বাংলা, উর্দু, হিন্দী, গুজরাটী এবং মালয়ী ও ইন্দোনেশিয়ার মতো অষ্ট্রোনেশিয় ভাষায় আত্মত্যাগের আরেকটি আরবী শব্দ কুরবান ব্যবহার করা হয়। এসব দেশে ঈদুল আযহাকে বলা হয় কুরবানীর ঈদ। আফগানিস্তান ও ইরানে বলা হয় ঈদে কুরবান। চীনা ভাষায় ঈদুল আযহাকে বলা হয় কুরবান জিয়ে আর উইঘররা বলেন কুরবান হেইত। মালয়েশীয় ও ইন্দোনেশীয়রা বলেন, হারি রাইয়া কুরবান। তুর্কীরা বলেন, কুরবান বাইরামী, আজারী ও তাতারীরা, বসনীয় ও ক্রোয়েশীয়রা একই কথা বলেন। ইয়েমেন, সিরিয়া, ও মিশরসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে বলা হয় ঈদুল কবীর।
কোন কোন স্থানে বকরা ঈদও বলা হয়। নাইজেরিয়া, সোমালিয়াসহ মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও ঈদুল আযহার ভিন্ন ভিন্ন জনপ্রিয় নাম রয়েছে। জার্মানীতে ঈদুল আযহাকে বলা হয় অপফেরফেস্ট আর হাঙ্গেরীতে বলা হয় আলদোজাতি উন্নেপ।
কুরবানীর ইতিহাস ততোটাই প্রাচীন যতোটা প্রাচীন মানব অথবা ধর্মের ইতিহাস। আল্লাহ পুরস্তির কুরবানী নামক এ মহান নিদর্শন মানব জাতির প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত সকল শরীয়তেই কার্যকর ছিলো। সকল নবীর উম্মতকেই কুরবানী করতে হয়েছে। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ। আল্লাহতায়ালার এ বিধান মানব জাতির সৃষ্টি লগ্ন থেকেই কার্যকর হয়ে আসছে ।
মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোন না কোন ভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে । এটাই মানুষের চিরন্তন স্বভাব বা ফিতরাত। আর এই ঈদের সাথে কিংবা লাগোয়া যেকোনো জাতীয় উৎসব কিংবা দিবস ম্লান হয়ে ধরা দেয়। এর কারণ জাতির মন, মনন ও জীবনযাপনে ঈদের প্রভাব অপ্রতিহত। একটি জাতিসত্তাকে বোঝার জন্য এই বৈশিষ্ট্যটিই যথেষ্ট।
এই উৎসবকে ঘিরে আমরা যখন আমাদের গণমাধ্যম গুলেতো বিভিন্ন ধরনের সংবাদ শুনি আমরা খুব-ই মর্মাহত হই। আর তথ্য প্রযুক্তির যুগে প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ব্লগ, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে নিমিষেই আমরা দেশের এক প্রান্তের খবর জানতে পারি। আমার জ্ঞান হবার পর থেকেই দেখে আসছি যে, মুসলমানের জাতীয় জীবনের প্রধান দুই উৎসবেই দুনীতি অনুসরন করে আসছে। আমাদের ধর্মীয় মাযহাবে চারটি মতামতকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। কিন্তু আমরা দেখি দেশের একপ্রান্তের মানুষ রোজা রাখাছে আর অন্যপ্রান্তের মানুষ ঈদগাহে নামাজ পড়তে যাচ্ছে। একদিন আগে কোরবানির জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এ বিষয়টি বড় বেমানান লাগে যখন আমরা একটি উৎসবকে ঘিরে এতগুলো শিরেনাম দেখি-
-ঈদ উদযাপন হলো ৪০টি গ্রামে ।
-চার জেলায় ৭০ গ্রামে আজ ঈদ।
-দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৪০টি গ্রামে ঈদ আজ ।
-দেশের বিভিন্ন জেলায় ঈদ উদযাপন।
-সৌদী আরবের সঙ্গে মিল রেখে নয় জেলার ১৪২ টি গ্রামে ঈদুল ফিতর -পালিত হচ্ছে।
-পাঁচ জেলায় ১০৪ গ্রামে আজ ঈদ উদযাপন
-বিভিন্ন জেলার দেড় শ গ্রামে গতকাল ঈদ উদযাপিত।
-শতাধিক গ্রামে আগাম ঈদ।
-একদিন আগে ঈদ করলেন ১৯০ গ্রামের মানু.
-পৃথিবীর অন্য যেকোন দেশে চাঁদ দেখা গেলেই রোজা, ঈদ এবং কোরবানী।
-সৌদি আরবে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে বরিশালের ১২ হাজার পরিবার
ঈদ উদযাপন করবে কাল।
ভৌগলিক দূরত্ব অনুযায়ী বাংলাদেশের ঢাকায় যখন সকাল ৯টা তখন সৌদি আরবের রিয়াদে দুপুর ১২টা। তার মানে প্রায় তিন ঘন্টা সময়ের পার্থক্য রয়েছে এ দুদেশের মধ্যে। আর ঢাকা থেকে রিয়াদের দূরত্ব ৪ হাজার ৫শত ৯১ কিলোমিটার। আর সেটাকে মাইলে হিসেব করলে দাঁড়ায় ২ হাজার ৮শত ৫৩ মাইল। স্বাভাবিক ভাবে একটি হিসেব করলে সৌদি আরবের নামাজের সময়, সেহরী ও ইফতারের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য ধরা পড়ে। যেটা আমাদের বাংলাদেশেও ছয়টি বিভাগের মধ্যেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সে যুক্তি অনুযায়ী সৌদি আরবে যেদিন ঈদ উদযাপন করা হয় সেদিন আমাদের দেশে ঈদ হতে পারেনা। তাছাড়া আল্লাহর যে প্রাকৃতিক বিধান রয়েছে চাঁদ ও দিবা রাত্রির অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশের খেলা। তা আমরা অস্বীকার করব কিভাবে!
আমরা হতবাক হইম বিস্মিত হই। আমাদের আল কোরআন বিজ্ঞানময়। আমাদের ধর্মের প্রতিটি বিষয়ের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষন রয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা নীরব ভূমিকা পালন করছে আমাদের আলেম সমাজ। কিন্তু কেন তা আমার জানা নেই।
দেশে যেখানে একটি নির্ভরযোগ্য জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি আছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন আছে, শিক্ষিত বিবেকবান ওলামা পরিষদ আছে, প্রশাসন আছে, উন্নত প্রযুক্তি আছে এবং সর্বোপরি বিজ্ঞানময় কোরআন আছে সেখানে আমরা এসব তথ্যকে প্রাধান্য না দিয়ে একদিন আগে যে ঈদ ঊৎসব পালন করছি তা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা আমার কাছে বড় প্রশ্নবোধক ।
এবছর সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশের চাঁদপুর, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ও নারায়ণগঞ্জের প্রায় ৭০টি গ্রামে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছে। আগস্ট ০৮, ২০১৩ তারিখে সে খবরটি ফলাও করে ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশের সবকটি জাতীয় দৈনিকে। সে খবরে যে বিশ্লেষন তুলে ধরা হয়েছিল আমি উদ্ধৃত করছি-
চাঁদপুর: চাঁদপুরের ৪০টি গ্রামে প্রায় ৫০ হাজার মুসলমান আজ ঈদুল ফিতর উদযাপন করছেন। এসব গ্রামের হাটবাজার ও ঈদগাহ বিভিন্ন সাজে সাজানো হয়েছে। হাজীগঞ্জ উপজেলার সাদ্রা গ্রামের মরহুম মাওলানা ইসহাক খানের চতুর্থ ছেলে মাওলানা জাকারিয়া আল মাদানী এক দিন আগে ঈদ উদযাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, তাঁর বাবা মরহুম মাওলানা ইসহাক খান বিশ্বের অন্য কোথাও চাঁদ উঠেছে শুনে ১৯৩১ সালে প্রথম হাজীগঞ্জের সাদ্রা গ্রামে এ রীতি চালু করেন। এর পর থেকে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার ১১ গ্রামে, ফরিদগঞ্জ উপজেলার ২২ গ্রামে ও মতলব উত্তর উপজেলার সাতটি গ্রামের প্রায় অর্ধ লাখ মুসলিম এ নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তাঁরা বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় সৌদি আরবসহ বিভিন্ন জায়গায় ঈদ হবে শুনে চাঁদপুরের ৪০ গ্রামে ঈদ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেন।
পটুয়াখালী: প্রতিবছরের মতো এবারও সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে পটুয়াখালীর ২২টি গ্রামের পাঁচ সহস্রাধিক পরিবার আজ বৃহস্পতিবার পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করছেন। সকাল সাড়ে নয়টায় পটুয়াখালীর সদর উপজেলার বদরপুর দরবার শরিফ জামে মসজিদে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
সকাল থেকে নতুন পোশাক পরে শিশু-কিশোরসহ ওই ২২ গ্রামের পুরুষেরা ঈদের নামাজ আদায় করতে ঈদগাহ মাঠে সমবেত হতে থাকেন। ঈদের নামাজে ইমামতি করেছেন দরবার শরিফের ছোট পীরজাদা আলহাজ সাইয়েদ মুহাম্মদ নাসির বিল্লাহ রব্বানী। নামাজ শেষে দেশ ও জাতি এবং বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়।
মঠবাড়িয়া (পিরোজপুর): পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের ছয় গ্রামের পাঁচ শতাধিক পরিবার আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করছেন। সকাল নয়টায় সাপলেজা ইউনিয়নের ভাইজোড়া গ্রামের খোন্দকারবাড়ি ও সাড়ে নয়টায় কচুবাড়িয়া গ্রামের হাজি ওয়াহেদ আলী হাওলাদারবাড়িতে ঈদের দুটি জামাত হয়। এতে ইমামতি করেন মুন্সী শাহ আলম ও মৌলভী হায়দার আলী ।
সুরেশ্বর পীরের অনুসারী কচুবাড়িয়া গ্রামের সাবেক ইউয়নিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা ১০ জুলাই শুক্রবার সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা রেখেছি এবং আজ সৌদি আরবের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করছি।’
নারায়ণগঞ্জ: ফতুল্লার লামাপাড়ায়ও সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উদযাপিত হচ্ছে। হজরত শাহ সুফি মমতাজিয়া এতিমখানা ও হেফজখানা মাদ্রাসায় ‘জাহাগিরিয়া তরিকার’ অনুসারীরা আজ ঈদ উদযাপন করছেন। প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদের জামাতে গাজীপুরের টঙ্গী, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, পুরান ঢাকা, ডেমরা, সাভার এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, বন্দর ও সোনারগাঁ উপজেলা থেকে দুই শতাধিক মুসল্লি অংশ নেন। ঈদের জামাতের ইমামতি করেন হজরত শাহ সুফি মমতাজিয়া মাদ্রাসার মুফতি মাওলানা আনোয়ার হোসেন।
জাতির ধর্মজীবনকে জীবনঘনিষ্ঠ ও প্রাণময় করে পাওয়ার এ উপমা অনেক প্রশ্নের জবাব পাইয়ে দেয়। উৎসব পরিবারকেন্দ্রিক হতে পারে। সমাজকেন্দ্রিকও হতে পারে। কালের বিবর্তনে উৎসবের রূপ বদলায়। কোনোটি বিলুপ্ত হয়। আবার কোনোটি নতুন সৃষ্টি হয়। উৎসবগুলোর কোনোটিতে থাকে সমাজ-সভ্যতা ও জাতীয়তার ছাপ। কোনোটিতে সরাসরি ধরা পড়ে ধর্মের প্রাণস্পর্শী জীবনবোধ। আবার কোনোটিতে রাজনীতির ছাপও থাকতে পারে। উৎসবের পুরনো ধারা এখন নানা বর্ণ ও বৈচিত্র্যে পূর্ণ। তবে সব অনুষ্ঠানের মূলেই রয়েছে আনন্দলাভ। কোনোটি নির্মল ইবাদতকেন্দ্রিক, কোনোটি শুধুই বস্তুবাদী।
মুসলমানদের উৎসবগুলো জীবনঘনিষ্ঠ এবং ইবাদতকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। কিন্তু কালে কালে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিও এসবের ওপর প্রভাব ফেলেছে। যেমনটি আমরা দেখতে পাচ্ছি উপরে উল্লেখিত আঞ্চলিক পর্যায়ে ঈদ উদযাপনের খবর গুলোতে।
ঈদ উৎসব বা আনন্দ এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঈদের সাথে রমজানের আত্মশুদ্ধির কথাও বলা যেতে পারে। কারণ রোজার সাথে ঈদের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ।তাতে বদল হয়েছে ধর্মের অবিমিশ্র ও শুদ্ধ রূপেরও। যে কারণে বাংলাদেশের মুসলমানের সাথে আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনচর্চা এক হলেও উৎসব অনুষ্ঠানে রকমফের সহজেই চোখে পড়ে। এর মুখ্য কারণ, পোশাক-আশাক ও খাদ্যাভ্যাসে জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বের মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। রমজান শেষে ঈদুল ফিতর পালিত হয়। ঈদের সামাজিক অর্থ উৎসব। আর আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা।
অন্যান্য সামাজিক উৎসবের মতো ঈদও বারবার ফিরে আসে। এখন ঈদের সাথে লোকজ সংস্কৃতির মেলবন্ধন স্পষ্ট। ইসলাম লোকজ উৎসব ও সংস্কৃতিকে নিরুৎসাহিত করে না। বরং বিশ্বাসের গভীরতা দিয়ে আত্মস্থ করে নেয়। তবে লোকজ উৎসব উদযাপনে পরিসীমা ও লক্ষ্য স্মরণ করিয়ে দেয়। আদি যুগে উৎসব পালনে কৃষিজীবী মানুষের লোকায়ত বিশ্বাসের প্রভাব ছিল। সেই আদি যুগেও ধর্মবিশ্বাস অনুপস্থিত ছিল না। তাই লোকজ উৎসবেও পরে কিছু ধর্মীয় রীতিনীতি যুক্ত হয়। আমাদের সমাজে বর্তমানে ঈদ উৎসব দু’টি যতটা গুরুত্বের সাথে পালিত হচ্ছে, আগে সেভাবে হতো না। কারণ তখন ঔপনিবেশিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ছিল। সে সাথে ছিল জনগণের দারিদ্র্য এবং ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা। লোকায়ত সমাজ-সংস্কৃতির সাথে একাকার করে আত্মস্থ করার জাতীয় মানসের অভাববোধের বিষয়টিও কম গৌণ ছিল না।
মুঘল যুগে ঈদের দিন যে হইচই বা আনন্দ হতো তা মুঘল ও বনেদি পরিবারের উচ্চপদস্থ এবং ধনাঢ্য মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ ছিল। তার সাথে সাধারণ মানুষের ব্যবধান না থাকলেও কিছু দূরত্ব ছিল। তাই ঈদ এ দেশে জাতীয় উৎসবে রূপান্তর হতে সময় নিয়েছে। তবে মুঘলরা যে ঈদের গুরুত্ব দিতেন তা বোঝা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় খোলামেলা গণমুখী শাহি ঈদগাহের উপস্থিতি দেখে। সুফিসাধকদের ভূমিকা ছিল এ ক্ষেত্রে আলাদা, অধিকতর গণমুখী। উনিশ শতকের শেষ দিকে ঈদের আনুষঙ্গিক আনন্দ হিসেবে যুক্ত হয় একটি নতুন উপাদান লোকজ মেলা। সে ধারা আজো কমবেশি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ঈদ আনন্দমেলার আয়োজন করা হয়। সামর্থ্যরে জোড়াতালির ভেতরও ঈদবাজার এখন অনেক বেশি জমজমাট ও উৎসবমুখর।
পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে যেসব প্রধান ধর্মীয় উৎসব উদযাপিত হয়, সেগুলোর মধ্যে ঈদুল ফিতর হচ্ছে সময়ের মাপে কনিষ্ঠতম, কিন্তু আয়োজন-প্রয়োজনে ব্যাপকতর। এই মহান ও পুণ্যময় উৎসবের উদযাপন শুরু হয় আজ থেকে ১৩৮৮ সৌর বছর আগে থেকে। ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মদিনাতে হিজরতের অব্যবহিত পরই ঈদুল ফিতর উৎসব পালন শুরু হয়। আরবদের ইহুদি ধ্যানধারণা ও জাহেলি প্রথার পরিবর্তে দুই ঈদ ছিল আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য ঘোষিত উপহার। ইসলামি আদর্শে উজ্জীবিত আরববাসী রাসূলুল্লাহ সা:-এর নির্দেশে শুরু করল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উৎসব উদযাপন। এর আগে পৌত্তলিক ভাবনায় অগ্নিপূজকদের নওরোজ এবং মূর্তিবাদীদের মিহিরজান নামে দু’টি উৎসবে মদিনাবাসী শরিক হতো। আরবরা অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ওকাজ মেলায় আদিম উচ্ছ্বলতায় মেতে উঠত। সেগুলো ছিল উচ্চবিত্তের খেয়ালিপনার উৎসব। এর পরিবর্তে জন্ম নিলো শ্রেণিবৈষম্য-বিবর্জিত, পঙ্কিলতা ও অশালীনতামুক্ত ইবাদতের আমেজমাখা সুনির্মল আনন্দে ভরা ঈদআনন্দ। আমেজের দিক থেকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ, আচরণের দিক থেকে প্রীতি ও মিলনের উৎসব ঈদুল ফিতর। ইসলামের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতরের আনুষ্ঠানিকতার দিকটি প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে ইসলাম সাম্য-মৈত্রী, শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম ও ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। জাতীয় জীবনে এর রূপময়তা সর্বত্র চোখে পড়ে। সব ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব অসাধারণ হয়ে ধরা দেয়। ভিন্ন ধর্মের মানুষও ঈদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুফল ভোগ করে। গতানুগতিক জীবনধারার অধ্যাত্মবাদের সাথে যোগ হয় প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ভিন্নমাত্রিক জীবনধারা। ঈদের আর্থসামাজিক গুরুত্বও অপরিসীম। দান-সদকা, ফিতরা এবং জাকাতদানের মাধ্যমে আমাদের সমাজে বিরাজমান দুষ্ট ক্ষতের মতো শ্রেনিবৈষম্য কিছুটা হলেও সহনীয় হয়। প্রচুর অর্থপ্রবাহ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রাচুর্য ধনতান্ত্রিক সমাজে সব শ্রেণীর মানুষকে কিছুটা হলেও সুবিধাভোগী করে।
বাংলাদেশে এ দিনটি আজকাল খুবই জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। সবাই এ দিন সাধ্যানুযায়ী ভালো পোশাক পরে। উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও এ আনন্দের অংশীদার হয়। দরিদ্র ও গরিবদের ঈদের আনন্দে শরিক করা জরুরি ভাবা হয়। মুসলমানেরা এ দিন কৃতজ্ঞচিত্তে খুতবাসহ ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। আত্মীয়স্বজনের সাথে কুশল বিনিময় করেন। পদমর্যাদা কিংবা বয়স নির্বিশেষে সবাই কোলাকুলিসহ সালাম ও শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে দেয়। আত্মীয়স্বজন ও পুণ্যবানদের কবর জিয়ারত করা হয়। বর্তমানে ঈদকার্ড বিনিময় একটি জনপ্রিয় প্রথায় পরিণত হয়েছে। নির্দিষ্ট হারে গরিবদের ফিতরা বা শর্তহীন অনুদান বিতরণ করা ধর্মীয় দিক থেকে বাধ্যতামূলক।
তাই এটি জাতীয় উৎসব। সবার উৎসব। বর্ণ-গোত্র এবং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার উৎসব। রোজা আত্মশুদ্ধির ইবাদত। আত্মত্যাগের ইবাদত। ইবাদতকেন্দ্রিক এমন উৎসবের নজির ঈদ ছাড়া আর কোনো উপমা মিলে না।
তথ্যঃ
দৈনিক কালের কন্ঠ, ০৮ আগস্ট, ২০১৩
দৈনিক প্রথম আলো, ০৮ আগস্ট, ২০১৩
দৈনিক আলোকিত চাঁদপুর, ১৮ আগস্ট, ২০১৩
দৈনিক জনকন্ঠ, ১৬ নভেম্বর ২০১০
বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডট কম
দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৫ নভেম্বর ২০১১
দৈনিক ডেসটিনি,
দৈনিক সমকাল, ১৩ আগস্ট, ২০১৩