রোহিঙ্গাদের নিয়ে এখন পুরো দেশ বিভক্ত। কেউ বলছে তাদের আশ্রয় দেয়া উচিত, কেউ বলছে না। ফেসবুক-ব্লগ-পত্রিকা-টেলিভিশন সব মাধ্যমেই চলছে তুমুল আলোচনা। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে না। অনেকেই বলছে, তারা মুসলিম তাই তাদের আশ্রয় দিতে হবে। আমি এতো কথা, এতো আইন বুঝতে চাই না। আমি কেবল বুঝি ধর্ম-বর্ণ-জাতি এগুলো কোন পরিচয় নয়, সবচেয়ে বড় পরিচয় মানুষ। আর মানুষ হিসেবে আমার কাজ মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে চাইছেন না আমি জানি তারা বাংলাদেশের ভালো চান বলেই এটি ভাবছেন। কারণ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে গত দুই দশক ধরে কক্সবাজারে ভয়াবহ সমস্যায় আছে বাংলাদেশ। অপরাধ বাড়ছে, মাদক পাচার বাড়ছে, বাড়ছে আরো নানা সমস্যা। আবার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে রোহিঙ্গারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করছে। এগুলো সবই সত্য। কিন্তু একবার ভাবুন তো আগুনে পুড়ে যাবার ভয়ে, নিজের শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য, অসহায় মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পেরিয়ে বাংলাদেশ আসছে একটু আশ্রয়ের জন্য আর আপনি তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন এটা কতোটা অমনাবিক...একবার ভাবুন তো ওই জায়গায় যদি আপনি থাকতেন, আপনার কোলের শিশুটি থাকতো তাহলে কি হতো?
আপনারা যারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তাদের বলছি, রোহিঙ্গা বিষয়টি নিয়ে আমি একটা থিসিস করেছি। জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে আমি সাংবাদিকতা করি, কাজেই আমি জানি তারা বাংলাদেশের জন্য বিরাট এক সমস্যা। আর যেই এলাকায় এখন সমস্যা হচ্ছে সেই মংডুতে আমি ২০০৬ সালে ঘুরে এসেছি। কাজেই সব জেনেই আমি তাদের সাহায্য করতে চাই, আশ্রয় দিতে চাই কারণ তারা মানুষ। মানুষ হিসেবে অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানোই সবচেয়ে বড় ধর্ম। আপানারা আল্লাহ বলুন, ঈশ্বর বলুন, ভগবান বলুন, এমন কোন ধর্মগ্রন্থ বলুন যেখানে রেখা আছে অসহায় মানুষের পাশে দাড়াতে হলে এতো কিছু ভাবতে হবে।
এবার আসছি আরেক পক্ষের কথায়। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার পক্ষ নিতে গিয়ে অনেকেই বলছেন, তারা মুসলমান, তাই তাদের আশ্রয় দিতে হবে। ধিক আপনাদের। মানুষের পরিচয় কখনোই মুসলমান হতে পারে না যে কারণে তাকে সাহায্য করতে হবে। আপনার কাছে যদি দুজন ক্ষুধার্ত মানুষ আসে এবং একজনকে মুসলমান বলে আপনি খাওয়ান আর আরেকজনকে হিন্দু বা বৌদ্ধ বলে ফিরিয়ে দেন তাহলে আপনার আল্লাহ নিশ্চয়ই খুশি হবেন না আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি। কাজেই শুধুমাত্র মুসলমান বলে দয়া করে কেউ তাদের সাহায্য করার কথা বলবেন না। তাদের সাহায্য করার সবচেয়ে বড় কারণ তারা অসহায় মানুষ।
এবার আসছি রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে আমাদের সরকারের ভাবনার। আমি সরকারের অবস্থানের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দাঙ্গার কারণে মিয়ানমার ছেড়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অব্যাহত আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মনি হস্পতিবার সংসদে বলেছেন, শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কোনো সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেনি। তাই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে আমাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। একজন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এমন অথর্বের মতো কথা বলেন কি করে? বিপদে পড়া মানুষকে সাহায্য করার জন্য কোন আইন দরকার হয় না। কোন আইন এক্ষেত্রে বাঁধাও হতে পারে না। এইসব অথর্ব আমলাতন্ত্র, অথর্ব কূটনীতেকে আমি লাথি মারি। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, জামাতের সম্পৃক্ততার কথা। আমি ধরে নিচ্ছি এটা সত্য। কিন্তু এই মুহুর্তে এটি গুরুত্বপূর্ণ না।
আমার মতামত, হলো বর্তমান যে অবস্থা তাতে বাংলাদেশ সারাপৃথিবীতে একটা নজির সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ এই মানুষগুলোকে আশ্রয় দিতে পারে। এরপর আমাদের প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বের মানুষের প্রতি একটা আপিল করতে পারেন, রোহিঙ্গা শরনাথীদের নিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা আছে। এছাড়া বাংলাদেশ ধর্নী দেশ নয়। কিন্তু আমাদের মন বড় তাই মানবিক দিক বিবেচনা করে আমরা তাদের সাহায্য করছি। এখন সারা পৃথিবীকেই এই বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে। আপনারা আসুন, দেখুন তারা কিভাবে আছে। আপনারা তাদের সহায়তা দিন। আর এদের দেশে ফিরিয়ে নেবার ব্যাবস্থা করুন। বাংলাদেশের এখন একটি তালিকা করা উচিত এবং বলা উচিত জাতিসংঘ যদি এদের বিষয়ে ব্যাবস্থা নেবার আশ্বাস দেয় তাহলে আমরা তাদের আশ্রয় দিতে পারি। সরকার যদি এমনটা না করে তাদের ফিরিয়ে দেয় তাহলে সারা পৃথিবী আমাদের স্বার্থপর ভাববে। বাংলাদেশের মানুষ উদার বলে যে পরিচয় আছে সেটি তখন মুছে যাবে।
শেষ করছি একটা খবর দিয়ে। চ্যানেল ২৪ এর খবরে দেখাচ্ছে ২ মাস বয়সী একটা বাচ্চা দিনখানেক সাগরে ভেসে মায়ানমার থেকে আমাদের তীরে চলে এসেছে। বিজিবির সদস্যরা বাচ্চাটাকে তুলে এনেছে। বাচ্চাটার বুকের হাড্ডি সব গোনা যায়। এক জেলে আর তার বউ বাচ্চাটাকে ফিডারে করে দুধ খাওয়াচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বলেছেন বাংলাদেশ কোনো আইন কিতাবে বাধ্য নয় যে অন্য দেশ থেকে .কেউ জান বাঁচাতে চাইলেই তাকে ঢুকতে দিতে হবে। মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটি কোন আইনের বিষয় নয়। আর সে কারণেই ওই বাচ্চাটাকে আমরা তুলেছি, কোন একজন জেলেবধু তাকে খেতে দিচ্ছে। এর নামই মানবিকতা।
ধরুণ, আহত অবস্থায় একটা কুকুর আপনার বাড়িতে চলে এসেছে একটু আশ্রয়ের জন্য। কিংবা ধরুন একটা পাখি আহত অবস্থায় কাতরাচ্ছে। আপনি কি করবেন? যার মধ্যে বিন্দুমাত্র মায়া-দয়া আছে তিনি চেষ্টা করবেন পানি দিয়ে, সেবা দিয়ে আহত পশু বা পাখিটিকে বাঁচিয়ে তুলতে। কিন্তু মানুষ হলে? উত্তরটা হলো, মানুষ হলে শুরু হয়ে যাবে রাজনীত। আমরা সেটাই যেন প্রমাণ করছি। আমি জানি এই মুহুর্তে যদি আমরা বিপদে পড়া এই মানুষগুলোকে আশ্রয় না দেই তাহলে পৃথিবীর মানবতার ইতিহাস কখনোই আমাদের ক্ষমা করবে না। আমরা কখনোই আমাদের বিবেকবোধের কাছ থেকে রক্ষা পাবো না। তাই সব পরিচয় ভুলে গিয়ে আমাদের এখন এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাড়ানো উচিত। সেটি করতে না পারলে আমরা যারা নিজেকে মানুষ বলে দাবি করি তারা আর মানুষ থাকবো না।..
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০১২ রাত ৯:১৮