক আমাকে ফোন করে। তাদের ধারণা আমিই তাদের বাঁচিয়েছি, অথচ আমি কেবল আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছি।
আমার সারাজীবন মনে থাকবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্বপনের কথা। অন্ধ এই ছেলেটি একজন শ্রতিলেখক নিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিতো। সে বলতো আর ওই শ্রুতিলেখক লিখতো। কিন্তু নির্ধারিত শ্রুতিলেখকের সমস্যার কারণে একদিন সে আরেকজনকে নিয়ে যায। পিএসসি তার পরীক্ষা নেয়নি। আমি স্বপনকে নিয়ে নিউজ করলাম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্বপনের স্বপ্নভঙ্গ। নিউজের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলো। অবশেষে পিএসসি তার পরীক্ষা নিলো। স্বপন আজ আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফট উইংয়েরর সহকারী সচিব।
আমি কখনো ভুলবো না সহকারী জজ মামুনের কথা। শত্রুতামূলক একের পর এক মামলাজিটলতায় তার চাকুরি পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যায়। তাকে নিয়ে একটা নিউজ করলাম। আজ মামুন সহকারী জজ। ৩৪ তম বিসিএস পরীক্ষার প্রথম প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলে হাজার হাজার মেধাবী বঞ্চিত। নিউজ করলাম। আবার ফল প্রকাশ করতে বাধ্য পিএসসি। সাংবাদিক হিসেবে এগুলো আমাকে সন্তুষ্ট করে। মনে হয় মানুষের জন্য কিছু করতে পেরেছি।
আমার মনে এখনো দাগ কেটে আছে ব্রিটেন থেকে আসা নেথার কথা। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর ব্রিটিশ তরুণী নেথা বাংলাদেশে এসেছে তার বাবাকে খুঁজতে। বাবাকে না পেলে অন্ততপক্ষে বাবার কবরটি দেখতে চায় সে। অথচ বাবার একটি ছবি ছাড়া আর কিছুই নেই তার কাছে। ঢাকায় এসে একজনের মাধ্যমে নেথা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ১৬ কোটি মসানুষের দেশে কোন তথ্য ছাড়া তাঁর বাবাকে খোঁজা কঠিন কাজ। তবুও আমি নেথার ঘটনা শুনি। পত্রিকায় লিখি বাবাকে খুঁজতে আসা নেথার গল্পের কথা। পরদিন নিউজ ছবি ছাপা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সারাদিন আবেগকণ্ঠে অনেক ফোন আসে। সন্ধ্যার সময় খবর পাই নেথার পরিবারের। তারা প্রথম আলো কার্যালয়ে ছুটে আসে। আসে নেথাও। শুরু হয় আনন্দের কান্না। এ যেন সিনেমাকেও হার মানিয়েছে। নেথা ছুটে যায় বাবার কবরে। আর আমার চোখে ভিজে আসে আনন্দে।
সাংবাদিকতার এই যে আনন্দ-প্রাপ্তি তা আমাকে আর কোন পেশা দিতে পারবে? এই নেশার কারণেই আসলে সাংবাদিকতা করা। গত এক দশকে আমি অনেকবার কেদেছি অবেগে-কষ্টে। আবার কেদেছি আনন্দেও। এই যে মানুষ নিয়ে কাবরাবার, মানুষের দুখ কষ্ট নিয়ে কারবার, জীবন নিয়ে কারবার, তা আমি আর কোথায় গিয়ে পাবো? আমি জানি পৃথিবীর আর কোন পেশাই আমাকে তা দিতে পারবে না। আর তাই আমি সবসময়ই সাংবাদিকই থাকতে চাই।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে-সাংবাদিকতার এই নেশা কেন সাংবাদিকতা বিভাগের সব ছাত্রের মধ্যে কিংবা সব সাংবাদিকদের মধ্যে থাকে না? আমার মনে হয়, এর পেছনে কয়েকটি কারণ অছে। প্রথমত-ইচ্ছে না থাকলে, নেশা না থাকলে কারো সাংবাদিকতায় আসা ঠিক নয়। দ্বিতীয়ত, দুষতে চাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। আমাদের শ্রদ্ধেয় অনেক শিক্ষই হয়তো রাগ করতে পারেন কিন্তু বাস্তবতা হলো, যারা সাংবাদিকতার শিক্ষক তাদের বেশিরভাগই ছাত্রদের মধ্যে সাংবাদিকতার জন্য আলাদা করে কোন ভালোলাগা, কোন নেশা তৈরি করতে পারেন না। আমাদের যে শিক্ষক ক্লাসে রিপোর্টিং পড়ান তিনি হয়তো কোনদিন রিপোর্টই করেননি। যিনি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পড়ান তিনি কোনদিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনই করেননি। যিনি সম্পাদনা পড়ান তিনি হয়তো হয়তো কোনদিন সম্পাদনাই করেননি। যিনি ফটোগ্রাফি পড়াচ্ছেন তিনি জীবনে কোনদিন ক্যামেরা হাতে ভালো কোন ছবিই তোলেননি। কাজেই যার বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই তিনি যতো ভালো ছাত্রই হোন না কেন, যতো তত্ত্বই তার মুখস্থ থাক না কেন তিনি কখনো কখনো তাঁর ছাত্রদের মধ্যে সাংবাদিকতার নেশা তৈরি করে দিতে পারবেন না।
এবার আসছি তৃতীয় বিষয়ে। এদেশে যারা সাংবাদিকতা করতে আসে তাদের অনেকেরই প্রচন্ড ইচ্ছা থাকে। কিন্তু এক পর্যায়ে সেটি নষ্ট হয়ে যায় অফিসের কারণে। দিনের পর দিন হয়তো একজন সাংবাদিক ভালো রিপোর্ট করছে কিন্তু নুন্যতমভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে বেতন তা পাচ্ছে না। আছে প্রতিষ্ঠানের নানান রাজনীতি। ফলে অনেক আশা নিয়ে যে ছেলে বা মেয়েটি সাংবাদিকতা করতে আসে একদিন তার মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। ফলে মনের দুঃখে একদিন সাংবাদিকতাকে সে চাকুরি বানিয়ে ফেলে। এরপর ওই সাংবাদিক অসৎ হতেও আর দ্বিধা করে না।
শেষ করছি আশাবাদ দিয়ে। এই প্রজক্টের যারা তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক কিংবা কোন দৈনিক বা টেলিভিশনের তরুণ সাংবাদিক কিংবা কোন অঞ্চলের একজন প্রতিনিধি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ‘তুমি যে বেতন পাও সেটি হয়তো অনেক কম। অপেক্ষা করো, একদিন ভালো বেতন পাবে। তুমি যে প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করো সেটি হয়তো অতো ভালো নয়। অপেক্ষা করো তুমিও একদিন ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতে পারবে। কিন্তু সাংবাদিকতার জন্য যে ভালোবাসা, যে নেশা সেই নেশা তুমি হারিয়ে ফেলো না। কারণ সেই নেশা হারিয়ে গেলে তুমি আর সাংবাদিক থাকবে না। মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ পাবে না’।
আবারো বলছি-সাংবাদিকতা কোন চাকুরি নয়, এটি এক ধরনের ভালোলাগা, এক ধরনের নেশা। এ নেশা ভালো কিছু করার। পৃথিবীর আর কোন পেশাতেই এতো স্বাধীনতা ও মানুষের জন্য কিছু করার এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। আর তাই সাংবাদিকতা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশ কিংবা প্রশাসনের বড় কর্তা হওয়ার পরেও কারো কারো এই পেশার প্রতি টান থেকে যায় আর তারা সব ছেড়ে আবারো ফিরে আসে সাংবাদিকতায়। আমি জানি এই নেশা কতোটা তীব্র। আর সে কারণেই আমি আজীবন সাংবাদিক থাকতে চাই। চাই নেশাটা থাকুক আজীবন আর এই নেশা ছড়িয়ে পড়ুক সব সাংবাদিকের মধ্যে।
শরিফুল হাসান, সিনিয়র রিপোর্টার, প্রথম আলো। ইমেইল[email protected]
(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির বার্ষিক প্রকাশনায় লেখাটি লিখেছিলাম। ব্লগে দিলাম পাঠকদের জন্য)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫১