সেই মেয়েটি । পাহাড়ের কাছেই একটা বাংলোতে থাকত সে, বাবা-মা’র সাথে । আর দশটা অষ্টাদশী তরুণীর চেয়ে, ও তেমন আলাদা ছিল না । পাখির মত ছুটে বেড়াত সারাদিন । সারা পাহাড় ঘুরে ঘুরে প্রজাপতি ধরার চেষ্টা চালাত । বুনো ফুল ছিঁড়ে চুলের খোঁপায় বেঁধে রাখতো । ক্লান্ত দুপুরে সবাই যখন পরিশ্রমে শ্রান্ত, মেয়েটি তখন শরৎচন্দ্রের দেবদাস পড়ে পড়ে চোখের জলে বালিশ ভেজাত । আর দশটা মেয়ের মত এই মেয়েটিও ভাবত, একদিন তার স্বপ্নের রাজপুত্র এসে তার হাত ধরে বলবে “ভালোবাসি”। আর সে কথা ভেবে ভেবে লজ্জায় লাল হত মেয়েটা, আপনমনে ।
মেয়েটির বাবার বন বিভাগে চাকরীর সূত্রে প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল । শহুরে মেয়েদের মত অত সুযোগ-সুবিধে হয়ত পায় নি সে । কিন্তু প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে পেরেছিল মেয়েটি । কোন বৃষ্টিস্নাত সকালে মেয়েটি স্নান করত উন্মত্ত বর্ষার জলে ভিজে ভিজে । ভরা পূর্ণিমার আলো গায়ে মাখে সে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে । বাবা-মা দুজনেই চাকুরীজীবী হওয়ায় এবং তাদের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় ওর সঙ্গী বলতেও তেমন কেউ ছিল না । প্রকৃতির সাথে তার সখ্যতার শুরু এভাবেই ।
মেয়েটি ভালোবাসতো ভোরের পবিত্র বাতাস, ভালোবাসতো মেঘের গুরু-গম্ভীর শব্দ, ভালোবাসতো বিকেলের গোধূলির রঙ, ভালোবাসতো পূর্ণিমার রাতের হিমেল হাওয়ায় হঠাৎ হঠাৎ পাতার মড়মড় শব্দে চমকে ওঠা অনুভূতি ।
তবে, একদিন এই মেয়েটিই এমন এক অনুভূতির মুখোমুখি হয়, যা আগে কখনও টের পায়নি সে । অচেনা এক ভয় মেশানো আনন্দ যেন ঘিরে রাখতে শুরু করে মেয়েটাকে...............
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
ছেলেটি । সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছেলেটির বেড়ে ওঠা শহরে । ইট-কাঠ-পাথরের জীবন ছেড়ে ছেলেটি প্রায়ই চাইতো প্রকৃতির মুক্ত-বিশুদ্ধ হাওয়া গা এ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতে । তাই সে প্রায়ই ছুটে যেত- বনের কাছে, নদীর কাছে, সমুদ্রের কাছে, পাহাড়ের কাছে । তবে একদিন সেই ছেলেটির যাযাবর জীবনে লাগাম টেনে ধরতে হয় ।
বন্ধুদের সাথে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে গিয়ে ছেলেটি থমকে দাঁড়ায় । পিছনে তাকায় । আর বন্দি হয় এক মায়ার আঁচলে । যে মায়া সে প্রত্যাখ্যান করতে পারে নি বা বলা যায়, চায় নি । সে বন্দি হয়, মানব-মানবীর এক পবিত্র ভালবাসার বন্ধনে । প্রকৃতি যেন নিজ হাতে বানিয়েছিল সেই পাহাড়ি কন্যাটিকে । ছেলেটি অবাক চোখে দেখত মেয়েটির ভুবন-ভুলানো হাসি মাখা মুখ, মেয়েটির অবাক চোখ, কথা বলতে বলতে মেয়েটির হঠাৎ থেমে যাওয়া । এ সবই ছেলেটিকে আকর্ষণ করে । ছেলেটি যেন, নিজের মাঝে আবিষ্কার করে এক নতুন পুরুষকে । যা আগে কখনও হয়নি, তা-ই শুরু হয় তার মাঝে ।
প্রকৃতি যেন মুচকি হাসে এই দু’জনকে দেখে । শুরু হয় এক নতুন অধ্যায় ।
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
“ভালোবাসি” কথাটি বলা ছাড়াও যে ভালোবাসা যায়, সেটা প্রথম বুঝেছিল এই ছেলে-মেয়ে দুটি, নিজেদের দেখে । মেয়েটি পেয়েছিল তার বৃষ্টিতে ভেজার এক সঙ্গীকে, আবিষ্কার করেছিল ভরা পূর্ণিমার রাতে কারো হাতে হাত রেখে চোখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য ভাষা ।
আর ছেলেটি পেয়েছিল তার আজন্ম খুঁজে বেড়ানো মানব রুপী অপ্সরীকে । প্রকৃতি যাকে নিজ হাতে বানিয়েছেন । যার চোখের দিকে তাকিয়ে সে কাটিয়ে দিতে পারত দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ।
একটা মেয়ে তার ভালবাসার মানুষটির কাছ থেকে কি-ই বা চাইতে পারে ? একটুখানি নিরাপত্তা, ভরসা, ভালবাসার অকৃত্রিম প্রতিশ্রুতি । বা কবি আবুল হাসানের কবিতার মত,
“একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনি, চেয়েছিল
একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!”
ছেলেটি তার সবই করেছিল । ছেলেটি বলত, মেয়েটিকে বিয়ের সময় সে লাল বেনারসি দিবে,পায়ে রুপার নূপুর,আর হাতে লাল-সাদা কাঁচের চুড়ি । মেয়েটি এসব শুনে লজ্জায় লাল হত । মুখে কিছু বলত না । আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল তারা, একে অপরকে । ভালবাসা বুঝি এমনই হয় ।
তবে একদিন... ! ঝড় উঠে সমুদ্রে, যার আঁচ পড়ে পাহাড় আর মেঘের গল্পেও । শুরু হয়, গল্পটির শেষের প্রারম্ভিকা ।
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
সেদিন ছিল ছেলেটির জন্মদিন । মেয়েটিকে লাল শাড়ি পরে আসতে বলে ছেলেটি । আর মেয়েটির জন্যে অনেকগুলো কদম ফুল হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে ছেলেটি । সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়, আস্তে আস্তে বিকেলও হয় । মেয়েটি তবু আসে না । শেষ বিকেলের গোধূলির আগুনে লাল রঙ গায়ে মেখে ছেলেটি যায়, মেয়েটির খোঁজে ।
মেয়েটি তখন কাঁদছিল । ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ওর বাগদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় সেদিন । মেয়েটিকে দেখতে এসে ছেলেটি হতভম্ব হয়ে যায় । দৌড়ে কাছে যেতে চায় মেয়েটির । কিন্তু তাকে যেতে দেওয়া হয় না । মেয়েটির মা চোখে অশ্রুজল নিয়ে ছেলেটির কাছে অনুরোধ করে, যাতে সে মেয়েটির বিয়েতে বাঁধা না দেয় ।
ছেলেটি পড়ে যায় দ্বিধায় । একদিকে তার আজন্ম লালিত ভালবাসার মানুষটি । অন্যদিকে, একজন মায়ের চোখের জল । ... ভেবেচিন্তে ছেলেটি নিজের ভালবাসার মানুষটিকে মুক্ত করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । হাসিমুখে শেষ বিদায় জানায় সে মেয়েটিকে । তারপর ফিরে যেতে থাকে আপনালয়ে ।
পাহাড়ি রাস্তাটির ধারে সেদিন অনেক গুলো কদম ফুল পরে থাকতে দেখা যায় । কেউ জানতো না, ফুলগুলোর পাপড়ির উপরে থাকা বৃষ্টির জলের সাথে মিশে ছিল একজন প্রেমিকের চোখের অশ্রু । পুরো পাহাড় যেন শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সেদিন । প্রকৃতিতে নেমে এসেছিল অদ্ভুত এক নীরবতা ।
----------------------------------------------------------------------------------------------
মেয়েটির বিয়েতে একটি উপহারের বাক্স আসে, নাম-ঠিকানা-হীন । তাতে ছিল: একটি লাল বেনারসি, এক জোড়া রুপার নূপুর আর লাল-সাদা রঙ এর অনেকগুলো কাঁচের চুড়ি ।
মেয়েটি তার জন্য আনা বিয়ের শাড়ি ছেড়ে, পরে সেই লাল বেনারসিটি । হাতের স্বর্ণের চুড়ি খুলে ফেলে পরে, সেই লাল-সাদা কাঁচের চুড়ি গুলো । চুড়িগুলোর টুং টাং শব্দে মুগ্ধ চোখে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়েটি । পায়ে দেয় রুপার নূপুর । রিনিঝিনি শব্দটা যেন, বৃষ্টির শব্দের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় মেয়েটিকে । আয়নাতে নিজেকে দেখে অবাক হয়ে যায় মেয়েটি । এ যেন অন্য জগতের এক বাসিন্দা !
মেয়েটি তার ভালবাসার মানুষটির কথামত সাজে । এক অজানা,অচেনা মানুষের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে । কিন্তু, সেদিন মেয়েটি কাঁদে নি । যখন মেয়েটিকে কাজী বলছিলেন, ‘কবুল’ বলতে, মেয়েটি বিনা বাক্যব্যয়ে বিয়েতে সম্মতি দেয় । তখনও সে কাঁদে নি । তবে সেদিনের পর তাকে আর কেউ হাসতেও দেখে নি । রক্তে-মাংসে গড়া এক যন্ত্রদানব এ পরিণত হয় যেন, সে ।
তারপর ? তারপর দিন কাটে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস । দুইটি বছর পেরিয়ে যায় এভাবেই ।
ছেলেটি তার কথা রেখেছিল ভালোমতোই । মেয়েটির বিয়ের দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী দু’বছরে একবারের জন্যও সে আসেনি মেয়েটির সাথে দেখা করতে । এমনকি কোনোরকম যোগাযোগও করে নি । মেয়েটি ভুলেনি তার ভালোবাসাকে, ভুলেনি তার স্বপ্ন-পুরুষকে ।
ঠিক দু বছর পর মেয়েটির দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকীতে একটি চিঠি আসে মেয়েটির নামে । উল্টে-পাল্টে প্রেরকের কোন নাম খুঁজে পায় না সে । পুরো চিঠি জুড়ে একটি কবিতা । মেয়েটি কবিতাটি পড়তে শুরু করে ।
“আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি ভালবেসেছিল মেঘকে
আর মেঘ...
কি ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে,
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা !
সে তো আগেই শুনেছ।
সেদিন ছিল পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘ কে বললে,
“আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।”
মেঘ পাহাড়কে বললে,
“আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।”
ভালবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী,
পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের
আলিঙ্গনের আগুনে
পাহাড় ছিল মেঘের ঢেউ-জলে।
হঠাৎ...
আকাশ জুড়ে বেজে উঠল ঝড়ের জগঝম্প
ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাইয়ের ভঙ্গিতে ছুটে এল
এক ঝাঁক হাওয়া।
মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে,
“ওঠ ছুড়ি ! তোর বিয়ে।
এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেল ঠিকই
কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিনই ভুলতে পারল না।
বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতে পারো,
পাহাড়টার হাড় পাঁজর।
ভিতরে থৈ থৈ করছে,
শত ঝর্ণার জল।”
মেয়েটি চিঠিটি রেখে জানালা দিয়ে দূর পাহাড়ের দিকে তাকায় । খুব বৃষ্টি হচ্ছে । মেয়েটির আজ খুব কান্না পাচ্ছে । দুইটি বছর ধরে চেপে রাখা কষ্ট গুলো আজ তার দু’চোখ দিয়ে উপচে পড়তে চাইছে । মেয়েটির চোখের অশ্রুর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে বাইরের বারিধারা । মেয়েটির খুব ইচ্ছে হচ্ছে, বৃষ্টির জল হয়ে পাহাড়ের বুকে মিশে যেতে । খুব ইচ্ছে হচ্ছে তার । খুউউউব । মেয়েটির মনের কথা বুঝতে পেরেই হয়তো বৃষ্টির জলধারার গতি আরও বেড়ে যায় ।
আজও মেঘে মেঘে ঘর্ষণ হয় । বৃষ্টি পড়ে । পাহাড় ও মেঘের গল্পের দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘায়িত হয় ।