আজ গায়ে ভীষণ জ্বর। গতকাল ছিল হালকা জ্বর। গতকাল ওষুদ খাইনি। আজ খেলাম। খাওয়ার পরই ভাবলাম, দেশটাও তো ভীষণ জ্বরে ভুগছে। তারও তো ওষুদ দরকার। কে তাকে ওষুদ খাওয়াবে? এটা ভেবে আমার জ্বর আরো বাড়ছে।
সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বেড়ে গেলে কর্তৃপক্ষ নিধন কর্মসূচি গ্রহণ করে। লোহার ইয়া বড় বড় হাতল দিয়ে আটকিয়ে কুকুরের শরীরে বিশাল ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়। মিনিট কয়েকের মধ্যেই কুকুর নিস্তেজ হয়ে যায়। সে দৃশ্য যে ভয়ানক, রোমহর্ষক, অমানবিক তা ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষের লোকজন যখন কুকুরকে ধাওয়া করে তখন কুকুরগুলো বাঁচার জন্য কি চেষ্টাটাই না করে! অলি-গলি, ঘরের আড়াল, কোনা-কাঞ্ছি, এমনকি পুকুরেও ঝাপিয়ে পড়ে। আর চলে অবিরাম ঘেউ ঘেউ। সে শব্দ শুনলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। পশু বলে কি সে মানুষের কাছে মানবিক আচরণ আশা করতে পারে না? বেওয়ারিশ বলেই কি তার এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নাই? কুকুর নিধনের অনুমতি মানুষকে কে দিয়েছে? এটা নিয়ে কি বিকল্প ভাবা যায়না?
ছোটো বেলায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রে দেশপ্রেম রচনা পড়ে দেশপ্রেম শিখেছিলাম। গালভরা বুলি ও টাচি কবিতার লাইন থাকলে তাতে নম্বর বেশি মেলে এটা সবাই জানে। তারপরও কিন্তু সবাই বেশি নম্বর পেতো না। কেউ কেউ ফেলও করতো। যারা দেশপ্রেম রচনা লিখে ফেল করবে, তাদের জন্য কি বেওয়ারিশ কুকুরের মতো নিধন কর্মসূচি নেওয়া হবে?
আমি যত দূর জানি, কওমি মাদরাসার সিলেবাসে বাংলা দ্বিতীয় পত্র বিষয়টিই নাই। এজন্য কারা দায়ী? তারাতো দেশপ্রেম রচনা পড়ে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়ে দুর্নীতির সুযোগ পায় না। তারা মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, কওমি মাদরাসার শিক্ষক, প্রিন্সিপাল আর চতুরতা জানলে বড় জোর ব্যবসায়ী হওয়ার সুযোগ পায়। রাজনীতি করলেও তারা মূলধারার রাজনীতিবিদদের মতো কর্পোরেট হাউজ, ব্যাংক বা গার্মেন্টস মালিক হয়ে সরকারি প্লট দখল করতে পারে না। গ্রামের বখাটে ছেলেটাও আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে দুই-চার শ টাকা পায়। কিন্তু এরা সেই সুযোগটাও পায় না পোষাক-সুরতের কারণে। ধনাঢ্য ব্যক্তি মারা গেলে বা অসুস্থ হলে ধর্মীয় কাজ করে যা পায় তাতে পালিয়ে বড় জোর একবার সিনেমা হলে যাওয়া যায়। বাংলা সিনেমা দেখে সুবিধাপ্রাপ্তরাই ধর্ষ-মর্ষকাম শেখে। এইসব বঞ্চিতরা কি সেখান থেকে প্রগতিশীলতা শিখবে? এদের কাছে সেটা আশা করা বাতুলতা।
সম্প্রতি মিয়ানমারের যে গ্রামটিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হলো, সেখানে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বক্তৃতায় বলে আসছেন, বৌদ্ধরা শান্ত-অহিংস। এর সুবিধা নিচ্ছে মুসলমানরা। তারা দিন দিন সংখ্যায় বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসা, পরিবহণ সব ক্ষেত্রে তারা দখল নিয়ে যাচ্ছে। বৌদ্ধদের উচিত মুসলামানদের দোকান থেকে কোনো কিছু না কেনা। তাদের মালিকানাধীন গাড়িতে না চড়া। মুসলমানদের হত্যা করাই তাদের ধর্মীয় কর্তব্য। দীর্ঘ দিন ধরে শান্ত বৌদ্ধরা তা শুনে আসছে, এতোদিন কিছু হয়নি। হঠাৎ সেদিন মুসলমান মালিকানাধীন স্বর্ণের দোকানে এক বৌদ্ধ ক্রেতা এসে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথাকাটাকাটি হলো। একপর্যায়ে বেঁধে গেল সংঘর্ষ। আশপাশ এলাকা থেকে হাজার হাজার বৌদ্ধ এসে পুলিশের উপস্থিতিতে মুসলমান এলাকায় আগুন লাগিয়ে দিল। স্কুলে গিয়ে মুসলমান ছেলে-মেয়েদের পিটিয়ে-ঝুলিয়ে হত্যা করা হলো। নারীরাও রক্ষা পেল না।
বৌদ্ধরা অহিংস। কিন্তু একটা মতবাদে বিশ্বাসী। যে কোনো বিশ্বাস বা চিন্তা মুহূর্তে সহিংস হতে পারে। সহিংস হলেই তা চরমপন্থা অবলম্বন করে। চরমপন্থী মাত্রই আত্মঘাতী।
ধর্ম যেমন একটা বিশ্বাস, রাজনীতিও তেমনি একটা বিশ্বাস। বিশ্বাসের সঙ্গে যখন ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, অস্তিত্বের প্রশ্ন আসে তখনই তা সহিংস রূপ ধারণ করে। ইসলামিজম-মার্ক্সিজম যেমন বাইরের তৈরি, আওয়ামী লীগ-বিএনপি তেমনি দেশের তৈরি। ক্ষমতা দখলের ভিন্ন কৌশলমাত্র।
বিএনপি-জামায়াতের বোতলে হেফাজতের লংমার্চের বিপরীতে মঞ্চ-বামের বোতলে আওয়ামী লীগের হরতাল। এ দু’টোই চরমপন্থা। আমি এ দু’টোকেই ঘৃণা করি। এ দু’টোই আত্মঘাতী ও সহিংস। আশ্বিনের বেওয়ারিশ কুকুরের মতোই নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। বরং সুচেতনার জন্য কুকুরের চেয়ে সহিংস মানুষ বেশি ক্ষতিকর।
কিন্তু আমি কুকুর নিধন কর্মসূচিকে সমর্থন করিনা।