আমাদের দেশের ক্ষুদ্রঋণ এখন সারাবিশ্বেই মডেল হিসেবে স্বীকৃত। এরপরও এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি পাল্টা যুক্তির কমতি নেই। থাকবেই বা না কেনো? ক্ষুদ্রঋণের ধকলে অনেকেই দিশেহারা হয়ে পড়ছে, অনেকে আত্মহত্যার মতো ভুল পথেও পা বাড়াচ্ছে। এরকম খবর মাঝে মাঝেই পত্রপত্রিকায় ঠাঁই পাচ্ছে। গতকালও দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার একটি শিরোনাম ছিলো ‘চড়া সুদে ঋণের পাহাড়, অসংখ্য পাওনাদারের উৎপাতে বাড়ি ছাড়া দুটি পরিবার।’ একটি ঋণ নিয়ে সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পেরে একের পর এক ঋণের বোঝা বাড়িয়ে যখন দিশেহারা তখন উপায় না পেয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে শিশু-সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে দুটি পরিবার নিরুদ্দেশ। খবরটি বিবেকবানদের নিশ্চয় মাথা নিচু করিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে।
ক্ষুদ্রঋণ কেনো সারাবিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পেলো? সোজা সাপটা জবাব- কোনো প্রকারের জামানত ছাড়াই একজন দরিদ্রকে ঋণ দেয়া হয়। ঋণের টাকা খাটিয়ে যে আয় করবে তা থেকে সপ্তায় বা মাসে মাসে কিস্তির মাধ্যমে তা পরিশোধ করবে। ধনীদের জামানত দেয়ার মতো জমি থাকে, থাকে সম্পদ। দরিদ্রদের তা থাকে না। পরিশ্রম করে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর স্বপ্ন সামান্য পুঁজির কারণে বাস্তবে রূপ পায় না। এ কারণেই ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আর এর কুফল? ঋণের বোঝা বাড়িয়ে ফেলে দিশেহারা হয়ে আত্মঘাতী হওয়া বা পালিয়ে বেড়ানো। এ জন্য দায় অবশ্যই ঋণগ্রহীতা একার নয়, ঋণদাতা বা সংস্থার নিযুক্ত প্রতিনিধির ওপরও বর্তায়। কেনোনা, যে ব্যক্তিকে ঋণ দেয়া হলো সে ওই অর্থ দিয়ে কী করছে, কেনো সে কিস্তি দিতে পারছে না, তা যেমন দেখার দায়িত্ব রয়েছে, তেমনই দায়িত্ব রয়েছে অন্য সংস্থার নিকট দায়গ্রস্ত কি-না। এসব দেখভালের জন্যই তো সার্ভিস চার্জের নামে চড়া সুদ আদায় করা হয়। ঋণ দিতে হবে, ভালোয় ভালোয় আদায় করতে হবে, আদায় না হলে অন্য কারো কাছ থেকে চড়া সুদে ধারকর্জ করে ঋণ শোধ করলে আরও অনেক টাকার ঋণ করিয়ে দেবো বলে লোভ দেখানো হলে ঋণগ্রস্তের দায় যে বাড়তেই থাকবে তা বলাই বাহুল্য। নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না যে, ক্ষুদ্রঋণের পাহাড় তখনই গড়ে ওঠে যখন ঋণদাতা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের উদাসীনতা চরমে পৌঁছায়। ঋণের বোঝা বেড়ে যায়, পাওনাদার সকাল-বিকেল বাড়িতে হাজির হয়ে মান-অপমানের কথা বলে। দিশেহারা হয়ে পড়েন দায়গ্রস্ত ব্যক্তি ও তার পরিবার।
আর্থিক সচ্ছলতার পথ দেখাতে গিয়ে দায়গ্রস্ত করে তোলা নিশ্চয় ক্ষুদ্রঋণ দাতা সংস্থাগুলোর লক্ষ্য নয়। অবশ্যই ঋণ নিয়ে কেউ বা কোনো পরিবার অপদস্ত হোক তাও সংশ্লিষ্টরা কামনা করেন না। এরপরও কেনো হচ্ছে, কেনো ঘটছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। ঋণ দিয়ে কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে অনেকের ঘরের টিন খুলে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। এসব নিশ্চয় কাম্য নয়। ক্ষুদ্রঋণ হোক দারিদ্র্যতা বিমোচনের সহায়ক। ঋণের বোঝা চাপানোর আগে অবশ্যই ঋণদাতা সংস্থাসমূহের প্রতিনিধিদের সজাগ ও দায়িত্বশীল হতে হবে। এছাড়া গ্রাম-গঞ্জে যারা চড়া সুদে টাকার ব্যবসা করে তাদেরও মুখোশ খুলে শাস্তির আওতায় নিতে হবে। সেই দাদন প্রথার মতো চড়া সুদে টাকা কর্জদান প্রথা অব্যাহত থাকলে সমাজ যে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে না তা সকলকেই উপলব্ধি করতে হবে।