নাবিলাকে যখন প্রথম বার দেখি তখন আমার বয়স সম্ভবত ন`বছর।
ফর্সা টুকটুকে ডল পুতুলের মত একটা মেয়েকে নিয়ে একজন মহিলা আমার মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে, মেয়েটার হাতে একটা পুতুল, ভিষন ছটফটে, আর সারাক্ষন যেন মুখদিয়ে কথার খই ফুটিয়ে চলেছে।
আমাকে দেখে মুখটা কেমন বেকিয়ে বলল "এ মা তুমি কি কালো ! "
আমার মেজাজ খুব খারাপ হলেও বোকার মত হেসেছিলাম শুধু।
নাবিলার সাথে সেই থেকে পরিচয়, শুধু তার সাথেই নয় তার পরিবারের সাথেও।
আব্বাস আংকেলের (নাবিলার বাবা) বদলীর চাকরি সেই সুবাদে রাজবাড়ী আসা এবং আমাদের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকায় আমরা প্রতিবেশী হয়ে গেলাম।
অন্যান্য আট দশ জন প্রতিবেশির চেয়ে বোধ হয় আমদের সাথে নাবিলাদের পরিবারের ঘনিষ্টতা একটু বেশিই ছিল। আমার বাবা আর আব্বাস আংকেল প্রতিদিন বিকেলে দাবা খেলতে বসতেন।আম্মু আর আন্টির মাঝেও ছিল ভিষণ সদ্ভাব।
সময়ের স্রোতে আমরা এক সময় বড় হয়ে উঠলাম একদিন হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমি নাবিলাকে ভিষন ভালোবাসি।আর সেটা একদমই ওয়ান সাইড। এও বুঝতে পারলাম সেই ভালোবাসা বোথ সাইড হবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই।
নাবিলার মত ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়েকে ভালোবাসার নূন্যতম যোগ্যতাও আমার কোন দিক দিয়ে নেই। কুচকুচে কালো রোগা একটা ছেলেকে সে কোন দুঃখে ভালো বাসতে যাবে।
ছোট্ট বেলা থেকে গড়ে ওঠা একটা সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে আমার ভালো লাগার ব্যাপারটা কখনও তার কাছে প্রকাশ করি নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে জীবনে প্রথম বারের মত বাড়ী ছাড়লাম।মনের মাঝে মা বাবা ছাড়াও নিয়ে গেলাম নাবিলাকে।
ক্রমে ক্রমে আমার মানসিক অবস্থা খারাপ হতে থাকলো, না পারতাম তাকে বলতে না পারতাম সইতে, পড়াশোনা মোটেও হচ্ছিলো না।নিজের যত্ন নিতাম না ঠিকমত, সব সময় নাবিলার কথা ভাবতাম।
যখন তাকে দেখতে ইচ্ছা হতো বাড়ী চলে যেতাম।
অব্যাক্ত কথা চেপে রাখার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ক্লাসমেট বন্ধুকে বলালাম সব।
আমার এই অবস্থা শুনে ক্লাসমেট বন্ধুটি এমন একটা ভাব করল যেন এটা কোন ঘটনাই না।
বৃদ্ধ আংগুল আর মধ্যমার সাহায্যে তুড়ি বাজিয়ে বলল "মাগরীবের নামাজের পরে চলে আয় আমাদের মহল্লার মসজিদে সেখান থেকে তোর সমস্যার সমাধান করে দিব"।
ভরসা পাচ্ছিলাম না তবু দেখি কি হয় ভেবে গেলাম। নামাজ শেষে বন্ধুটি আমাজে নিয়ে গেল হুজুরের কাছে।
সব শুনে হুজুর কিছুক্ষন গম্ভীর হয়ে থেকে বললেন "জ্বীন হাসিল করতে হবে"।
বাপরে বলে কি জ্বীন ভূত থেকে একশো হাত পারলে আরো দূ চার হাত বেশি দুরে থাকলে বাঁচি। সেখানে কিনা সেঁধে ডেকে আনতে হবে।
ডুবে যাওয়া মানুষ খড় কুটো ধরে বাচতে চায় আমার অবস্থাও তাই শুতরাং হুজুরের শেখানো পথে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
কাজটা হলো ঘরের সব আলো নিভিয়ে পবিত্র কাপড়ে তাহাজ্জতের নামাজের পর যায়নামাজে বসে সুরা জ্বীন পড়তে হবে। সাত দিনের মাঝে জ্বীন আসবে যাকে দিয়ে যে কোন কাজ করিয়ে নেয়া যাবে।
মেসে একা থাকতাম সুতরাং কোন সমস্যা হলোনা, তাহাজ্জতের নামাজ শেষ করে সুরা জ্বীন পড়ে ফেললাম।
কয়েকদিন কেটে গেল একই ভাবে ষষ্ট দিন ব্যাতিক্রম হলো অন্য দিনের মত নামাজ শেষ করে সুরা পড়া শুরু করার কিছুক্ষনের মধ্যেই মনে হলো বাইরে যে ঝি ঝি পোকাটা এতক্ষন ডাকছিল সেটা থেমে গেল, কেমন নিস্তব্ধ হয়ে এল চারপাশ।
রাতের এই প্রহরটা এমনিতেই নিস্তব্ধ থাকে তবে আজ যেন একটু বেশি। আমার সুরা পড়া থেমে নেই হঠাৎ প্রচন্ড এক দমকা বাতাস আমার কক্ষের জানালাকে (যার কপাট দু`টো ছিল ভেতরের দিকে আমার পড়ার টেবিল দিয়ে সেটা স্থা্য়ী ভাবে আটকে দেয়া ছিল) এত জোরে আঘাত করলো যে একগাদা বই সহ টেবিলটা ছিটকে পড়লো।
রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে শব্দটাও হলো ভয়াবহ, শুনতে পেলাম আমার পাশের রুমের ছেলেরা দরজায় টোকা দিচ্ছে।
দরজা খুলতে জানতে চাইলো কি হয়েছে?
উল্টা আমি ওদের কে প্রশ্ন করলাম বাইরে ঝড় হচ্ছে কি না?
কই নাতো সমস্বরে বলল ওরা। মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে ওরা। আলো জ্বলছে ওল্টানো টেবিল আর ঘর ভর্তি এলোমেলো বই দেখে হয়তো পাগল ভাবছে ওরা আমাকে।
একজন একটু এগিয়ে এসে বলল "আপনার রুম থেকে কেমন একটা সুগন্ধ আসছে আতরের গন্ধের মত "।
গন্ধটা আমিও পাচ্ছিলাম তবু চোখ মুখ শক্ত করে বললাম "কই আমিতো পাচ্ছিনা"।
ওরা চলে গেল। আলো জ্বালানো অবস্থাতেও কেমন ভয় ভয় করছিলো। মনে হচ্ছিলো রুমে কেও একজন আছে।
বলা বাহুল্য সেই অদ্ভূত ঘটনার পর আমার জ্বীন সাধনার ইতি ঘটেছিল।
অফটপিকঃ লেখাটা প্রায় শেষ করে ফেলেছি এমন সময় নাবিলা পিছন থেকে আমার কাধে হাত রেখে বলল "এই ভর সন্ধায় কম্পিউটার নিয়ে বসছো"?
"এইতো একটু বাংলা টাইপিং প্রাকটিস করছিলাম" বললাম আমি।এখন ই উঠে পড়বো।
বোকা মেয়ে একটু খেয়াল করলেই জেনে ফেলতে পারতো তাকে নিয়ে আমার হাজার খানে পাগলামীর মধ্যে আরো একটা।
সুন্দরীরা বোধহয় একটু বোকাই হয়। তবে বউ হিসেবে ভালো হয়।
ভৌতিক অভিজ্ঞতা-১
ভৌতিক অভিজ্ঞতা-২
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৯:০১