নোবেলজয়ী ড. ইউনূস আজকে বিকেলে সামাজিক ব্যাবসা নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা এক ঘন্টা লেকচার দিলেন। আমার এসাইনমেন্ট ছিলো। ড. ইউনূসের লেকচারে আমি মুগ্ধ। আমি জানি না সামাজিক ব্যাবসা আসলেই সম্ভব কিনা কিন্তু তিনি যা বলেছেন তাতে স্বপ্ন তদেখতে ভালো লেগেছে।
ড.ইউনূস তাঁর বক্তব্যে তরুণ সমাজকে টাকা বানানোর যন্ত্র না হয়ে সামাজিক ব্যাবসার মাধ্যমে মানুষের জন্য কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন। সামাজিক ব্যাবসা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ড.ইউনূস যা বলেছেনে সেটি আমাকে মুগদ্ধ করেছে। উনি বলেছেন, আজকে ব্যাবসা মানে কেবলই নিজের পুজি বাড়ানো। এটাই যেন নিয়ম হয়ে গেছে। আজকে একটি প্রতিষ্ঠান খোলা হয় টাকা বাড়ানোর জন্য। যে মানুষটি সেখানে চাকুরি করেন তার কাজ থাকে সারাদিন পরিশ্রম করে আরো বেশি টাকা আয় করা। সবার মধ্যেই আজ যেন টাকার আসক্তি। টাকা ছাড়া যেন মানুষ কিছুই ভাবতে পারছে না। কিন্তু মানুষ তো কেবল টাকা বানানোর যন্ত্র না। মানুষের মানবিকতা আছে। মানুষের জন্য কিছু করার দায়িত্ব আছে। সামাজিক ব্যাবসায় আমি সেই কথাগুলোই বলছি।
ড.ইউনূস বলেন, ‘সমস্যার সমাধানের জন্যই সামাজিক ব্যাবসা। বেকার মানুষের যেন কর্মসংস্থান হয় সে কারণেই একটি প্রতিষ্ঠান খুলতে হবে। সেই প্রতিষ্ঠানের কেবল মনুাফা করার দরকার নেই। আপনি যেই টাকা বিনিয়োগ করবেন সেই টাকা যদি উঠে আসে আর মানুষের যদি উপকার হয় সেটিই হবে সামাজিক ব্যবসা। এর মাধ্যমেই পৃথিবী থেকে দারিদ্র দূর করা সম্ভব। এখন আপনাকেই ঠিক করতে হবে আপনি টাকা বানাবেন না মানুষের জন্য কিছু করবেন’।
ড.ইউনুস বলেন, ‘তরুণসমাজসহ সবার কাছে আমার প্রশ্ন এই যে সমাজে দারিদ্র, বেকারত্ব সেগুলো দূর করার দায়িত্ব কে নেবে? সরকারের পক্ষে কখনোই এটি সমাধান করা সম্ভব নয়। তাই সাধারণ মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ প্রত্যেক মানুষেরই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব আছে’।
এই কথাগুলো আমাকে দারুণ ইমপ্রেস করেছে। ড.ইউনুস প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ‘একজন মানুষের কতো টাকা আয় করতে হবে? কতো টাকা লাগে একজন মানুষের। টাকা আয় করাই কি মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য? কখনোই সেটি হতে পারে না। আমরা মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীতে এসেছি। আমাদের কিছু দায়িত্ব আছে’। দারুণ সত্যি কথা।
ড.ইউনস বলেন, ‘আজকে ইউরোপে ৫০ ভাগেরও বেশি মানুষ বেকার। সারা পৃথিবীতেই মানুষ বেকার। কিন্তু কেন মানুষ বেকার থাকবে? তার তো কাজ করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমরা পদ্ধতি এমন বানিয়ে রেখেছি যার কারণে মানুষ তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না।
তরুণ সমাজের উদ্দেশ্যে ড.ইউনূস বলেন, ‘এক দশক আগে কে ভাবতে পেরেছিলো বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের হতে মোবাইল থাকবে? কিন্তু এটাই তো আজকের বাস্তবতা। তরুণ সমাজের কাছে আজকে প্রযুক্তি আছে। নিজস্ব ভাবনা আছে। এসব নিয়েই মানুষের জন্য কিছু করার উদ্যোগ নিতে হবে। শুধুমাত্র মুনাফা করা আর টাকা আয় করার ভাবনা থেকে তোমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তোমরা সামাজিক ব্যাবসার নতুন নতুণ ধারনা নিয়ে আসো যেই ভাবনা দিয়ে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা হবে। দারিদ্র দূর হবে। মানুষ গরিব থাকবে না’।
ড.ইউনূস বলেন, ‘সৎপথে টাকা রোজগারের আনন্দ আচে। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আনন্দ মানুষের জন্য কিছু করার। এই তৃপ্তির কথা অর্থনীতির বইয়ে থাকে না। এই কথা কেউ বলে না। আমি জানি আজকের তরুণরা কেবল টাকা আয় করতে চায় না। তারা মানুষের জন্য কিছু করতে চায়। আর সামাজিক ব্যাবসার মাধ্যমে আমি সেই কথাগুলোই বলছি’। তাঁর মতে ‘সামাজিক ব্যবসায় মুনাফা নেওয়ার রেওয়াজ নেই। এটা মানুষের মঙ্গলের জন্য। এখান থেকে এর উদ্যোক্তারা মুনাফা নিতে পারবে না। আমরা টাকা উপার্জন করে যেমন আনন্দ পাই। তেমনি মানুষের সমস্যা দূর করতে পারলেও আনন্দ পাই। আর এ দুই তৃপ্তির মধ্যে সমন্বয় করতে পারে সামাজিক ব্যবসা।’
ড.ইউনূস বলেন, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কারের আগে কল্পকাহিনী লেখা হয়। চাঁদে যাওয়ার অনেক আগে থেকে মানুষ চাঁদে যাওয়ার কল্পকাহিনী বলে আসছে। তরুণ সমাজকেও এখন এমন কল্পকাহিনী লিখতে হবে, ভাবতে হবে যে একদিন পৃথিবীতে দারিদ্র থাকবে না। গরিব থাকবে না। আমরা সেটি ভাবতে পারলেই উপায় বের হয়ে যাবে।
এই কথাগুলোও খুব ভালো লেগেছে আমার। আসলেই আমরা আমাদের সমাজ কেমন হবে ২০-২৫ বছর পর তা নিয়ে আমরা কল্পকাহিনী লিখিনা। কিন্তু কেন? আসলেই তো? আমরা কেন লিখি না এমন কাহিনী যেখানে বৈষম্য থাকবে না, গরিব থাকবে না, অনিয়ম থাকবে না..
অনুষ্ঠানে আকবর আলী খানের একটি কথা খুব ভালো লেগেছে। আকবর আলী খান বলেছেন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ড.ইউনুস মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়াশিংটনে বসে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করেছেন তিনি জানেন। এমন একজন মানুষকে সরকার সম্মান দেখায় না।
আসলেই তো। কেন আমরা এমন একজন মানুষকে সম্মান করি না। আমরা আসলেই খুব অভাগা জাতি। আমরা জানি না কাকে সম্মান করতে হয়, কাকে করতে হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:০৫