গুলশান এলাকায় বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকার মনু মিয়া। নিচতলায় গ্যারেজের পাশে ছোটো একটা রুমে তার বসবাস। গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু আলো-বাতাসের বড্ড অভাব। ঘরে কোনো জানালা নাই। সামনে বারান্দার মতো যাতায়াতের জন্য জায়গা রাখা হয়েছে। সেটাও ওয়াল দিয়ে ঘেরা। তাই সরাসরি বাইরের আলো-বাতাস ঢুকতে পারেনা। থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা নাই মনু মিয়ার। চাকরিতেও কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু তার মন ভালো নাই। তিন মাস হলো ঢাকায় এসেছে। মন ধীরে ধীরে বিষিয়ে উঠছে। কোনো কাজই তার ভাল্লাগে না। অল্পতেই রাগ হয়। যমুনা নদীর চরে জন্ম নেওয়া, বেড়ে ওঠা মনু মিয়া স্রোত দেখতে না পেয়ে অস্থির হয়ে গেছে।
তার মনে বারবার ভেসে উঠছে সেই স্রোতের দৃশ্য। প্রতিদিন গোসল করা, গরু-ছাগল ঝাপানো, কাপড় পরিষ্কার সব কাজ হতো নদীতে। বিকেলে হাঁটতে গেলে নদীর পাড়ে। গ্রামের বাইরে বেরোলেই নদীপথে যেতে হতো। তাই নদীর স্রোতের সঙ্গে একরকম ছুটে চলাই ছিল তার জীবন। নিজের কয়েক শতক জমি ছিল। আর কিছু ছিল বর্গাজমি। এসব চাষ করা আর দু’একটা ছেলে-মেয়ে পড়ানো। এই ছিল তার কাজ। সে কখনো ভাবতেই পারে নি এসব থেকে তাকে দূরে কোথাও যেতে হবে। এসএসসি পাশ করার পর তার আর লেখাপড়া হয়নি। অভাবের সংসারে বাবা খরচ জোগাতে পারতেন না। তাই কলেজে ভর্তিটাও হতে পারেনি। তার স্কুলের এক বন্ধু আজ বড় ইঞ্জিনিয়ার। রিয়ালএস্টেট কোম্পানিতে চাকরি করে। এই বিল্ডিংটা সেই ডিজাইন করেছে। সেই বন্ধু এই চাকরিটা জোগার করে দিয়েছে। যমুনা সেতু হওয়ার পর ভেবেছিল চর বোধহয় আর ভাঙবেনা। কিন্তু ঠিকই ভাঙলো। এবং শেষবার ভাঙার পর তার আর কিছু থাকলো না। এর আগে ৪ বার তাদের বাড়ি ভেঙেছে। হাতে কোনো নগদ টাকাও ছিলনা। বউটাকে শশুর বাড়ি রেখে সে চলে এলো ঢাকায়। ঢাকায় এলো কিন্তু তার মন পড়ে রইলো সোহাগপুরের চরে।
পাশেই গুলশান লেক। মনু মিয়া বিকেলে মাঝেমধ্যে লেকে যায়। লেকের পাড়ের গাছগাছালি দেখলে তার কিছুটা ভালো লাগে। কিন্তু নদীর ঠান্ডা বাতাস কোথায় পাাবে? স্রোত কোথায় পাবে? স্রোত না দেখে দেখে মনে হয়, সে মারা যাচ্ছে। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারে না। সারাদিন অস্বস্তি কাজ করে। কোনো কিছুতেই সে আনন্দ পাচ্ছে না। শহরটা দিন দিন তার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে।
ছোটোবেলায় সে বইয়ে পড়েছে, ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। কিন্তু বুড়িগঙ্গার কথা কেউ বলতে পারে না। সবাই বলে, বুড়িগঙ্গা মইরা গ্যাছে। তারপরও ঠিকানা যোগার করে অনেক কষ্টে সময় বের করল। বুড়িগঙ্গা দেখার জন্য সে রওনা দিল সদরঘাটে। সদরঘাটে পৌঁছতে পৌঁছতে তার জীবনের দফা রফা হয়ে গেল। যানজট, ভীর আর গরমে সে অতিষ্ঠ। সদরঘাটে এসে নদীর যে রূপ দেখল তাতে একে মরা খাল ছাড়া আর কিছু বলা যায়না। সারি সারি লঞ্চ-স্টিমার, ছোটো-বড় নৌকা দাঁড়িয়ে আছে। পানির রঙ একেবারে কালো। প্রচন্ড দুর্গন্ধ। পানিতে হালকা স্রোত আছে। কিন্তু এসব দেখে মনু মিয়ার কান্না পেল। সে নদীর পাড় ধরে কিছুক্ষণ হাঁটলো। কোথাও পচা ফলের গন্ধ, কোথাও পচা তরকারির গন্ধ, কোথাও ডাস্টবিনের ময়লার গন্ধে তার বমি চাপলো। সে হেঁটে হেঁটে সোওয়ারি ঘাটে চলে এলো। সোওয়ারি ঘাটে মাছের গন্ধে সে বমি করে ফেললো। কষ্টে সে কেঁদে ফেললো। শব্দ ছাড়া কান্নায় কষ্ট বেশি, এজন্য বোধহয় নারীরা শব্দ করে কাঁদে। মনু মিয়া রাস্তার একপাশে নীরবে বসে ছিল। আর তার দু’চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। বুকটা তার কষ্টে হুহু করছে। স্বচ্ছ পানির একটা স্রোত তার চোখ দিয়েই বইছে কিন্তু মনু মিয়া সেটা দেখতে পাচ্ছেনা।
মনু মিয়ার নদী দেখা হলো না। সে প্রায় সিদ্ধান্তই নিয়েছে এ শহরে তার আর থাকা হবে না। যে শহরে নদী নাই সে শহরে সে থাকবে কি করে? নদী ছাড়া সে কোথাও বাঁচতে পারবে না। তার বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি গার্ড নাজমুল। নাজমুল একদিন তাকে বললো, পাশেই একখান নদী ছিল। কিন্তু নদীটা এখন দখল হয়া গেছে। রিয়ালএস্টেট কোম্পানিগুলা নদী ভরাট কইরা বিল্ডিং বানাইছে। সেখানে তাগো কোটি কোটি টাকার বিজনেস। তয় নদীটার শেষ মাথায় খালের মতো কিছু অংশ থাকতে পারে। সেইহানে স্রোত থাকলেও থাকতে পারে।
নাজমুলের কাছে ঠিকানা নিয়ে এক ছুটির দিনে মনু মিয়া স্রোত দেখার জন্য বের হলো। বসুন্ধরায় একটা এলাকা আছে ঘাটপাড় নামে। এখানে এসে শব্দটা শুনেই মনু মিয়া চমকে উঠলো। ঘাটপাড়! কিন্তু এখানে যে শুধু বিল্ডিং। সে খুঁজে খুঁজে ঘাটপাড়ে গেল। সে নিশ্চিত এখানে নদীর ঘাট ছিল। কয়েকজন বুড়োকে জিজ্ঞেস করে সে জানলো, ৩০ থেকে ৪০ বছর আগেও এটা নদী ছিল। যাক, একটা নদীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এখানে একটা নদী ছিল, এটাই বা কম কিসে! খুঁজলে নিশ্চয়ই নদীটা পাওয়া যাবে। ঘাটপাড়ে বসে মনুমিয়া নদীর ঢেউ-স্রোতের কথা কল্পনা করছিল।
সে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো তিন শ ফুট রাস্তায়। এই রাস্তার কাজ সবে শুরু হয়েছে। খোয়া এখনও ফেলা হয় নাই। কিছু আগানোর পর দেখা গেল পাশে একটা বড় খাল। হয়তো এখানেই খুব স্রোত ছিল। কল্পনায় মনু মিয়া মৃত নদীর স্রোত দেখলো। দেখলো বড় বড় ঢেউ। সে রাস্তায় হাঁটছে আর ভাবছে। পাশের বসুন্ধরা এলাকা। কি করে মানুষ একটা নদীকে মেরে ফেলে! নদীর বুকে বড় বিল্ডিং, নানা জাতের গাছ-গাছালি, কিছু এলাকা একদম ফাঁকা। জায়গায় জায়গায় সিকিউরিটি গার্ড। অনেক দূর চলে যাওয়ার পর সে আর সামনে কোনো মানুষ দেখতে পেল না। ভয় পেল। এমন দৃশ্য ঢাকায় আসার পর সে দেখেনি। মানুষের এই শহরে হাঁটার জায়গা পাওয়া যায় না। অথচ এখানে যে পর্যন্ত দেখা যায় তাতে কোনো মানুষকে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক দূরে একটা সড়ক। সড়কে গাড়ি চলছে। খালের মধ্যে কিছু ড্রেজার মেশিন, কোথাও কোথাও জাল পাতা আছে। কিন্তু কোনো মানুষ নেই। প্রচন্ড রোদ, অন্যদিকে বাতাস। হুহু বাতাসে ভয়ে মনু মিয়ার গলা শুকিয়ে এলো। সে কি ফেরত যাবে? এমনটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। হালকা বৃষ্টি। বৃষ্টির পানি সে হা করে মুখের মধ্যে নিল। কিন্তু বৃষ্টির বেগ এতো কম যে, মুখে কেবল ঠান্ডা ছোঁয়া পেল। গিলে খাওয়ার মতো কোনো পানি পেল না। আরো হাঁটার পর সে কিছু মানুষ দেখল। যারা একটা ব্রিজ বানাচ্ছে। ডুমনি খালের নির্মিত ব্রিজের পাশ দিয়ে সে হেঁটে গেল। খালের মধ্যে ব্রিজ বানানোর জন্য দুই পাশে ভরাট করা হয়েছে। তাই যেখানে স্রোত থাকার কথা সেখানে দেখা গেল চকচকে বালু। অনেকটা মুসা নবীর নীলনদ পার হওয়ার মতো, দুই পাশে অজস্র জলধারা মাঝে শুকনা রাস্তা। সে রাস্তা পার হয়ে বড় সড়কে এসে উঠলো। এই সড়কে রূপগঞ্জে যাওয়া যায়। সড়কে একটু হাঁটতেই পুলিশের চেকপোস্ট। চেকপোস্ট দেখে মনু মিয়া ভরকে গেল। ভাবলো, সে পেছন ফিরবে কিনা। কিন্তু পেছন ফিরলে তো কিছু দেখা যাবেনা। এতোদিন কষ্ট করে যে ছুটি নিয়েছে তা গোল্লায় যাবে। সে সাহস করে এগিয়ে গেল। ডানে-বামে না তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। নাহ, এক পুলিশ তার দিকে একবার তাকিয়েছিল। বাকিরা অন্যকাজে ব্যস্ত। পুলিশের তাকানোর ভঙ্গিটা ছিল সন্দেহজনক। তবে মনু মিয়া তার দিকে না তাকিয়ে সোজা সামনের দিকে হেঁটেছে। ব্যস, পুলিশ তাকে কিছুই বললো না।
মনু মিয়া হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো ডুমনি ব্রিজের উপর। ব্রিজটা এতো উঁচু, ভাবাই যায়না। ব্রিজের উপর উঠতে ভয় লাগে। এর উপর উঠে সে দাঁড়াল কিছুক্ষণ। চারপাশে তাকালে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। সে দেখল ডুমনি খাল অনেকটাই বেদখল হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে হয়তো এখানে ব্রিজটাই থাকবেনা। কারণ, খাল না থাকলে ব্রিজের দরকার নাই। এভাবে হেঁটে হেঁটে ডুমনি বাজার পার হয়ে সে একসময় ইছাপুরে চলে এলো। ইছাপুর বেইলি ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই মনু মিয়ার মনটা আনন্দে ভরে গেল। দূর থেকেই সে নদীর ঠান্ডা বাতাস পেল। ঠান্ডা বাতাস দূর থেকেই মনু মিয়াকে বুঝিয়ে দিল আশপাশে নদীতে স্রোত আছে। সেই বাতাস পেয়ে মুহূর্তে মনু মিয়ার মন আনন্দে ভরে উঠলো। সে দৌড়ে ব্রিজের ওপর গিয়ে দাঁড়াল। ব্রিজের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালো। সত্যিই অদ্ভুদ এক ভালো লাগা তার সারা শরীরে বয়ে গেল। স্রোত দেখে তার প্রচন্ড ঘুম পেল। ব্রিজের ওপর একের পর এক প্রাইভেট কার, ট্রাক, টেম্পু, রিক্সা, ভ্যান যাচ্ছে মনু মিয়ার কোনো দিকে খেয়াল নাই। সে দৌড়ে নিচে নেমে এলো। ব্রিজের নিচে নদীর কাছে এসে সে একমুঠ পানি তুললো হাত দিয়ে। পানির ছোঁয়া পেয়ে মনু মিয়ার সারা শরীরে কাঁপুনি এলো। মুহূর্তে মনু মিয়া ফিরে গেল যমুনা নদীতে। যে নদী তার সবচেয়ে বড় শত্রু। জীবনের সব সম্পদ গ্রাস করেছে। একের পর এক বসতি ভেঙেছে। সেই রাক্ষসী যমুনার জলই যেন তার হাতের মুঠোয় এসেছে। কিন্তু তারপরও নদীই যেন তার সব। নদী ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। এসব ভাবতে ভাবতে কখন হাতের মুঠ থেকে পানি পড়ে গেছে সে তা বুঝতেই পারলো না।
আবার দৌড়ে সে চলে এলো ব্রিজের ওপর। তার পাশে একজন লোক যাচ্ছিল, সে তাকে জিজ্ঞেস করলো, এই নদীর নাম কি? বালু নদী। লোকটা চলে গেল। মনু মিয়া বালু নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে নিজের ছায়া খুঁজতে লাগলো। কিন্তু ঘোলা পানিতে নিজের ছায়া সে দেখতে পারলো না।