...একদিন বাবার রুমের জানালা খুলে দেখলাম, বরাবর অপর পাশে আরো একটি জানালা রয়েছে। সেই জানালার পাশে বসে খোলা চুলে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে এক কিশোরী। তার কোকড়ানো চুলগুলো এলোমেলভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো পিঠজুড়ে।
দুই বাড়ির মাঝখানের সীমানা-দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা ক্বচি কাঠাল গাছটির ডাল আর পাতার ফাঁক-ফোকর গলে আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকলো সেই জানালাটির দিকে। সেই পিঠজুড়ে লেপ্টে থাকা চুলগুলো দিকে...। দুই জানালার দূরত্ব বড় জোর ছ-ফিট।
বেশ কিছু সময় বিহ্বলের ন্যায় অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। ফর্সা কোমল পা-দুটিতে আলতার মতো কিছু একটা মাখানো ছিল বোধহয়। ভাবলাম, ''এই'' বলে ডাক দেই একবার। সাহসে কুলালো না।
মা কে বললাম, ''আমি এখন থেকে তোমাদের রুমের বিছানায় বসেই পড়বো, ঐ রুমে আমার খুব ডিস্টার্ব হয়, সামনে আমার পরীক্ষা পড়ায় মন বসাতে পারি না একদম।''
দুই রুমের বাসা আমাদের। এক রুমে বাবা-মা থাকতেন। আরেক রুমে আমরা চার ভাইবোন। গ্রাম থেকে আসা আত্মীয়-স্বজন। ছোট্ট একটা কাজের মেয়ে। সব একসাথে থাকতাম।
মা বললেন, ''আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু ঐ জানালা খুলবি না কোনদিন।''
মাথা নেড়ে বললাম, ''আচ্ছা ঠিক আছে, এই যে দেখ, জানালা বন্ধ করে দিলাম। দরজাটাও বন্ধ করে বসবো কিন্তু মা। ওপাশ থেকে সাউন্ড আসে খুব।''
রুমের দরজা বন্ধ করে আস্ত করে জানালাটা খুলে দিলাম আবার। বই নিয়ে বসে পড়লাম জানালার পাশে। মাথা দুলিয়ে জোরে জোরে ইংরেজি পড়তে লাগলাম। একটাই উদ্দেশ্য- দেখ আমি ইংরেজি কতো ভালো পারি! .... হঠাৎ চোখ তুলে দেখি, অপর পাশের জানালা থেকে কিশোরী আমার দিকে চেয়ে আছে। চোখে মুখে ক্রদ্ধ দৃষ্টি তার। দাঁত কড়মড় করছে। সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে।
.. এক নজর তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলাম।
আজ থেকে ২০ বছর আগের গল্প...। এর পর থেকেই বুকের ভেতর কেমন যেন করতে লাগলো। একদিন দেখলাম, অপর পাশের জানালাটা বন্ধ হয়ে আছে। কিছুতেই খুলছে না আর। খাঁটের উপর দাঁড়িয়ে জানালার গ্রিলের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারণ ছাড়াই দু'চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
এভাবেই কাটতে লাগলো দিন। সে সময় আমাদের বয়সের ছেলে-মেয়েরা বিকেলে পাড়ার রাস্তায় হাঁটতে বেরুতো সবাই। বিকেলে হাঁটতে গিয়ে কখনো চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামিয়ে নিতাম। কোন এক অজানা ভয়ে চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না কিছুতেই।
...মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুল-ভ্যানটি বিকেলের দিকে ফিরে আসতো। বৃষ্টিতে রাস্তায় একহাঁটু পানি জমে আছে। সেই হাঁটু অবধি পানির ভেতর দাঁড়িয়ে আছি একদিন। প্যান্টের পকেটে দু'হাত ঢুকিয়ে ভ্যান আসার অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছি।
..সেদিন সে ভ্যানের ভেতর থেকে একজোড়া চোখ। একজোড়া মায়াবী চোখ আমার চোখের দিকে তাকাতেই রাজ্যের সব কষ্ট বৃষ্টিজলে ভেসে গেল যেন। সেই প্রথম ঠোঁটের কোণে মিষ্টি একটুকরো হাসি দেখতে পেলাম তার।
..... আজ থেকে সতের বছর আগে আমরা সেই এলাকা ছেড়ে অনেক দূরে চলে আসি।.... কলেজে ওঠার পর একদিন গিয়ে ছিলাম। ভাবলাম, এবার হয়তো সাহস করতে পারবো। এলাকার মুদি দোকানি রাজু ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ''ওরা তো এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। তবে কোথায় গেছে জানি না।''
কোথাও আর ঠিকানা খুঁজে পেলাম না..। তবে এখনো মাঝে মাঝে রাতে সময় পেলে সেই বাড়িটির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। দেয়ালটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি।.... হাস্যকর বটে।... যাহা প্রথম তাহা সব দিক থেকেই প্রথম।
আমার প্রায় লেখাতেই সেই নামটি ব্যবহার করি। দুই অক্ষরের ছোট্ট মধুর একটি নাম।.... একদিন একজন জানতে চেয়েছিল, কেন এ নামটি আমি বেশি ব্যবহার করি। জবাবে বলেছিলাম, ''জানি নাহ।''
প্রতিদিন চলার পথে কতো মানুষের সাথে আমার দেখা হয়। গত সতের বছরে একটি বারো ওর সাথে দেখা হলো নাহ। হলেও চোখে চোখ রাখতে পারবো কি-না জানি নাহ। তবুও চাই, দেখা হোক একদিন..... আমার ফ্রেন্ডস ফলোয়াদের বলছি, সত্যি একটি বারের জন্য ওকে দেখতে চাই আমি.... আমার কথা হয়তো ওর মনে নেই্। চিনতেও পারবে না হয়তো। তবুও চাই, দেখা হোক একদিন...
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৭