somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বন্ধুর বউ

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১০:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি রুহুলের বউ।- কথাটা শুনে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম। আর্তস্বরে বললাম, রু-হু-লে-র বউ। ভদ্র মহিলা বললেন- হ্যা। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, এই মুহূর্তে কি করা উচিৎ। অফিস শেষ করে বাসায় ঢুকবো। জোয়ার সাহারার ৬ তলা বিল্ডিংয়ে অনেক পরিবারই থাকে। দরজায়, সিঁড়িতে, গেটে অনেক মহিলাই দাঁড়িয়ে থাকেন। কারো দিকে কখনো চোখ যায়, কখনো যায় না। কেউ কখনো কোনো কথা বলেনি। ফ্ল্যাট কালচারটাই এমন। এই মহিলা যে এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। দারোয়ান বোধহয় ঘুমাচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলে রুহুলের বউকে দেখে এক ধরনের ভালোলাগা কাজ করছিল। যেখানে ভালোলাগার মতো কিছু আজকাল খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। সামান্য একটা কথায় মনটা খুশিতে ভরে গেল। পরিচয়হীন এই শহরে আমি যেন পরম আত্মীয় পেয়ে গেলাম। দীর্ঘ দিন দেখা না হলেও যে সম্পর্কে এতোটুকু চির ধরে না সে হলো বন্ধুত্ব।

রুহুল বিয়ে করলো কবে? সে এখন কোথায়? বউটা এখানে কেন? এতগুলো প্রশ্ন একবারে মাথায় এলো। কিন্তু বললাম, আপনি কোথায় থাকেন?
মহিলা বললেন, পাঁচ তলায়।
আমিও পাঁচ তলায় থাকি।
আমি জানি। আপনাকে দেখেছি।
আমাকে চিনলেন কি করে?
বাসাওয়ালার টেবিলে আপনার ভিজিটিং কার্ড দেখে। পরে বাসাওয়ালার বউয়ের কাছ থেকে আপনার সম্পর্কে জেনেছি। দারোয়ানের কাছ থেকে আপনার সম্পর্কে যা জেনেছি, তা রুহুলের কথার সঙ্গে মিলে গেছে।
এই হলো রুহুলের বউয়ের সঙ্গে আমার পরিচয়। নাম রুনা। বয়স ত্রিশের নিচে। হালকা পাতলা গড়ন। কোমড় পর্যন্ত চুল। গায়ের রং হলুদ হলুদ। আমি বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে তারপর ওনার বাসায় গেলাম। দামি সোফা, বাহারি শোপিস দেখে আমি অবাক। এতো অভিজাত জীবন-যাপন। ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ পর নুডুলস এনে দিলেন। খেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। সত্যি বলতে কি, অফিস থেকে বেরোনোর পর কিছুটা ক্ষিধে পেয়েছিল। খাওয়ার পর ভালো লাগলো। নানান কথা হচ্ছে, কিন্তু ভদ্র মহিলা রুহুল সম্পর্কে কিছু বলছেন না। আমি ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, রুহুল কোথায়?

হঠাৎ কাউকে থাপ্পর দিলে যেমন মুখ শুকিয়ে যায়, মহিলার মুখটা তেমন হয়ে গেল। কণ্ঠটা ভারি হয়ে গেল। মুহূর্তে তার চোখ জলে ভরে গেল। তিনি যা বললেন তার সারমর্ম হলো, রুহুল মালয়েশিয়া গিয়ে এমবিএ করে। সেখান থেকে যায় সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরে বছর খানেক থাকার পর আমেরিকা। আমেরিকায় একটা বুক শপে সেলসম্যানের কাজ করতো। এক রাতে বাসায় ফেরার পথে সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে মেরে ফেলে। রুনা বলছিলেন আর তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। প্রায় তিন বছর আগে রুহুল মারা গেছে। কিন্তু তিনি আর বিয়ে করেননি। দুইটা মেয়ে আছে। তাদের নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে চান। উত্তরায় বাবা-মা থাকেন। তিনি আলাদা থাকেন। একটা চাকরি করেন। তিনি রুকু-রুপু বলে ডাক দিলেন। দুইটি বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে দুই পাশে বসে পড়লো। আমি অবাক। রুপু মানে ছোটো মেয়েটি দেখতে অবিকল রুহুলের মতো। রুপুকে দেখে আমার কান্না পেল। রুপুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে গিয়ে আমি কেঁদে ফেললাম। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। অনেক দিন পর যেন আমি আমার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরার আনন্দ পেলাম। রুপু হাত দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিল। আমার মনটা খুশিতে ভরে গেল। রুপু আমাকে জিজ্ঞেস করলো, বাবাকে কি তুমি লাইক করতে? আমি বললাম, হ্যা। ও বললো, আমিও লাইক করি। কিন্তু বাবাটা যে কি, একটা ফোনও দেয় না।

সত্যি বলতে কি রুহুলের বউয়ের সঙ্গে পরিচয়ের আগ পর্যন্ত বড্ড একঘেয়ে জীবন ছিল। কোনো কাজই ভালো লাগতো না। রুকু-রুপু যখন এসে আমার হাত ধরে, জগতের সব মন্দ লাগা দূর হয়ে যায়। আমি ফিরে যাই শৈশবে। মনে হয় রুহুলের হাত ধরে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। ছোটো বেলা থেকেই ঘরকুনে স্বভাবের ছিলাম। আশপাশের গ্রামগুলোও চিনতাম না। রুহুল আমাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে হাঁটতে বের হতো। বিকেল বেলা বের হয়ে আমরা একেকদিন একেকটা গ্রাম দেখতে যেতাম। ক্ষিদ্রমাটিয়া নামে এক গ্রাম আছে। লোকজন বলে খিদিরমাইট্যা। এই গ্রামটার পাশ দিয়ে বইছে যমুনা নদী। এক বিকেলে নদীর পার দিয়ে হাঁটছি। পাশে গম ক্ষেত। আমাদের মনে হল, কেউ একজন দূর থেকে চিকন গলায় কিছু বলছে। রুহুল ওই কথাটি প্রতিধ্বনি করলো। আবার একই গলা শোনা গেল। এভাবে অনেকক্ষণ চলার পর আমরা বিষ্মিত এবং কিছুটা ভয়ও পেয়েছিলাম। কারণ তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। কিছুক্ষণ পর একটা গম ক্ষেত থেকে একটা ছাগলের বাচ্চা বের হয়ে এলো। ছাগলটা পথ হারিয়ে করুণ সুরে হয়তো মাকে ডাকছিল। আমরা এটা দেখে সেদিন ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। এভাবে রুহুলের সাথে আমি মেঘুল্লা, শেরনগর (শের মানে বাঘ, এইগ্রামে একটাও বাঘ নাই), চন্দনগাঁতী (একটাও চন্দন গাছ দেখি নাই), চালা, দেলুয়া এইসব গ্রাম ঘুরে দেখতাম। গ্রামগুলোর নাম যে কিভাবে হলো তা নিয়ে আমরা ভাবতাম। কিন্তু কোনো মানে খুঁজে পেতাম না। তবে ওইসব এলাকা একসময় ঘন জঙ্গল ছিল এটা আমরা মুরুব্বিদের কাছে শুনেছি। কিন্তু এখন বাড়ি-ঘর আর মানুষে ভরে গেছে।

এই হলো আমার বন্ধু রুহুল। আমরা একই স্কুলে পড়েছি। ও এসএসসি পরীক্ষার পর ঢাকায় এলো। ওর বাবা-মা আগে থেকেই ঢাকায় থাকতো। আমি গ্রামেই থেকে গেলাম। তারপর থেকে তেমন দেখা-সাক্ষাৎ নাই।

সত্যি বলতে কি, রুহুলের পরিবারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা দিন দিন বেড়ে যেতে থাকলো। ইদানিং আমি রান্না করিনা। রুপু-রুকুদের সাথে খাই। ওদের সাথে থাকলে এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে অন্য ফ্লাটের বাসিন্দারা উদ্বিগ্ন। তার বাসায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকার বিষয়টা আমার কাছেও ভাবলে দৃষ্টিকটু মনে হয়। কিন্তু আমি দুই বাচ্চার ভালো-মন্দ অনুভূতির সাথে জড়িয়ে গেছি। রুহুলের বউ ক্রমে আমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। বিভিন্ন বিষয়ে আমার মতামত নিয়ে কাজ করেন। বলা যায়, আমরা বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম।

প্রচন্ড শীত শুরু হলো। শীতে টানা কয়েকদিন সূর্যের দেখা নাই। রুপুর খুব ঠান্ডা-জর। ঠান্ডায় নাক বন্ধ। শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। গলায়ও কফ জমে গেছে। আমি সারা রাত রুপুর মাথা কোলে নিয়ে বসে আছি। রুনার বাবা-মা এসেছেন। তারাও উদ্বিগ্ন। গভীর রাতে জর আরো বেড়ে গেল। আমি, রুনা রুপুকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। কিন্তু রুপুকে ফেরানো গেলনা। নিউমোনিয়া হয়েছিল আগেই। আমরা কেউই বুঝতে পারিনি।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×