ভৌতিক অভিজ্ঞতা-১
রাত ন`টা।
সাভার বাসস্ট্যান্ডে শ্যামলী বাস কাউন্টারে বসে আছি বাসের অপেক্ষায়, গন্তব্য কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়ি। হঠাৎ পাওয়া চার দিনের ছুটিটা গ্রামের বাড়ি কাটাবার ইচ্ছা।
রাতের বাসে দুরে যাত্রার ক্ষেত্রে সব সময় শেষ গাড়িটাতে উঠার চেষ্টা করি, তাতে লাভ হলো বাস মাঝ রাতে আপনাকে গন্তব্যে নামিয়ে দিবেনা, পৌছতে পৌছতে সকাল হয়ে যাবে।
আমার গাড়ি ছাড়বে রাত ১১.৪৫ মিনিটে, কাল পরশু বিরোধী দলের টানা হরতাল তাই ঝুকি না নিয়ে অনেক আগেই চলে এসেছি বাস কাউন্টারে।
কাউন্টারের দায়িক্তে থাকা লোকটা ঘন ঘন মোবাইলে কথা বলছে, তার কথায় যতটা বোঝা যাচ্ছে রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম তাই বাসের সিডিউলে মারাত্বক সমস্যা হচ্ছে, ৭টার বাস এখনও ঢাকা্ ছাড়েনি ।
বাড়ি যাওয়াটা জরুরী এবং আগামী কাল হরতালে শুরু, আজ না যেতে পারলে আর যাওয়া হবেনা সেটা বুঝিয়ে বললাম তাকে, মুখভর্তি পান চিবুতে চিবুতে বলল "দেখতাছি আপনার লাইগা কি করতে পারি"।
শেষ পর্যন্ত রাত ১০টায় আমাকে উঠিয়ে দিল কুষ্টিয়াগামী একটা বাসে, বাধ্য হয়ে দুই ঘন্টা আগেই রওনা হলাম, মাঝ রাতে পৌছব এটা নিশ্চিত ছিলাম।
হলোও তাই, বাস যখন কুষ্টিয়ার মজমপুর স্ট্যান্ডে আমাদের নামিয়ে দিল ঘড়ির কাটায় তখন সমান সমান রাত ২.০০ টা।
বেশ ঘন কুয়াশার কারনে কোন কিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছেনা, দোকান পাট প্রায় সবই বন্ধ, একটা চায়ের দোকান খোলা পেয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিলাম।
গ্রামের বাড়ি আরও ১১ কিঃমিঃ দুরে।শহরে তেমন কোন আত্বীয় ও নেই যে রাত টা কাটিয়ে দিব। বাকি কয়েকটা ঘন্টা রাস্তার পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাটিয়ে দেব কিনা ভাবছি এমন সময় এক অটোওয়ালা কে দেখতে পেলাম, কুয়াশা ফুড়ে উদয় হয়েছে।
এত রাতে কোথা থেকে আসলো বুঝলাম না। আমার ঠিক সামনে এসে দাড়িয়ে অটোর ড্রাইভার জানতে চাইলো কোথায় যাবো।
একটু অস্বাভাবিক লাগছিল, গন্তব্য বললাম, ভাড়া চাইলো দুশো টাকা, ভাড়াটা বড় কথা নয় মনটা সায় দিচ্ছিল না তাই চুপ করে ছিলাম, হঠাৎ আমার পিছন থেকে এক ভদ্র লোক বলে উঠলেন আমি ও ঐদিকেই যাবো দু`জন হলে মন্দ হবেনা ভাড়ার অর্ধেক আমি দিয়ে দেব।
ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আর না বলতে পারলাম না। অটোতে উঠে বসলাম দু`জন।
কুয়াশার ভেতর দিয়ে ব্যাটারি চালিত অটো প্রায় নিঃশব্দে চলতে অরম্ভ করলো। ভদ্রলোক আমার ঠিক আগের গ্রামে নেমে পড়লেন, সামনের ফাকা মাঠটা পেরোলেই আমাদের গ্রাম। সমস্যা হলো পিচের রাস্তা থেকে মাটির রাস্তা শুরু হয়েছে এখান থেকেই সেটার আবার চরম খারাপ, ভাঙাচুরা, কোথাও বড় বড় গর্ত, এমনই এক গর্তের ভেতরে পড়ে ঘট ঘটাং শব্দ করে অটোটা এক পাশে কাত হয়ে থেমে গেল, তড়িঘড়ি করে নেমে পড়লাম।
আটো চালক তার মোবাইলের টর্চ দিয়ে চাকার অবস্থা দেখে শুনে বলল ''স্যার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে, আর যাবে না।
কম দামের এসব ফালতু অটো কেনার জন্য চালক কে তিরস্কার করতে করতে হাটতে আরম্ভ করলাম।
দিগন্ত জোড়া মাঠের মাঝ দিয়ে রাস্তাটা গেছে কোন গাছ পালা নেই তাই রাস্তাটাকে কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া মনে হয়, সামনে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলে মাঠের জমে যাওয়া বৃষ্টির পানি বের করে দেবার জন্য বিশাল বড় একটা ড্রেনেজ ক্যানেল যেটা আবার কয়েক কিলো সামনে যেয়ে মিলেছে একটা বিলের সাথে।
একটা সময় ছিলো আমরা প্রায়ই মাছ ধরতে আসতাম এই ক্যানেলে, প্রচুর মাছ পাওয়া যেত।
যাহোক মাঠটা পেরনোর সময় খেয়াল করলাম কুয়াশাটা কেমন যেন কমতে আরম্ভ করেছে চার পাশটা বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, রিস্টওয়াচ বলছে রাত ২.৫০ অর্থাৎ যথেষ্ট রাত বাকি।
ক্যানেলের পাড়টা বেশ চওড়া ১৫/২০ ফুট লম্বা হবে এমন কিছু তাল গাছ আছে, কয়েক বছর আগে লাগানো, এই তাল গাছের কাছে আসতেই হঠাৎ করে ৬ষ্ট ইন্দ্রিয় সতর্ক হয়ে উঠলো, কেমন একটা কোলাহলের শব্দ কানে এল, মনে হলো বেশ কয়েকজন একসাথে কথা বলছে।
ছোট বেলা থেকেই এই যায়গাটা সম্পর্ক অনেক ভয়ের গল্প শুনেছি। এত রাতে লোকজনের কথা বলার শব্দে তাই আমার সাহস বেড়ে যাবার বদলে কমে গেল। বিষয়টা কি দেখার জন্য সামনে এগিয়ে গেলাম।তাল গাছের ফাক দিয়ে উকি দিয়ে দেখলাম ১০/১২ জন লোক একজন কে পেটাচ্ছে, যাকে পেটাচ্ছে তার মুখ বাধা তাই তার মুখ দিয়ে শুধু গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হচ্ছে।
ভালো করে খেয়াল করতেই ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল, এদের সবার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, তার মানে সবাই চরমপন্থি, কসাইয়ের মত নির্দয় এরা, মানুষ খুন এদের কাছে খেলার মত।হেটে আতিক্রম করতে গেলে দেখে ফেলবে তাই তালগাছটার আড়াল নেয়াটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হলো।
গাছের আড়াল থেকে লক্ষ করলাম লোকটাকে এবার হাতমোড়া করে বাধা হলো, তিনজন নেতা গোছের একজন সাথে দু`জন কে নিয়ে সামনে এগিয়ে আসছে ঠিক আমি যে গাছটার আড়ালে আছি সে বরাবার, এবার নির্ঘাৎ আমাকে দেখে ফেলবে, নিজেকে হাতমোড়া করে বাধা লোকটার পাশে যেন দেখতে পাচ্ছি নিজেকে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
আমার ঠিক হাত দু`য়েক সামনে থামলো তিন জন, তাদের কথা শুনে শিউরে উঠলাম, তাদের প্রতিপক্ষের একজন কে ধরে নিয়ে এসেছে, তাকে কিভাবে খুন করা যায় সেটা নিয়ে আলাপ হচ্ছে, একজন বলল '' গুলি করেন''।
নেতা গোছের লোকটা তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল, তার বক্তব্য হচ্ছে গুলি করলে শব্দ হবে তাছা্ড়া শুধু শুধু গুলি অপচয় করা ঠিক হবেনা তাই ঠিক হল জবাই করা হবে।
দলের তৃতীয় ব্যাক্তিটি এবার বলে উঠলো ''ওস্তাদ ছুরিটাতে ধার নাই এটা দিয়ে ক্যামনে কাম সারবো''।
নেতা গোছের লোকটা তাকে অভয় দিল কাজটা সে নিজে হাতে করবে।
তাদের এই চরম মধ্যযুগীয় কথার শুনতে শুনতে হঠাৎ তিন জন ব্যাক্তিকেই আমি চিনতে পারলাম।
নেতা গোছের লোকটর নাম কদর আলী, ডাকনাম কটা এলাকার চরম আতংকের নাম এই কটা, এহেন অপকর্ম নাই যা সে করেনি।
২য় লোকটার নাম ইজ্জত ৩য় লোকটা কুদ্দুস। ইজ্জতের হাতে সব সময়ের জন্য একটা নাইন এম এম পিস্তল থাকে এইতো দেখতে পাচ্ছি বাম হাত দিয়ে অবহেলায় ধরে আছে।
ঠিক এসময়ে আমি সত্যিকার ভয় পেলাম, এই তিন জনই তো র্যাবের ক্রসফায়ারে মারা গেছে ৭/৮ বছর আগে।
কদর আলী মারা যাবার দিন আমি গ্রামে ছিলাম সকাল ৬টার দিকে হঠাৎ ৬/৭ টা গুলির শব্দে লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলাম, ১০ মিনিট পরে জানতে পেরেছিলাম কদর আলী শেষ। কলা বাগানে পড়ে আছে কদর আলী, মৃত।
একে ৪৭ এর দুটো গুলী তার বুকে লেগেছে একটা গুলী তার কাধের এক খাবলা মাংস উড়িয়ে নিয়ে গেছে, হাত দুয়েক দুরে পড়ে আছে তার প্রিয় ফাইভস্টার।
কিন্ত আজ তারা এখানে কিভাবে আসলো? লোকটাকে ধরে এনেছে কোথা থেকে?
এসব যখন ভাবছি ততক্ষনে লোকটাকে খুন করে ফেলে ক্যানেলের উপরের ব্রিজ দিয়ে চলে গেল তারা আমার উল্টো দিক দিয়ে।
আমি একটু এগিয়ে গেলাম লোকটার দিকে, পা দু`টা ভাজ হয়ে আছে মাথাটা ডান দিকে ঘুরানো চোখ দু`টা খোলা হাতে ঘড়ি, গলার কাছ থেকে রক্তের একটা রেখা, কিছুটা দেখতে পারছি কিছুটা অনুমান করছি কারন এই দৃষ্যটা আমার দেখা আজ থেকে ৯ বছর আগের তবে এখনও মনে আছে স্পষ্ট, খুন হওয়া লোকটাকে সকালে আর সবার সাথে আমিও দেখতে এসেছিলাম।
৯ বছর আগের সেই ঘটনার পুনারাবৃত্তী ঘটলো আমার চোখের সামনে।
কেন ঘটলো, সেটা আমার সাথে কেন আমি আজও সেই প্রশ্নের উত্তর পাইনি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:১৩