বিদেশে পোষা কুকুর বা বিড়ালের জন্য রেস্টুরেন্টের কথা শোনা যায়। কিন্তু গরু, মহিষ ও ছাগলের আবাসিক হোটেলের কথা বোধ হয় কেউ শোনেনি। তাই গরু মহিষ ও ছাগলের আবাসিক হোটেলের কথা শুনে অনেকেই হয়তো আশ্চর্য হবেন। বেশি দূরে নয়, টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী এলাকায় গড়ে উঠেছে এই ধরনের আবাসিক হোটেল।
যমুনা সেতুর প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার দূরে গোবিন্দাসী গরুর হাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আড়াই শতাধিক আবাসিক হোটেল। এই হোটেলেগুলোর জন্যই এ হাটে নিরাপদ পরিবেশে গরু,মহিষ ও ছাগল-ভেরা বেচাকেনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অল্প সময়েই গোবিন্দাসী হাট পরিণত হয়েছে দেশের বৃহত্তম পশুর হাটে।
৬০-এর দশক থেকে যমুনার তীরে গোবিন্দাসী গ্রামে বসছে গরুর হাট। সে সময় সপ্তাহে একদিন সেখানে বেচাকেনা হতো নিত্যপণ্য ও গৃহস্থালির জিনিসপত্র। স্থানীয়রা ৭০ এর দশকে হাটটিতে অল্প পরিসরে বেচাকেনা শুরু করে গরু-ছাগল। আশির দশকের শেষভাগে যমুনার নৌপথে কিছু কিছু করে হাটে আসতে থাকে ভারতীয় গরু। দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে সহজেই এ হাটে গরু নিয়ে আসায় অল্প দিনেই পাইকারদের দৃষ্টি কাড়ে গোবিন্দাসী গরুর হাট।
নব্বই দশকে এসে জমজমাট গরুর হাটে পরিণত হয় এটি। রবি ও বৃস্পতিবার সপ্তাহে এ দু’দিন হাট বসতে থাকে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জমজমাট বেচাকেনা হলেও এ হাটে এখনও নেই সরকারী কোন অবকাঠামো সুবিধা। যমুনা সেতু কর্তৃপক্ষের অধিকৃত জমিতে গোবিন্দাসী হাটের উত্তর পাশের চরের খোলা জায়গা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে হাট। পাইকাররা শুরুতে গরু এনে হাটের আশপাশের মানুষের বাড়ির সামনে এনে জড়ো করে রাখতেন। ঝড়-বৃষ্টির সময় এসব বাড়ির গোয়াল ঘরেই জায়গা হতো পাইকারদের কিছু গরুর। আশ্রয় পেতেন পাইকাররাও। বিনিময়ে তারা বাড়ির মালিককে নামমাত্র কিছু অর্থ দিতেন।
টাকা রোজগারের এই সহজ সুযোগ ও পাইকারদের চাহিদার কারণে হাটের আশপাশের বাড়ির মালিকরা তাদের খোলা জায়গায় টিনের ছাপড়া ঘর তুলে দেয় হাটের পশুর জন্য। ভাড়ার বিনিময়ে গরু রাখা শুরু হয় সেখানে। এসব ঘরই পরিচিতি লাভ করে গরুর আবাসিক হোটেল হিসেবে। দিন দিন বাড়তে থাকে এ হোটেলের সংখ্যা। হোটেলের গন্ডি ছড়িয়ে পড়ে গোবিন্দাসীর আশপাশের খানুরবাড়ি, ভালকুটিয়া, কুকাদাইর, রাউৎবাড়ি, জিগাতলা, বাগবাড়ি, স্থলকাশি, মাটিকাটা ও চিতুলিয়াপাড়াসহ ১০/১২টি গ্রামে।
প্রতিটি হোটেলে গরু-মহিষ ধারণ ক্ষমতা ২০ থেকে তিনশটি। সেখানে মজুদ আছে খড়সহ পর্যাপ্ত পশুখাদ্য। বেশিরভাগ হোটেলের পাশেই আছে গোসলের পুকুর।
গরু পাইকাররা জানান, প্রতি হাটে শ খানেক করে গরু এনে হাটের ২/১ দিন আগে হোটেলে রাখেন। হাটের দিন গরু বিক্রি করে বিকেলে চলে যান। গরু অবিক্রিত থাকলে সেগুলো হোটেলে রেখে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারেন। ফিরিয়ে নেয়ার ঝামেলা থাকেনা। হোটেল মালিকরা সেগুলো দেখাশুনা করেন। পরের হাটে আবার অন্য গরুর সঙ্গে সেগুলো বিক্রি করতে পারেন। হোটেলে গরু রেখে পাইকাররাও মাত্র ৭০/৮০ টাকায় খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে পারেন। গরু রাখা ও পাইকারদের থাকা খাওয়ার এতো সুন্দর ব্যবস্থা দেশের অন্য কোন গরুর হাটে নেই। রাত যাপনকালে গরু বিক্রির টাকা হোটেল মালিকের কাছে নিরাপদ গচ্ছিত রাখা যায়।
গরু রাখার ভাড়া টাকার বাইরেও হোটেল মালিকদের বাড়তি আয় হয় গরুর গোবর থেকে। গোবর থেকে জৈব সার ও ঘুটে তৈরী করে এ বাড়তি আয় করেন তারা।
প্রশাসন, হাট কমিটি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের তৎপরতার কারণে হাটে চুরি, ডাকাতি নেই বললেই চলে। বছরে ইজারা বাবদ এ হাট থেকে সরকার দুই কোটি ৬৫ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করছে। এই আয় বাড়াতে ও দেশের বৃহত্তম এ হাটের খ্যাতি ধরে রাখতে সর্বস্তরের মানুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত এ হাটে সরকারিভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি।