জোছনার সাইরেন’র ফাইনাল প্রুফ দেখার সময় গোটা ডজন ভুল পেলাম। বছর খানেক আগে একবার প্রুফ দেখেছিলাম। এবার যখন প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠালাম, তখন আরেকবার প্রুফ দেখানো হয়েছিল। এরপরও বানান ভুল! যেমন 'গাভি' শব্দটি ভুল। সঠিক গাভী। তবে গাভিন বা গাভীন একটা দিলে চলে। পাণ্ডুলিপিতে ছিল গাভি। একটা কবিতায় ছিল 'জোসনা'। অথচ বইয়ের নামে আছে জোছনা। আত্মা শব্দের ত্ম ভেঙে গিয়েছিল। দেখে তো আমার আত্মাই শুকিয়ে গেছে।
এসব দেখছিলাম, আর সত্যজিৎ রায়র কথা ভাবছিলাম।
তিনি বই প্রকাশের ব্যাপারে ছিলেন একেবারে খুঁতখুঁতে। বইয়ের আকার কী হবে, প্রচ্ছদ, কোন ফন্ট, ফন্টের সাইজ, কোথায় কতো পয়েন্ট সব হিসেব করে দিতেন। এমনকি কোন কাগজে ভেতরের পাতা ও কোন কাগজে প্রচ্ছদ ছাপা হবে তাও ঠিক করে দিতেন। ফাইনাল প্রুফ তাকে দেখানো ছাড়া বই প্রেসে দেওয়াই যেতোনা।
এই লেখা যখন লিখছি, তখন হঠাৎ স্টিফেন হকিংর কথা মনে পড়ে গেল। তাঁর A Brief History of Time বইয়ের প্রকাশক ব্যান্টাম Random House । এই প্রকাশনায় পিটার গুজার্ডি নামে একজন সম্পাদক ছিলেন। তিনিই হকিংয়ের বই সম্পাদনার দ্বায়িত্বে ছিলেন।
গুজার্ডি বইটা দ্বিতীয়বার লেখার জন্য হকিংয়ের কাছে ফেরত পাঠান। হকিং তখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত, নিজে নিজে কোনো কিছু করার ক্ষমতা হারিয়েছেন। এর আগে থেকে তিনি জটিল এএলএস রোগে আক্রান্ত। একটা কম্পিউটারের প্রোগ্রামের সাহায্যে তিনি দ্বিতীয়বার পাণ্ডুলিপি লিখে পাঠান। এরপর প্রত্যেকটা অধ্যায় ধরে ধরে গুজার্ডি একগাদা প্রশ্নসহ পাণ্ডুলিপি পাঠাতেন। আর হকিং সেগুলো ঠিক করে দিতেন। হকিং লিখেছেন, 'এক এক সময় মনে হয়েছে এ পদ্ধতি আর কোনওদিন শেষ হবে না। কিন্তু কাজটা তিনি ঠিকই করেছিলেন।; এর ফলে বইটা অনেক ভাল হয়েছে।'
আমি ভাবছি, আমাদের দেশে এমন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে কবে? যারা পাণ্ডুলিপির সঙ্গে আপত্তির একটা বিশাল তালিকা লেখককে ধরিয়ে দেবেন। সে হোক কবিতার বই, গল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধ।
এমন যে না, হকিং লেখালেখিতে নতুন ছিলেন। ততদিনে তাঁর কয়েকটা বই Oxford Academic (Oxford University Press) থেকে বেরিয়েছে। কিন্তু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের আপত্তিকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। এর পর তো সব A Brief History of Time'র ইতিহাস।
বই প্রকাশ করতে গিয়ে বেশ অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আমাদের দেশে মানসম্পন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের তীব্র অভাব রয়েছে। দুএকজন লেখক যারা লিখছেন, ফেসভেল্যুতে। কিন্তু একটা বই দেশের বাইরে ভেল্যু তৈরি করতে পারতেছে না।
কিছু প্রকাশক দেখি, অফসেট পেপারে বই ছাপেন। কারো কারো সম্পাদনা বোর্ডও আছে। এটা ভালো। তবে সবচেয়ে জরুরি নির্ভুল বই উপহার দেওয়া। তারও চেয়ে জরুরি একটা বই নির্মাণ করা।
এটা প্রথমে ফেসবুক (১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬) লেখা
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৫