কাসিদা
হযরত শেখ সাদী
বালাগাল উলা বি কামালিহী,
কাশাফাদ দুজা বি জামালিহী।
হাছুনাত জামিউ খেছোয়ালিহি,
ছল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী।
অনুপম চরিত্রের পরিপূর্ণতায় সম্মানের উচুঁ আসনে তিনি উপনীত হয়েছেন এবং তাঁর সৌন্দর্যের আলো বিকশিত হয়ে পড়েছে। তাই তাঁর সমস্ত বৈশিষ্ট্যই প্রশংসনীয়। অতএব, সকলে তাঁর ওপর দুরুদ পাঠ করুন এবং তাঁর পরিবার-পরিজনের জন্য আল্লাহর নিকট রহমত কামনা করুন।
========================================
মসনবী
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী
খেশ রা ছাফী কুন আয আওসাফে খোদ
তা বেবীনী যাতে পাকে সাফে খোদ
নিজেকে আমিত্বের ছেফত হইতে পবিত্র কর তাহা হইলে তুমি তোমার সত্তাকে এমন অবস্থায় পাইবে যে,
বীনি আন্দর দেল উলূমে আম্বিয়া
বে কিতাবো বে মুয়ীদো ঊস্তা
নিজ দেলের মধ্যে (আয়নায় প্রতিফলিত হওয়ার ন্যায়) কিতাব, সমপাঠী, এবং ঊস্তাদের মাধ্যম ব্যতীত নবীদের এলম দেখিতে পাইবে।
দার মেসালে খাহী আয এ্লমে নেঁহা
কেচ্ছা গো আয রূমীয়ানো চীনিঁয়া
যদি এলমে লাদুন্নীর দৃষ্টান্ত চাও, তবে রোমবাসী এবং চীনবাসীদের কাহিনী পাঠ কর।
(সংক্ষেপিত)
ইডিয়ট
হোমার
অনুবাদকঃ মাসরুর আরেফিন
'ক্রোধ- গাও, দেবী, পেলিউসপুত্র অ্যাকিলিসের ক্রোধের
কাহিনী, গ্রিকদের জন্য অগণন দুঃখ-পীড়া বয়ে আনা সেই খুনে,
অভিশপ্ত ক্রোধ যার কারণে তাদের অসংখ্য বীর-আত্মা, মহান
যোদ্ধাদের আত্মা নিক্ষিপ্ত হলো হেডিসের মৃত্যুপুড়ীতে, আর দেহ
পড়ে থাকল কুকুর ও শিকারী পাখির রসনা মেটাতে। এভাবেই
পূরণ হতে লাগল জিউসের অভিলাষ, সেই সেদিন থেকে যেদিন
তারা দু'জন- আগামেমনন, মানুষের রাজা, অ্যাট্রিউসের ছেলে;
ও দেবতুল্য অ্যাকিলিস- প্রথম বিবাদে জড়াল ও আলাদা হয়ে
গেল।' (সংক্ষেপিত)
ওডেসী
হোমার
নোঙরের ঠিক আগেই উড়ে যায় বন্দী বাতাস
ফের সূচনাতে ফিরে যাই অভিযাত্রী হতে
সমুদ্রদেব, পবনইশ্বরের কৃপায় পাহাড় ডিঙিয়ে যাই দেবীর কাছে
ফের নোঙরের আগে খুলে যায় বন্দী বাতাস
ফের সূচনাতে ফিরে যাই অভিযাত্রী হতে।
(সংক্ষেপিত)
মহাভারত
বেদব্যাস মুনি
শুকদেব মহামতি, কহে শুন নরপতি,
হরিকথা জগতের সার।
তুমি সাধু মহাশয়, শুন কহি সমুদয়,
হরি কথা সুধার ভান্ডার।।
সারগ্রাহী যেইজন, শুদ্ধ হয় তার মন,
হরি কথা করয়ে শ্রবণ।
শুন কহি মহাশয়, হরি-লীলা সুধাময়,
সাবধানে করি নিবেদন।।
একদিন সখা সঙ্গে, শ্রীহরি পরম রঙ্গে,
সঙ্গে লয়ৈ ধেনু বৎস যত।
যমুনা- পুলিনে হরি, যায় সবে রঙ্গ করি,
মন- সাধে খেলে অবিরত।।
(সংক্ষেপিত)
রামায়ন
বাল্মিকী
রাবণের বাক্যে সীতা কুপিয়ে অন্তরে।
কহেন রাবণ প্রতি অতি ধীরে ধীরে।।
অধার্ম্মিক নহি আমি রামের সুন্দরী।
জনক রাজার কন্যা আমি কুলনারী।।
রাবণেরে পাছু করি বৈসে ক্রোধ মনে।
গালাগালি পাড়ে সীতা রাবণ তা শুনে।।
নাহি হেন পন্ডিত বুঝায় তোরে হিত।
পন্ডিতে কি করে তোর মৃত্যু উপস্থিত।।
শৃগাল হইয়া তোর সিংহে যায় সাধ।
সবংশে মরিবি রে রামের সনে বাদ।।
(সংক্ষেপিত)
প্যারাডাইস লস্ট
মিল্টন
হায় মানুষ, তোমরা কত লজ্জার বস্তু!
অভিশপ্ত শয়তানও শয়তানের সঙ্গে এক গভীর ঐক্যে
আবদ্ধ হয়। অথচ মানুষ যুক্তিবাদী জীব হলেও
ঐক্যবদ্ধ হতে ব্যর্থ হয় পরস্পরের সঙ্গে।
যদিও তারা স্রষ্টার কাছ থেকে অনুগ্রহ ও শান্তি লাভের
আশ্বাস পেয়েছে, তথাপি তারা নিজেদের মধ্যে
ঝগড়া, বিবাদ, হিংসা, শত্রুতা ও যুদ্ধবিগ্রহ করে দিন কাটায়।
কিন্তু তারা জানে না তাদের নরকের শত্রুরা
তাদের অলক্ষে অগোচরে তাদের ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করছে দিনরাত।
(সংক্ষেপিত)
শাহনামা
ফেরদৌসি
প্রাণ ও প্রজ্ঞার প্রভূর নামে শুরু করি
অতিক্রম করতে পারেনা কল্পনা তাঁর নামের সীমানা।
প্রভূ তিনি নামের, প্রভু তিনি স্থানের,
তিনিই আহার্য্য দান করেন, তিনিই পথ দেখান।
তিনি প্রভূ পৃথিবীর ও ঘূর্ণ্যমান আকাশের,
চন্দ্র-সূর্য ও শুকতারা আলো পায় তাঁর থেকে।
বর্ণনা, ইঙ্গিত ও ধারণার উর্ধ্বে তাঁর অবস্থান,
চিত্রকরের সূষ্টির তিনি মূল ত্তত্ব।
সৃষ্ট জীবের রক্ষনে তিনি সদা তৎপর,
তাঁর অত্বিত্বের সংসয়াপন্ন ব্যাক্তির দুঃখও তিনি দূর করেন।
কল্পনা পথ পায় না তার মধ্যে
কারণে নাম ও স্থানের বাইরে তিনি
কিন্তু বাণী থেকে নাম ও স্থান অন্তনিহীত হলে
প্রাণ ও প্রজ্ঞা দুই-স্তব্দ নিশ্চল হয়ে যায়
তাই প্রজ্ঞা ও ভাষাকে নিয়োজিত করে
অমূর্তকে চাক্ষুষ করার জন্য।
তিনি রক্ষা করেন প্রাণ ও প্রজ্ঞার ভারসাম্য;
উসর চিন্তায় কি তাঁরে ধারণ করা সম্ভব
তাঁর প্রসংসা করার রীতি কারো জানা নাই
সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাঁর বন্দেগীর মধ্যই
এই মাত্র উপকরন ও ভঙ্গুর প্রাণ কে সম্ভল করে
কে পারে রচনা করতে প্রশংসা বানী স্রষ্টার জন্য;
প্রফুল্ল হও, তুমি তাঁর অস্তিত্বে
নিরর্থক- বাক বিস্তার থেকে মুক্ত হয়ে।
(সংক্ষেপিত)
এনেইদ
ভার্জিল
দি ডিভাইন কমেডি
দান্তে
“ভণ্ড ও মিথ্যুক দেবতাগণ”
মেঘনাদবধ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
(১৮২৮-১৮৭৩)
প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব- নন্দিনী
প্রমীলা, পতি- বিরহে কাতরা যুবতী।
অশ্রু আখি বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে
কভু, ব্রজ- কুঞ্জ- বনে, হায়রে যেমনি
ব্রজবালা, নাহি হেরি কদম্বের মূলে
পীতধড়া পীতাম্বরে, অধরে মুরলী।
কভু বা মন্দিরে পশি, বহিরায় পুনঃ
বিরহিনী, শূন্য নীড়ে কপোতী যেমতি
বিবশা! কভু বা উঠি উচ্চ- গৃহ-চূড়ে,
এক- দৃষ্টে চাহে বামা দূর লঙ্কা পানে,
অবিরল চক্ষুঃ জল পুঁছিয়া আঁচলে।
নীরব বাঁশরী, বীণা, মুরজু, মন্দিরা,
গীত-ধ্বনি। চারি দিকে সখী-দল যত,
বিরস- বদন মরি, সুন্দরীর শোকে!
(সংক্ষেপিত)
মিরেইও
ফ্রেদেরিক মিস্তাল
ভিনাস ও আদোনিস
উইলিয়াম শেক্সপিয়ার
রক্তিম সূর্য দিকচক্রবাল থেকে বিদায় নিল। বিক্রমের সঙ্গে আদোনিস যাচ্ছে। তার গন্ড দেশে লালচে আভা। সে শিকার করার উদ্দেশ্যে দৌড়াতে লাগল। তার এখন একমাত্র ভাবনা শিকার। সেই জন্য সে বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। ভালবাসা কাকে বলে তা সে জানেনা। সবাই-ই তার এই বিরুদ্ধ স্বভাবের কথা জানে।
কিন্তু অন্য দিকে তরুনী ভিনাস প্রেমের পূজারিনী। সে আদোনিসকে ভালবেসে ফেলেছে- নিজের দেহমন সবই সে আদোনিসকে সঁপে দিয়েছে সর্বদাই নানারকম মোহের জাল সৃষ্টি করে সে আদোনিসকে প্রেম নিবেদন করতে চায়। সপ্রতিভা নায়িকা যেমন নিজের প্রেমের জনকে করে তেমনভিাবে ভিনাস তার দু'বাহু দিয়ে আদোনিসকে বেঁধে রাখতে চাইছে। প্রেমের গ্রন্থি তৈরী করে সে প্রেমিকাকে সর্বদাই নিজের কাছে ধরে রাখতে চাইছে। ধীর পায়েতে সে আদোনিসের কাছে এগিয়ে যায়। ভাবাপ্লুত কন্ঠে আদোনিসকে নানা মধুর কথাবার্তা বলে। সে আদোনিসকে বলে যে সে সমস্ত গুণের অধিকারী। সর্বোচ্চ শিখরে সে মুকুটের মতোই তার অবস্থান। আরো বলে সে - "তুমি দ্বিগুন প্রেমময়। তুমি ছাড়া আর কারোই বা এমন মাধুর্য মহিমা রয়েছে। বাগানে গাছের শাখায় শাখায় যত ফুল সে সবই তো তোমার সেবার জন্য" ভিনাস আরো বলে চলে- সে বনে পায়রার শুভ্রতা ভীষন মনোহর। তার থেকেও নাকি গুণধর আদোনিস বেশি শুভ্র। রক্তিম গোলাপের বাহারের থেকেও না তার আরো বেশি বাহার রয়েছে। ইভান কাতর কন্ঠে ওকে সেই সঙ্গে জানায় যে বিশ্বের অন্তিমকাল ঘনিয়ে আসবে। তাই সে তাকে বিস্ময়ের সঙ্গে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে পড়তে বলে। তার প্রার্থনা পুরণ করার অনুরোধ জানায় শুধু এই অনুরোধ, সেই সঙ্গে সে এও বলে যে প্রার্থনা সে যদি পূরণ করে তবে হাজার হাজার রহস্যাবৃত্ত ঘটনা তার কাছে ক্রমশ প্রকাশিত হবে। (সংক্ষেপিত)
অগ্রদূত
খালিল জিব্রান
তুমিই তোমার অগ্রদূত। যে অট্রালিকা তুমি তৈরী করেছ তা তোমার অতিসত্তার ভিত্তি মাত্র। আর সেই অতিসত্ত্বারও হয়ে যাবে আরেক ভিত্তি।
আমিও আমার অগ্রদূত, কারন সূর্যোদয়ে যে দীর্ঘ ছায়া আমার সামনে টানটান হয়, দুপুরে তাই আমার পায়ের কাছে গুটিয়ে আসবে। আরেক সূর্যোদয় হবে, আমার সামনে ছড়াবে আরেক ছায়া; সেও গুটিয়ে আসবে আরেক দুপুরে।
চিরকাল আমরাই আমাদের অগ্রদূত ছিলাম, চিরকালই থাকবো। যা কুড়িয়েছি, আর যা কুড়োব সবই অকর্ষিত ক্ষেত্রের বীজ মাত্র। আমরাই মাঠ আমরাই কৃষক, যে কুড়োয় আর যা কুড়োই তাও আমরা।
যখন তুমি কুয়াশায় ঘুরে বেড়ানো বাসনা, আমিও ছিলাম সেখানে, এক ঘুরে বেড়ানো বাসনা। তারপর আমরা একে অপরকে খুঁজলাম, আমাদের আগ্রহ থেকে জন্মাল স্বপ্ন। আর স্বপ্ন ছিল কালবন্ধনহীন; স্বপ্ন ছিল স্থান, সীমাহীন।
আর যখন তুমি ছিলে জীবনের থরোথরো ঠোঁটে শব্দহীন শব্দ হয়ে, আমিও ছিলাম, আরেক শব্দহীন শব্দ। তারপর জীবন আমাদের উচ্চারণ করলো, আমরা এলাম গতকালের স্মৃতিমগ্নতা, আগামী কালের প্রতীক্ষার মাঝে। গতকাল মৃত্যুর দখলে, আগামীকালের জন্ম অনাগত।
আমরা এখন ঈশ্বরের হাতে। তুমি তাঁর ডান হাতে সূর্য, আমি তার বাম হাতে পৃথিবী। তবও তুমি আমার থেকে বেশী উজ্জ্বল নও।
আর আমরা, সূর্য আর পৃথিবী, আরো বিশাল সূর্য আর পৃথিবীর প্রারম্ভিকা মাত্র। আমরা চিরকাল প্রারম্ভিকাই থাকব।
তুমিই তোমার অগ্রদূত, তুমিই আমার বাগানের দরজায় হেটে যাওয়া আগন্তক।
আর আমিও আমার অগ্রদূত, যদিও বসে আছি গাছের ছায়ায়। মনে হয় স্তব্ধ।
============================================
মেঘদূত
কালিদাস
১০৮
স্বপন-মিলনে যদি কভু প্রিয়ে তোমারে হৃদয়ে ধরিতে যায়,
শূন্য আকাশে প্রসারিয়া বাহু বৃথাই কেবল দুঃখ পাই!
হেরি অভাগার গভীর যাতনা দেবতারও আখিঁ সজল হয়,
তরু কিশলয়ে অশ্রু মুকুতা ঝরি’ ঝরি’ পড়ে বেদনাময়!
১০৯
দেবদারু বনে সদ্য ছিন্ন কিশলয়চ্যুত রসের বাসা,
সুরভিত হ’য়ে শীতল সমীর দক্ষিণাপথে যখন আসে,
তোমার পরশ অঙ্গে বুলায় আসিছে বুঝিবা, ভাবিয়া মনে
আমি যে তাহারে, অয়ি গুণবতি! ধরিবারে ধাই আলিঙ্গনে!
১১০
চটুলা নয়না! দীর্ঘ রজনী কেমনে বলনা কাটিবে ত্বরা,
কেমনে ঘুচিবে সন্তাপ-দাহ সারাটি দিনের পাগল করা?
জানি জানি প্রিয়ে কামনা আমার দুর্লভ অতি, উপায় নাই,
তোমার বিরহ-বেদনে-বিপুল বক্ষে আমার বহিগো তাই!
১১১
ওগো কল্যাণি! নিরুপায় আমি, রহিয়াছি একা নিজেরে ল’য়ে
তুমিও আমার দুঃখ অপার কোনওমতে প্রিয়ে থাকিও স’য়ে।
যেথা বেশি সুখ, দুখ ততোধিক, সুখ দুখ নহে চিরস্থায়ী;
চাকার মতই ঘুরিতেছে তাই, উপরে ও নিচে দু’য়েরে পাই!
(সংক্ষেপিত)
রুবাই
ওমর খাইয়াম
১.
রাত পোহালো শুনছ সখি দীপ্ত ঊষার মাঙ্গলিক?
লাজুক তারা তাই শুনে কি পালিয়ে গেছে দিগ্বদিক!
পূব গগনের দেব-শিকারীর স্বর্ণ-উজ্জল কিরণ তীর
পড়ল এসে রাজ-প্রাসাদের মিনার যেথা উচ্চশির।।
২.
সেই নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়।
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে গঞ্জে তব মঞ্জু সুর
সেই তো সখি স্বপ্ন আমার, সেই বনানী স্বর্গপুর।।
স্বর্গে যা নেই
হাফিজ
গালে-কালো- তিল সেই সুন্দরী
স্বহস্তে ছুঁলে হৃদয় আমার,
বোখারা তো ছার, সমরখন্দ ও
খুশি হয়ে তাকে দেব উপহার ।
স্বর্গে যা নেই, আমি যেন পাই
হে সাকি, বানাও এমন বিধান,
রুকনাবাদের নদীর কিনার,
মুসল্লার সে ফুলের বাগান ।
খন্ডিত এই প্রেম দিয়ে আমি
পারি না বাঁধতে সে অপরূপাকে ;
রং তিল চুল – কিছুই কিছু না
যদি লাবণ্য চোখেমুখে থাকে ।
দিনে দিনে ইউসুফের যে রূপ
বাড়ছে চন্দ্রকলার সমান
সতীসাধ্বীর পর্দা সরিয়ে
জুলেখাকে দেবে সবলে সে টান ।
গানে আর মদে জমাও আড্ডা
ভবরহস্য হাতড়ে কী লাভ ?
বুদ্ধির পথে চললে কখনও
পাবে না কেউ এ ধাঁধার জবাব ।
কান দাও, প্রিয়া, আমার কথায় :
ঘা দিয়ে যতইশেখাক জীবন,
নওজোয়ানেরা জানে, তার চেয়ে
ঢের বেশি দামী প্রাজ্ঞবচন ।
আকথা-কুকথা বলেছ অনেক
তবু কোনো ক্ষোভ রাখি নি কো প্রানে ;
তুমি ঠিকই কালো : বিম্বাধরের
কটু কথাটাও মিঠে লাগে কানে ।
বানিয়েছ তুমি এমন গজল
কথা দিয়ে গাঁথা মুক্তোর হার,
হাফিজ, তোমার ছত্রে ছত্রে
যেন ঝিকিমিকি তারার বাহার।।
প্রেম সহজ না
হাফিজ
এসো সাকি, এসো, রেখো না বসিয়ে
হাতে হাতে দাও ভর্তি পেয়ালা ;
আগে ভাবতাম প্রেম কী সহজ,
আজ দেখি তাতে কী বিষম জ্বালা ।
খোঁপা থেকে মৃগনাভির সুরভি
ভেসে এসেছিল ভোরের হাওয়ায়
চমকানো তার চূর্ণ অলক
হৃদয়ে রক্তগঙ্গা বহায় ।
প্রানবঁধুয়ার পান্থশালায়
এ সুখশান্তি কদিনের বলো !
দিনরাত খালি বাজছে ঘন্টা :
‘গোটাও তোমার পাততাড়ি, চলো !’
কী ঘোর রাত্রি, কী ভীষন ঢেউ,
রসাতলে টানা ঘূর্ণী এমন -
কী করে জানবে শুকনো ডাঙ্গায়
ঝাড়া হাত-পায় যে করে ভ্রমন !
বুড়ো মাজি বলে, নমাজ পড়ার
আসনে ছুটুক মদের ফোয়ারা ;
সদগুরু নয় অজ্ঞ, সে জানে
সঠিক লক্ষ্যে চলবার ধারা ।
পরিনামে রটে নিন্দে, কারণ
যা করেছি শুধু নিজেরই জন্য;
সে রহস্য থাকে গোপন কিভাবে
জানাজানি হলে এ জনারণ্যে !
হাফিজ, চাও কি তার দর্শন ?
করো না নিজেকে আড়াল তাহলে ;
দেখা দিলে প্রিয়া, এই জগৎটা
ভুলে যেয়ো তুমি, ছেড়ে যেয়ো চলে ।।
নাইটিঙ্গেলের প্রতি
জন কিটস
অনুবাদ: হুমায়ুন আজাদ
১
আমার হৃদয় ব্যথা করছে, আর নিদ্রাতুর এক বিবশতা পীড়ন করছে
আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে, যেন আমি পান করেছি হেমলক,
কিংবা সেবন করেচছ কোন অসহ্য আফিম
এক মহুর্ত আগে, আর ভুলে গেছি সব:
এমন নয় যে আমি ঈর্ষা করছি তোমার সুখকে
বরং তোমার সুখে আমি অতিশয় সুখী,-
আর তুমি, লঘু- ডানা অরণ্যের পরী,
সবুজ বীচের মধ্যে
কোন সুরমুখরিত স্থলে, আর অসংখ্য ছায়ার তলে,
সহজিয়া পর্ণ কন্ঠে গেয়ে যাচ্ছো গ্রীষ্মের সংগীত।
২
আহা, এক ঢোক মদের জন্য! গভীর মাটির তলে
বহুকাল ঢাকা থেকে যে মদ হয়েছে শীতল,
দেহে যার পুষ্প আর গেঁয়ো সবুজের স্বাদ,
নাচ, আর প্রোভেন্সিয় গান , আর রোদের পোড়ার উল্লাস!
আহা, উষ্ণ দক্ষিণভরা একটি পেয়ালার জন্য,
পরিপূর্ণ খাটি, রক্তাভ হিপ্পোক্রেনে,
কানায় কানায় উপচে পড়ছে বুদ্বুদ,
এবং রক্তবর্ণরাঙা মুখ;
যদি পান করতে পারতাম, আর অগোচরে ছেড়ে পারতাম পৃথিবী,
এবং তোমার সঙ্গে মিলিয়ে যেতে বনের আঁধারে:
(সংক্ষেপিত)
প্রজ্ঞাময় সৌন্দর্যের গান
পার্সী বীশি শেলী
১.
ভয়ানক ছায়াটা কোনো অদৃশ্য শক্তির
বেড়ায় ভেসে অদেখা আমাদের মাঝে,— আসে
এই বিচিত্র পৃথিবীতে অস্থির ডানায় ভাসে
যেমন গ্রীষ্মের বাতাস ফুলে ফুলে অস্থির—
পাইনের পাহাড়ে চাঁদের আলো ঝরে ঝিরঝির,
চঞ্চল এক চাহনি যেনো ঘোরে
সব মানুষের মুখে আর অন্তরে;
সন্ধ্যার স্বর ও রঙের মতো হাসে,—
তারার আলোয় মেঘ ছড়িয়ে যাবার মতো,—
সংগীতের স্মৃতির মতো হারিয়ে যদি যেতো,—
কোনো কিছুর সুন্দরতা যেমন
প্রিয়, প্রিয়তর কেননা তা রহস্যময় গোপন।
২.
সৌন্দর্যের সত্ত্বা, যা শুদ্ধ করে
সমস্ত কিছু রঙ ছড়িয়ে নিজের
ভাবনা জাগাও,— যাবার তাড়া কিসের?
মিলিয়ে কেনো যাও, কেনো পড়ো স’রে,
অশ্রুভরা উপত্যকা ছেড়ে, শূন্য এবং পোড়ো?
জানতে চাও রোদ কেনো সব সময়
রঙধনু না আঁকে পাহাড় চূড়ায়,
হারিয়ে কেনো যায় একবার যা দেখি,
কেনো জন্ম ও মৃত্যু, স্বপ্ন এবং ভয়
ফিরে ফিরে আসে এই পৃথিবীর আলোয়
এমন অন্ধকার,— মানুষ কেনো এমন ক’রে পায়?
প্রেম আর ঘৃণা, হতাশা আর আশায়?
৩.
মহিমান্বিত পৃথিবী থেকে আসে না কোনো স্বর
সাধু কিংবা কবির কাছে আসেনি পয়গাম—
তাই দানব, প্রেত কিংবা ঈশ্বরের নাম
থেকে যায় তাদের ব্যর্থ নমুনা চেষ্টার,
ঠুনকো মোহ—যাদের মন্ত্র নয় ভোলাবার
যা কিছু আমরা শুনি আর দেখি,
সন্দেহ, সম্ভাবনা আর অস্থিরতা মেকি।
শুধু তোমার আলো—পাহাড়ের ওপরের কুয়াশার ঘাম।
অথবা রাতের বাতাসের গান
নীরব যন্ত্রের তারের সুরতান,
কিংবা মধ্যরাতের জলে চাঁদের চমকানি,
অস্থির স্বপ্নে আনে সত্য ও সুন্দরতা জানি।
৪.
প্রেম, প্রত্যাশা, আর মান, মিলায় মেঘের মতো
এবং আসে, অনিশ্চিত মুহূর্তের পর।
মানুষ হতো অমর, আর সর্ব শক্তির আধার,
তুমি, অচেনা আর ভয়ানক নিজের মতো,
তোমার মহিমা রাখো তার অন্তরে যত।
তুমি দূত সমবেদনার,
বাড়ে আর কমে, চোখে প্রমিকার —
তুমি—সাজাও ভাবনা মানুষের,
নিভে আসা যেনো প্রদীপের অন্ধকার!
মিলিয়ে না যায়, ছায়া এলেও তোমার,
যাও না চ’লে—পাছে কবরই হয়,
জীবন আর ভয়ের মতো, অন্ধকারময়।
পশ্চিমা বাতাস
পার্সী বীশি শেলী
জীবন পরিক্রমা
রবার্ট ব্রাউনিং
অনুবাদ মাঈনউদ্দিন মইনুল।
১) বৃদ্ধ হও সাথে আমার!
সর্বোত্তম বাকিই রয়েছে জানার,
জীবনের শেষাংশের জন্য সৃষ্ট এই প্রথমাংশ:
তাঁর হাতে আমাদের সময়
যিনি বলেছেন, “সমগ্র পরিকল্পনাটি আমার,
যৌবন কেবল তার অর্ধেক; আস্থা করো ঈশ্বরে;
দেখো সমগ্রটি, ভয় না পেয়ে!”
২) পুষ্প সঞ্চয় অবাঞ্ছনীয় নয়,
যৌবন কামনায় বললে, “কোন্ গোলাপটি হবে আমার,
কোন পদ্মটি যাবো পেরিয়ে, কিন্তু আক্ষেপ করবো হারিয়ে?”
তারকারাজির অনুসরণ নয় তো অমঙ্গল,
জীবন বললে, “বৃহস্পতি নয়, নয় মঙ্গল;
আমারটি হবে সেই কল্পিত তারকা
যাতে সব আছে, সব যায় ছাড়িয়ে!”
৩) এমন নয় যে আশা আর দুরাশায়
যৌবনের ছোট্ট সময়টি অতিক্রম করাকে,
আমি ভুল মনে করি: বোকামি আর অকিঞ্চিতকর বলি!
বরং অবিশ্বাসকে মূল্য দিই আমি
ইতর প্রাণীর যা না হলেও চলে,
তারা পরিপূর্ণ এক মাংসপিণ্ডতেই নিঃশেষ,
আত্মিক চেতনায় ভাবলেশহীন।
৪) জীবনের অহংকার নিস্ফল হয় যেখানে
মানুষের জীবন শুধুই জৈবিক সুখে মেতে থাকে
তা খুঁজে পেয়ে তৃপ্ত থাকে:
এমন সুখভোগ শেষ হলে, পরে
নিশ্চিতভাবে তা মানুষকে শেষ করে;
ফসলপুষ্ট পাখির আর কিসের দুশ্চিন্তা?
পূর্ণউদর জানোয়ার কি অনিশ্চয়তায় অস্থির হয়?
সং অফ মাইসেল্ফ
হুইটম্যান
আমি আমার খ্যাতি উদ্যাপন করি
এবং গান গাই আত্ম প্রতিষ্ঠার,
এবং পরিগৃহিত যে রূপ আমার
সে রূপ তোমারও।
কেননা প্রতিটি পরমাণু যা আমার
তা তোমারও।
আসরারাই খুদী
আল্লামা ইকবাল
অনুবাদঃ সৈয়দ শামসুল হক
প্লেটো- সংসার- বিরাগী রিষিশ্রেষ্ট,
ছিলেন সেই প্রাচীন মেষপালের অন্যতম!
তার পেগেসাস পথ হারিয়েছিল
ভাববাদিতার অন্ধকারে;
আর পাদুকা নিক্ষেপ করেছিল
বাস্তবের গিরিশিখরে।
অদৃশ্য করেছিল তাঁকে মায়ামুগ্ধ,
হস্ত, চক্ষু, কর্ণের ছিলনা কোন গুরুত্ব
তাঁর কাছে।
মৃত্যু- তিনি বলতেন,- ''জীবনের গোপন রহস্য,
প্রদীপ গোরাবাম্বিত হয় র্নিবাপিত হয়ে।"
পিয়ালা তাঁর নিদ্রাভিভূত করে আমাদেরকে
আর সরিয়ে নেয় আমাদের কাছ থেকে
দৃশ্যমান বিশ্ব।
তিনি একটি মেষ মানব- পরিচ্ছেদে,
সুফির আত্মা অবনমিত হয়
তাঁর প্রভাবের কাছে।
(সংক্ষেপিত)
সিজো
পক হিয়ো গেয়ান
অনুবাদ- খোন্দকার আশরাফ হোসেন
যদি আমার প্রেম পীড়িত স্বপ্ন হতো ঝিঁঝিঁ পোকা
দীর্ঘ, র্দীর্ঘ এ হেমন্ত রাত্রিতে
আমার প্রেয়সীর কক্ষে যেত সে অন্ধকারে
জাগাতো তাকে তার নিদ্রা থেকে,
যে গভীর নিদ্রা হায় ভুলিয়েছে আমাকে।
হাইকু
মাৎসুও বাশো
১
কেউই পর্যটনে যায় না
এই পথে কেবল আমি
হেমন্তের সন্ধ্যা।
২
একটি পুরোনো পুকুর
তাতে ব্যাঙ ঝাঁপায়
জলের শব্দ।
হাইকু
কোবায়য়াশি ইসা
১
শামুক
ধীরে ধীরে উঠছে
ফুজি পাহাড়ে।
২
হেমন্তের উজ্জ্বল চাঁদ
পুকুরের শামুকেরা চিৎকার করছে
হাঁড়িতে।
চান্দ্রগীতি থেকে
ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকা
অনুবাদ: ইমন জুবায়ের
চাঁদটা
সমুদ্রের ওপরে
ফেলেছে আলোর সিঙ্গা।
কাঁপা কাঁপা আর আলোরিত
ধূসর সবুজ প্রতীক।
বাতাসের ওপর ভাসছে আকাশ
পদ্মের বৃহৎ ফুল।
(আহ্, তুমি হাঁটছ একা
রাত্রির সর্বশেষ প্রহরে!)
ভোরের আগে
ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকা
অনুবাদ:ইমন জুবায়ের
কিন্তু প্রেমের মতো
তীরন্দাজরা
অন্ধ।
সবুজ রাতের
তীক্ষ্ম গান
উষ্ণ লিলির
মতো মনে হয়।
চাঁদের তলি কাটে
বেগুনি মেঘে;
আর ওদের দুলুনি
ভরে শিশিরে।
আহ, কিন্তু প্রেমের মতো
তীরন্দাজরা
অন্ধ।
দিওয়ানে আলী
হযরত আলী রাঃ
মানুষ আকৃতিগত ভাবে সমকক্ষ, আদম আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন
তাদের আদি পিতা এবং হাওয়া আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন আদি মাতা।
এক ব্যক্তি অপর ব্যাক্তির ন্যায় এবং আত্মাসমূহ পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ।
আর এতে বৃহত্তর অঙ্গসমূহ সৃষ্টি করা হয়েছে।
মানব জনক জননী হচ্ছেন বংশ গৌরবের সংরক্ষনাগার।
যদি তাদের মৌলিক উপাদানে কোন মর্যাদার বিষয় থাকে
যার দ্বারা তারা গর্ব করতে পারে, তা হচ্ছে মৃত্তিকা ও পানি।
জ্ঞানীগন ব্যাতিত আর কারো জন্য কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কারণ তারা
স্বয়ং সৎপথে প্রতিষ্ঠিত এবং সৎপথ অনুসন্ধ্যানকারীদের জন্য নির্দেশক।
আর মানুষের মূল্য তাতেই নিহিত, যা মানুষকে সৌর্ন্দয্য প্রদান করে
এবং পুরুষের কর্মকান্ডের জন্য সুনাম রয়েছে।
এর বিপরীতে প্রত্যেক ব্যাক্তি মূর্খতায় পর্যবসিত হয়।
আর মূর্খরা হলো জ্ঞানীদের জন্য পরম শত্র।
তুমি যদি সম্রান্ততার নির্দশন স্বরুপ স্বীয় বদান্যতা উপস্হাপন কর,
তবে জেনে রাখ, বদান্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বই আমাদের বংশগত পরিচয়।
অতএব ইলম অর্জনের মাধ্যমে সফলকাম হও
এবং বিনিময়ে কোন কিছু কামনা করো না।
কারন মানুষ মরণশীল এবং জ্ঞানীগনই প্রকৃত জীবিত।
দিওয়ানে মাইনদ্দিন
খাজা মাইনদ্দিন চিশতী (রহঃ)
১. আমার হৃদয় বন্ধু ছড়া অন্য কিছুই ধারন করে না
সুলতানের একান্ত নীরব মহল অন্য কাউকে ধারন করে না।
২. হৃদয়ের ভেতরের প্রাসাদে একজনই বাদশা আছে
যদি তিনি হৃদয়ের বাইরে তাঁবু খাটাতে চান, জলে-স্হলে কোথাও ধারন করে না।
৩. প্রত্যেক হৃদয়ের মসনদে তার স্বরণ জাগরুগ হয়ে থাকে
তার গৌরবের দোলনা কোন দৃশ্যই ধারন করে না।
৪. তোমার দেহ যদি হয় একগুচ্ছ চুল, প্রাণের পর্দা হয় বিরান
আশেক ও মাশুকের মাঝে একটি চুলও ধারণ করে না।
৫. অদৃশ্য- আহবানকারীর আওয়াজ প্রাণের পাখীর কানে পৌছেছে
এশকের বাতাসের সুউচ্চ চূড়া ডানা ও পালক ধারন করে না।
৬. নিজের সত্তাকে নফি মনে করা এসবত গুনের প্রথম সোপান
তোমার বাদশাহী কী কাজে আসবে যখন এ স্থানে তা ধারন করে না।
৭. বুদ্ধিমানের একশ বছরের হিসাব হাশরে এক নিঃশ্বাসে শেষ হবে
আশেকের এক নিঃশ্বাসের হিসাব একশ হাশরও ধারণ করে না।
৮. যদি এশকের রহস্য পড়তে চাও, তা শুধু হৃদয়- ফলকে পড়া যায়
তার বর্ণনার একটা অক্ষর শত দফতর ধারণ করে না।
৯. এশকের সমুদ্র থেকে মাত্র একটা ফোঁটা মনসুরের রহস্যর প্রকাশ
আশেকের ক্ষমতার পাত্র এর চাইতে আর কম ধারণ করেনা।
১০. যে পেয়ালার শরাব আমি পান করেছি তার রহস্য কত দিন গোপন থাকবে
এশকের শরাব উত্তাপে টগবগ করছে, পেয়ালা ধারণ করে না।
১১. হে মুঈন, তুমি যদি তার রহস্য মুখে প্রকাশ করতে চাও
সে রহস্যর মাকাম হচ্ছে ফাঁসির কাষ্ঠ, মিম্বার তা ধারণ করে না।
শের
আসদুল্লাহ খাঁ গালিব
৩৬
আমার আগ্রহের পাগলামি দেখো, বার -বার আমি;
নিজেই যাই ওদিকে, আর নিজেই হয়রান হয়ে ভাবি-কেন এলাম ।।
৩৭
জীবন তো এমনিতেও কেটে যেতো,
কেন তোমার পথের কথা মনে এল ?
৩৮
আমার বুকে মৃত্যুশেল হানবার পর নিষ্ঠুরতা বর্জনের শপথ নিল সে-
হায় রে ঐ ত্বরিত-অনুতাপিনীর অনুতাপ !
৩৯
মানলাম যে গালিব কিছুই না, তবু
একেবারে বিনা খরচায় পেয়ে যাও তো মন্দই বা কী ?
৪০
তুমিই জানো, অপরের সাথে তোমার কতখানি ঘনিষ্ঠতা;
আমারও খবর যদি নাও মাঝে মাঝে তো দোষ কি ?
এক পাগলীর প্রণয়গীতিকা
সিলভিয়া প্লাথ
রহমান হেনরী
আমি এই চক্ষুদ্বয় মুঁদি আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যায় মরে;
যখন চোখের পাতা খুলি, পুনরায় জন্মে সবই এই ধরণীতে।
(মনে হয়, তোমাকে গড়েছি আমি চিন্তাজুড়ে, স্বপ্নের ভেতরে।)
নীল ও লালের মধ্যে, তারা জাগে জোড়ায় জোড়ায়, নৃত্য ক'রে
আর আসে সার্বভৌম অন্ধকার ধাবমান অশ্বের গতিতে:
আমি এই চক্ষুদ্বয় মুঁদি আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যায় মরে;
স্বপ্ন দেখতাম, জাদুমুগ্ধ করছো তুমি বিছানার 'পরে
আর চন্দ্রাহতের মত সুর তুলে, বিপর্যস্ত করে দিচ্ছো উন্মত্ত চুম্বনে।
(মনে হয়, তোমাকে গড়েছি আমি চিন্তাজুড়ে, স্বপ্নের ভেতরে।)
ঈশ্বর দিতেছে খুলে আকাশের উর্ধ্বাঙ্গবসন, দোজখের তেজ যাচ্ছে সরে:
ফেরেস্তা, শয়তানঝাঁক চলে যাচ্ছে যেন কোনও সুদূরের বনে:
আমি এই চক্ষুদ্বয় মুঁদি আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যায় মরে;
বিশ্বাস ছিলো মনে, ওভাবেই ফিরবে তুমি, প্রতিশ্রুতি যতটা কড়কড়ে,
অথচ বুড়িয়ে যাচ্ছি, তোমার ও-নামও আজ মুছে যাচ্ছে বিস্মৃতি-বাতাসে।
(মনে হয়, তোমাকে গড়েছি আমি চিন্তাজুড়ে, স্বপ্নের ভেতরে।)
হয়তো উচিত ছিলো বজ্রপাখিকে ভালোবাসা, এরকম করে;
অন্তত বসন্তকালে কূজনমুখর ওরা একবার ঠিকই ফিরে আসে।
আমি এই চক্ষুদ্বয় মুঁদি আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যায় মরে;
(মনে হয়, তোমাকে গড়েছি আমি চিন্তাজুড়ে, স্বপ্নের ভেতরে।)
প্রণয় দর্শন
পরর্শী বিশি শেলী
অনুবাদ- রহমান হেনরী
ঝর্ণাগুলো নদীকেই আলিঙ্গন করে
নদীরাও মিশে যায় সমুদ্রের জলে
বেহেস্তি-হাওয়া সেও মেশে চিরতরে
আবেগের কী মধুমঙ্গলে!
জগতে কিছুই নয়, কেহ নয় একা;
অদৃশ্য ইঙ্গিতে সব কেমন দ্যাখো না
একক আত্মায় মিশে একাকার রেখা!
তা হলে, আমিই বা কেন তোমাতে মিশবো না?
পাহাড়চূড়াটি চুমু খাচ্ছে ওই আকাশের ঠোঁটে
ঢেউগুলি পরস্পর আলিঙ্গনরত;
ভগ্নিফুলও নিস্তার পাচ্ছে না মোটে
ভাইগুলো অবহেলা পায় যদি অচিনের মত;
রোদের আলিঙ্গনে পৃথ্বি যেন নিজেকে হারাবে
জ্যোৎস্নাচুম্বনে কাঁপে সমুদ্রের ঢেউ থরোথরো:
এতো এই আয়োজনে কী দরকার, কী অর্থ দাঁড়াবে
যদি না আমাকে তুমি চুম্বন করো?
শিহরণ
মূল- এডগার এলান পো
ভাষান্তর- শাওন ইমতিয়াজ
অদ্ভুত শিহরণ, গানে গানে মাথা ঝাঁকানো
তন্দ্রালু অবস্থায়, কাজকর্ম ফেলে।
যেখানে গাছের সবুজ পাতা নড়ে-চড়ে,
আর নিচে ছায়াঢাকা হ্রদের কোলাহল।
পছন্দ এই দীর্ঘপুচ্ছ ছোট টিয়া পাখি।
খুবই প্রিয় আমার পাখিটি- আমাকে
শিখিয়েছে বর্ণমালা, আধো আধো বলতে শিখিয়েছে
সবচেয়ে আগের শব্দটুকু, এই উদ্ভ্রান্ত মিথ্যার জগতে
আমি কৌতুহলী এক শিশু।
চলমান বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেলো।
উঁচু আকাশে প্রচুর আন্দোলন,
বজ্রপাতে চিত্তবিক্ষোভের অশনি সংকেত।
আমার কোন সময় নেই নিষ্কর্মা ভাবনাহীন থাকার,
উত্তাল আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
এক ঘন্টা পর উড়তে শুরু করা
নিক্ষিপ্ত আত্মা এসে পড়ে আমায়।
কিছুটা সময় বাদ্যবীনা ও শায়েরে’র ছন্দে,
সময় কাটাই ছুটির আমেজে।
আত্মা অপরাধবোধে ডুবে থাকে
যদি না সে কেঁপে উঠে বীনা আর শায়েরে’র ছন্দে।
একাকী
এলান পো
ছেলেবেলা থেকে আমি তেমন নই
যেমন অন্যেরা ছিলো— দেখি নি
যেমন অন্যেরা দেখেছে— ভাসাতে পারিনি আবেগ
ছোট্ট ঝরণা থেকে—
একই উৎস থেকে নিই নি কখনও
আমার দুঃখ — জাগাতে পারি নি
অন্তর একই সুরে ।
যা কিছু ভালবাসতাম, তা একান্ত আমার ।
তারপর, শৈশব, সবচেয়ে বিক্ষুব্ধ জীবনের
প্রভাতে— টেনে নিলো ভালমন্দের প্রতিটি গভীরতায়
সেই রহস্য বেঁধে নিলো নিতান্ত নীরবতায়—
সুতীব্র স্রোত বা চঞ্চলা ঝরণা থেকে
পাহাড়ের রক্তিম চূড়া থেকে
সূর্য থেকে যা আমাকে গুটিয়ে আনে
শরতের স্বর্ণের আভায়—
আলোময় আকাশ থেকে
যখন তা আমাকে অতিক্রম করে,
বজ্রপাত ও ঝঞ্ঝা থেকে
আর মেঘমালা থেকে যা সুগঠিত হয়
(যখন আকাশের অন্যপ্রান্ত থেকে যায় নীল)
একটি দানবের মতো, আমার চোখের সামনে ।
গাথা : অমরতার প্রচ্ছন্নতা
ওয়াডসওয়ার্থ
১.
এমন এক সময় ছিল যখন মাঠ, বন আর নদী,
মৃত্তিকা, এইসব সাধারণ দৃশ্য
মনে হতো
স্বর্গীয় আলোয় ছাওয়া,
স্বপ্নের মতো সজীব ও গৌরবময়
তেমন আর নেই পুরনো দিনের মতো;–
যেদিকে তাকাই
দিনে অথবা রাতে,
যা দেখেছি আগে, দেখি না তা আর।
২.
রঙধনু আসে আর যায়,
এখনও সুন্দর গোলাপেরা ,
চাঁদ হেসে
তাকায় চারদিকে শূন্য আকাশে,
তারাময় রাতের জলাশয়
সু্ন্দর, অপরূপ;
সূর্যোদয় এক গৌরবময় সূচনা;
তবুও জানি, যেদিকেই যাই,
সেই মহিমা নিয়েছে বিদায় পৃথিবী থেকে।
দ্য রাইম অফ দ্য অ্যান্সিয়েন্ট ম্যারিনার
কোলরিজ
কুবলা খান
এস. টি. কোলরিজ
রহমান হেনরী
কুবলা খান, ঘোষণা দিলেন, সানডুতে মহিমান্বিত সুখি
প্রাসাদ গঠিত হবে, এটা তার রাজকীয় সিদ্ধান্ত, ফরমান:
যেখানে পবিত্র প্রসিদ্ধ নদী আলফ বহমান
গভীর গভীরতম গিরিখাদ হয়ে অগণিত মানুষের পদছুঁয়ে
রৌদ্রহীন সমুদ্রের দিকে।
অতএব, পাঁচ ক্রোশ চতুর্দিকে সুফলা জমিন
মিনারে মিনারে আর দেয়ালে-প্রাচীরে বেষ্ঠিত:
আর অজস্র বাগান শত সর্পিল ঝর্নাশোভিত
যেখানে প্রতিটি বৃক্ষ অগণিত ধূপের সুবাসে ফুলবতী;
এবং সেখানে যত বনভূমি পাহাড়েরও চাইতে প্রাচীন
আর তার শ্যামলীমা সূর্যকিরণ ঢেকে দিতে পারে, সঘন এমন!
কিন্তু হায়, সেই এক রোমান্টিক গভীর ফাটল, কেমন লুকিয়ে থাকে
চিরহরিৎ অরণ্যের সবুজ পাহাড় থেকে অধোগামী প্রাসাদের দিকে!
কী এক অসভ্য সুন্দর স্থান! এমন পবিত্র আর মনোমুগ্ধকর
যেন এক ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের নিচে কোনও এক নারী খুব প্রেমাতুর
তার প্রিয় দৈত্যময় প্রেমিকের লোভে, এই সত্য তারও চেয়ে অতি ভয়ানক!
আর এই গভীর ফাটল পথে, দুর্নিবার বিষ্ফোরণ যেন,
যেন এই ভূগর্ভের অন্তরালে জমে থাকা সব দীর্ঘশ্বাস মুহূর্তে বাহিরে এলো,
ওভাবেই শক্তিমত্ত ঝর্নার উৎসারণে বিস্ফোরণ ঘটে গেল;
যার অর্ধ-হুংকারে এমন দৃশ্যটি হলো, যেন এই জগত ও অচেনা জগতে
স্বর্গ-মর্ত-জাহান্নাম খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে ছুটে গেল
অথবা সামান্য কোনও শস্যকণা পিষে গেল জাঁতাকলে
অতএব নৃত্যপর এইসব পাথর-নুড়ি ও শিলা প্রথমবারের মত কিংবা চিরতরে
মিশে গেল সেই এক পবিত্র ও প্রসিদ্ধ নদীর স্রোতে।
ওইসব পাঁচ পাঁচ ক্রোশ যেন ঘূর্ণিগতির তোড়ে
বনভূমি-উপত্যকা পার হয়ে ছুটে গেল পবিত্র নদীর দিকে
তারপর গভীর গভীরতম গিরিগুহা পৌঁছে গেল মানুষের কাছে
আর সব কিছু লহমায় ডুবে গেল নিষ্প্রাণ সমুদ্রের তলে ও অতলে:
এবং সেদিকে দ্রুত অপসৃয়মান সেই কুবলা খান, বহু দূর থেকে আসা
পূর্বপুরুষের কণ্ঠে শুনতে পেল, যুদ্ধ বিষয়ে যত ভবিষ্যতবাণী।
মহিমান্বিত সেই প্রাসাদের আনন্দ-গম্বুজ
ভাসছিলো ঊর্মিমালার মধ্যস্থলে,
অগণিত গুহা আর ঝর্নার মিলিত মন্দ্রিতস্বর
যেইখান থেকে ভেসে কানে এসে বাজে;
সে ছিলো বিরল এক কৌশল, অলৌকিক প্রকৃতিদেবের;
বরফ-গুহার মধ্যে রৌদ্রকরোজ্জ্বল এক আনন্দিত অন্য প্রাসাদের।
একবার, এক নজর দেখেছিলাম আমি
পিয়ানো হাতে কোনও এক কুমারী:
আর সে ছিলো এক আবিসিনিয়ান রূপসী,
এবং সে তার পিয়ানোয় বাজাচ্ছিলো
অ্যাবোরা পাহাড়ের গান।
তাদের স্বরে-সুরে-সিম্ফনীতে
নিজের ভেতরে পুনর্জাগরিত হতে পারতাম আমি
এমন উচ্চনাদী, সুরেলা আর গীতিময় সেই সুর
হৃদয়ের গভীরতম বিন্দু থেকে উৎসারিত আনন্দ
আমাকে এতোটাই উদ্বেলিত আর মেহাচ্ছন্ন করেছিলো
যে, অনায়াসে, হাওয়ার মধ্যেই আমি বানাতে পারতাম
কুবলা খানের সেই আনন্দ-প্রাসাদ
সেই রৌদ্রজ্জ্বল গম্বুজ! সেইসব তুষার-গুহা!
আর অন্যান্যরা, যারা শুনেছিলো সেই সুর, সবারই উচিত
ওই আনন্দ-প্রাসাদ আর তার সমুদয় সুখ-বর্ণনা চাক্ষুষ করা
আর সবারই উচিত বিলাপ করতে করতে বলা : সাবধান! সাবধান!
কুবলার উজ্জ্বল চোখ, আর তার ভাসমান কেশগুচ্ছ
ঢেউ এসে বৃত্তাকারে ঘিরে ধরলো, সেগুলো, তিন প্যাঁচে
সুপবিত্র ভীতি নিয়ে মুঁদে ফ্যালো তোমাদের চোখগুলো
কেননা, মধুজ-শিশিরে ডুবে, কুবলা বিবর্ণ হয়েছে
আর পান করেছে স্বর্গীয় দুগ্ধাদি।
কাবিরের কবিতা
কাবির
সূত্র: ইসলামী বিশ্বকোষ
"আত্নধ্যানকে আমার 'জিন'
করিতে ও আল্লাহ প্রেমের রেকাবে আমার পা রাখিতে দাও।..........
আর যাহারা নিজেকে বেদ বা কোরআন হইতে দূরে রাখে
তাহারাই নিপুণ অশ্বারোহী।"
কারণ আমি মৃত্যুর জন্য দাঁড়াতে পারিনি
এমিলি ডিকিসন
কারণ আমি মৃত্যুর জন্য দাঁড়াতে পারিনি—
সে নিজেই অনুগ্রহ করে দাঁড়িয়েছিল আমার জন্যে—
ক্যারিজটা শুধু আমাদেরকেই বহন করছিল—
আর সাথে অমরত্ব।
আমরা ধীরে এগুতে লাগলাম — তাঁর কোন তাড়া ছিলনা
এবং আমি ছেড়ে দিলাম
আমার সকল শ্রম, ব্যস্ততা আর অবসরটুকুও,
তাঁর সৌজন্যে।
আমরা স্কুলটা অতিক্রম করলাম, যেখানে শিশুরা
খেলছিল — বলয়টাতে —
আমরা অতিক্রম করলাম পলকহীন চেয়ে থাকা
শস্যের মাঠগুলোকে —
আমরা অতিক্রম করলাম অস্তমিত সূর্যটাকে —
অথবা বরং — সেই আমাদেরকে অতিক্রম করল —
শিশির গুলি কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল,
মিহি সুতোয় বোনা —আমার গাউন—
আমার উত্তরীয় — শুধুই সূক্ষ্ম রেশম—
আমরা একটা বাড়ির সামনে গিয়ে থামলাম
যেটাকে মনে হচ্ছিল যেন মাটির স্ফীত একটা অংশ —
বাড়ির ছাদটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল —
কার্নিশটা — মাটিতে —
তারপর থেকে — পেড়িয়ে গেছে শতাব্দী — তবুও
মনে হচ্ছিল সময়টা একটা দিনের চেয়েও ছোট
আমি প্রথমেই অনুমান করলাম
ঘোড়ার মাথা গুলো ছুটছে অনন্তকালের দিকে —
নট্রডামসের কবিতা
টমাস নট্রাডামাস
ফারুক চোধুরী
১
'টমাস মোর নীতি (কমিউনিজম) হবে পতনের সূচনা
নতুন দর্শনের প্রতি আকর্ষণ হবে দুর্নিবার,
নিপার নদী (ইউক্রেন) সর্বপ্রথম পথ দেখাতে চাইবে,
অপর রাষ্টের বিলাস দ্রব্যসাগ্রী হয়ে উঠবে আকর্ষণীয়।'
২
'তিনটি জলস্রোত থেকে জন্ম লাভ করবে এক রাষ্ট্র।
যে বৃহস্পতিবারকে করে নিবে তার বিরতি দিবস।
তার খ্যাতি, প্রশংসা, শাসন আর শক্তি বৃদ্ধি হবে স্হলে আর সমুদ্রে'
এ হয়ে উঠবে পূর্ব দেশের কাছে প্রচন্ড ঝঞা।
(সংক্ষেপিত)
=========================================
সনেট
শেক্সপিয়ার
১
নিবিড় মিলনের মাঝে দুটি মন যদি এক হয় তবে তার মাঝে কখনই কেন বাধা স্বীকার করবো না, যে প্রেম প্রেমই না, যে প্রেম ক্ষণেক্ষণে মত বদলায় অথবা নূতন প্রভুর কাছে নব অঙ্গীকার করে চলে। যে প্রেম প্রকৃত তা চিরদিন লক্ষ্যে চিরস্থির থাকে। ঝড়ের আঘাতে সে কোনদিনই কম্পিত হয় না। অচঞ্চল দূরের নক্ষত্র যেন কখনই কক্ষচু্ত হয় না যে মহত্ব অনস্বীকার্য যদিও তার যোগ্যতা অজ্ঞাত।
কালের করাল হাতে এই প্রেম কখনই ক্রীড়ানক নয়, অথচ কালগ্রাসে ক্সয় হয় সুন্দর কত গন্ড আর ওষ্ঠাধর। কালের গতির ঘায়ে এই প্রেম কখনই নিরর্থক হয় না। সমস্ত ধ্বংসের মাঝে এই প্রেম রয়ে যায় অজর অমর। এ যদি ভুল বলে প্রমাণিত হয়, মিথ্যা হয় তবে আমার সব কবিতা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হবে, আমার প্রেম মিথ্যা বলে বিদিত হবে।
২
হে প্রিয়, যখন ধরেছি বহিরঙ্গ সম্মানের হীন চন্দ্রাতপ, তোমার পথে দিয়েছি আমার সমস্ত শ্রদ্ধাসিক্ত ভালবাসার অঞ্জলী। সুখ ও দুঃখের যত তীব্র শীতাতপ আমি সইতে পারিনি। অনন্তের ভিত্তি তবু তা কালের জয়ে জলাঞ্জলী দিতে পারে নি। আমি দেখেছি যারা রূপ আর অনুগ্রহ চায় তারা অনেক বেশী হারায় যা তারা ভালবেসে দেয়। তারা সরল সুবোশ ছেড়ে মিশ্রিত উপাদানে সংগ্রহ করে চলে, তাদের ক্ষেত্রে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে সমস্ত রূপ আর অনুগ্রহ নিঃশেষে ফুরিয়ে যায়। তার থেকে তোমার অন্তরে আমাকে টেনে নাও, আমি যদিও নিঃস্ব তুও আমি মুক্ত, আমার আত্মা স্বাধীন। আমার অবিমিশ্রিত সত্তা ছলনাকে কখনও প্রশ্রয় দেয় না। আমার সত্তা তোমাতেই উৎসর্গকৃত। সম্পূর্ণ প্রতারণা হীন সে সত্তা। আমার আত্মা যখন অকারণে অভিযুক্ত হবে তখনো তুমি কত শত চাপ ও পীড়ন তুচ্ছ করে মুক্ত থাক।
৩
হে তরুন বালক তোমার মুষ্টিকে দৃঢ়বদ্ধ কর, কালের কাস্তে ভয়ানক আর তার ভ্রাম্যমান দর্পন চপল। যখন তুমি দুর্বল হয়ে পড়ে তখন তোমার আপন আত্মার দর্পনে প্রেমিককে দুর্বল করে দেখাও, যেভাবে তোমার প্রেমিক তোমার মনে প্রতিবিম্বিত হয়ে আছে। পরম কর্ত্রী প্রকৃতি যেদিকে চলবে। যেদিকে সেটা চালাতে চাইবে, যদিই তুমি এগিয়ে যাও এখনি সে তোমায় টেনে ধরবে। তার কবলে সে তোমাকে রেখে দেয় এই উদ্দেশ্য নিয়ে অদ্ভুত এক সূক্ষ্ম কৌশলে সে কালকে ধ্বংস করে অকারণে। হে বালক, সে প্রকৃতিকে তুমি ভয় করে চলো, তার মতে মত দিয়ে চলো দেরী হলেও সে তার সম্পদ যেন তোমাকে অর্পন করে, দেরীতে হলেও তার দেনা পাওনা শোধ করে দিতে হবে, পরিশেষে যা দেবার সে তোমাকেই দিয়ে যাবে।
৪
যতবার তোমার হাত সুরের মুর্ছনায় ফেটে পড়ে বীণার তারের ওপর তোমার আঙুলের সাথে সে তার নেচে চলে, তোমার আঙুলের মুদু চালনায় যে গীতের সুষ্টি হয় তাতে আমার কর্ণকুহর হঠাৎ করে স্তব্দবিহবল হয়ে পড়ে বীণার তারের ভাগ্যকেতাই আমি ঈর্ষা করি আমি ফেটে পড়ি তীব্র ভীষণ আকার ধারণ করে। আমার ওষ্ঠ দুটি তোমার চুম্বনের আশায় সর্বদাই প্রস্তত। প্রাণহীন বীণার তাদের উদ্বত্য দেখে তার ব্যথা তীব্র ভীষণ আকার ধারণ করে। আমার ওষ্ঠ দুটি তোমার চুম্বনের আশায় সর্বদায় প্রস্তত।
প্রাণহীন বীনার তারগুলি তোমার আজ আমার ওষ্ঠ বীণার তারে পরিণত হতে চায়। সে স্পর্শ না পেয়ে তারা আজ নির্জীব হয়ে আছে। হে প্রিয়া, তুমি যত পারো তোমার আঙুলগুলোকে উদ্বত বীণার তারে দিও কিন্তু একমাত্র তোমার চুম্বন দিও আমার দুটি অধরে।
৫
আমার প্রিয়ার মুখ সূর্যের মত উজ্জল নয়। তার অধরোষ্ঠ থেকে রক্ত-প্রবাল অনেক বেশী লাল। তুষারের মত তার বক্ষ শুভ্র সমুজ্জ্বল নয়। তার কেনাজালে মন কৃষ্ণ অমাংস্য জটিল তারের মত জীবনের নানাস্থানে অনেক দেখেছি রক্ত শ্বেত গোলাপ আমার প্রিয়ার গন্ড গোলাপের মত সুন্দর নয়। যে গন্ধ আমার প্রিয় নিঃশ্বাসের সাথে নিঃসৃত হয়, সে গন্ধকে গোলাপের গন্ধের সাথে তুলনা করাই বৃথা অপলাপ। তার কথা ভালবাসা কারণ তা কি যেন এক নেশায় নেশা, কিন্তু সংগীতের মত সেকথা জানি তা মধুর নয়। মন্দ মধুর পায়ে সে যখন মাটির পরে যাওয়া আসা করে মর্ত্যের সে মানবীকে কখনই স্বর্গের দেবী বলে ভুল হয় না। তবুও শপথ করে বলে যে তার প্রতি আমার প্রেম মাত্য সুবিরল। মিথ্যা যত তুলনার অতীত সে তার রূপগুণের সম্বল।
ও জিম্যানডিয়াস
পার্শী বেশী শেলী
প্রাচীন দেশে ঘুরে আসা এক পরিব্রাজকের সাথে আমার দেখা।
তিনি বললেন, দুটি দেহহীন বিশাল পাথরের পা
দাঁড়িয়ে আছে মরুভূমিতে............ সে দুটোর নিকটে বালুর উপর
পড়ে
অর্ধ ডুবন্ত এক চূর্ণ- বিচূর্ণ মুখমন্ডল শুয়ে আছে যার ভ্রকুটি,
আর কুচকানো ঠোঁট যেন উপহাস করে সবাইকে।
এবং কুচকানো ঠোঁট ও শান্ত আদেশের উপহার সূচক চাহনি
বলে যে, ইহার ভাস্কর পড়েছিলেন প্রাণহীন এসব বস্তুর পরে
যে গুলো এখন ও বেঁচে গেথে আছে প্রাণহীন এসব বস্তর পরে,
যে হাত তাদের করেছিল তামাসা এবং যে হৃদয় য়েছিল তীব্র
হতাশ;
এবং স্তম্ভের ভিত্তির উপরে উঁকি মারে এ কথারমালাঃ
আমার নাম ও জিম্যানডিয়াস, রাজার রাজা
তাকাও আমার কাজের প্রতি আর দেখ আমার ক্ষমতা আর
হতাশা,
পাশে কোন কিছুই টিকে নেই সেই বিশাল ধংস্বের চারিপাশে
সীমাহীন ও নগ্ন, নিঃসঙ্গ ও সমতল মরুভূমিতে
টেনে হিচড়ে নিয়ে গেছে অনেক দূরে।
ওডস অন দা গ্রেশান
জন কিটস
==========================================
প্রেমের প্রভু
মুলঃ ইবন আরাবী
অনুবাদকঃ আদিব আজাদ
আমি যদি জানতাম : তিনি যা জানতেন
যার হৃদয় তিনি গ্রহণ করেছেন।
অথবা আমার হৃদয় যদি জানতো যে
পর্বত শীর্ষের দীর্ঘ সরু উঁচু রেখাগুলো
তাঁর অনুসরণ করে দুর্গম পথলেখ।
তুমি কি তাদের সেই চিহ্নগুলো দৃশ্যায়িত করতে পারবে?
কিংবা ধ্বংস করে দিতে পারবে সেই চিহ্নলেখ!
প্রেমের প্রভু প্রেমেই নিমজ্জিত নিরন্তর
এবং অনন্তের ফাঁদে হতচিত্তও?
একজন মানুষের দর্পণে
সে শুধালো আমি প্রেমের উপত্যকায় পরিভ্রমণ করেছি
এই সদর্প পদচারণাই এর মহিমা
উদ্যানের পুষ্পরাজির মত সি্নগ্ধ ও পল্লবিত
আমি শুধালাম : তুমি যা অবলোকন করছো
এতে বিস্মিত হ'য়ো না।
তুমি তোমার অন্তর্ভূমি দেখো
একজন মানুষের দর্পণে।
দা প্রফেট
খলিল জিব্রান
আল-মস্তোফা, মনোনীত মহাপুরুষ সর্বজন প্রিয়
স্বীয় কালে ঊষাসম হয়ে আর্বিভূত,
সুদীর্ঘ বারোটি বছর বহে প্রতীক্ষায় অরফালিস নগরে
আপনার জলযান তরে, যে অর্নবপ্রোত
যাবে নিয়ে তাঁকে তাঁর স্বীয় জন্মভূমিতে,
দ্বাদশ বরষের সেই ফসলের মাসে,
রবিউল আওয়াল এর সপ্তম দিবসে, ছাড়িয়ে নগর প্রাকার
তিনি অধিরোহণ করিলেন পর্বত শিখরে।
নম্র নেত্রপাতে স্থির দৃষ্টি ধীর হেরিলেন-
পদপ্রান্ত হতে বিস্তারিত বিশাল সে জলাধার পানে।
কুজঝটিকা পরিব্যাপ্ত মহাসাগরের মাঝে
আপনারে ধীরে ধীরে করে দৃশ্যমান, এযে তাঁরই জলযান।
(সংক্ষেপিত)
ঈশ্বর
খলিল জিব্রান
অনুবাদ: ইমন জুবায়ের।
প্রাচীন কালে, যখন আমার ঠোঁটে স্পন্দিত হল ভাষা
আমি পবিত্র পর্বতে উঠলাম। তারপর ঈশ্বরকে বললাম: ‘হে আমার প্রভূ, আমি তোমারই দাস; তোমার গুপ্ত ইচ্ছাই আমার বিধান আর আমি চিরকাল তোমার বাধ্য থাকব।’
ঈশ্বর নীরব রইলেন।
তারপর প্রচন্ড ঝড়ের মূর্তি ধরে চলে গেলেন।
হাজার বছর পর আমি আবার পবিত্র পর্বতে উঠলাম।
তারপর ঈশ্বরকে বললাম: ‘হে আমার স্রষ্টা, আমি তোমারই সৃষ্টি। তুমি আমাকে নির্মাণ করেছ কাদা দিয়ে। আমার সবই তোমার।
ঈশ্বর নীরব রইলেন।
তারপর অজস্র ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেলেন।
হাজার বছর পর আমি আবার পবিত্র পর্বতে উঠলাম।
তারপর ঈশ্বরকে বললাম: ‘হে আমার পিতা, আমি তোমার পুত্র। প্রেমে আর করুণায় তুমি আমায় জন্ম দিয়েছো । প্রেমে এবং প্রার্থনায় আমি তোমার রাজ্য পেয়েছি।’
ঈশ্বর নীরব রইলেন।
তারপর দূরের পাহাড়ের কুয়াশার আবরনের মতো অদৃশ্য হলেন।
হাজার বছর পর আমি আবার পবিত্র পর্বতে উঠলাম।
তারপর ঈশ্বরকে বললাম:‘ হে আমার ঈশ্বর, তুমিই আমার লক্ষ, তুমিই আমার পরিপূর্ণতা; আমিই তোমার ফেলে আসা দিন আর তুমিই আমার ভবিষ্যৎ। পৃথিবীতে আমিই তোমার মূল আর আকাশে তুমিই আমার ফুল। একটাই সূর্যের নীচে আমরা বেড়ে উঠছি।’
এবার ঈশ্বর আমার দিকে ঝুঁকলেন। তারপর আমার কানে মধুবর্ষন করতে লাগলেন। আর সমুদ্র যেভাবে জড়িয়ে ধরে ছোট নদীকে, ঠিক সেভাবেই জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।
আর আমি যখন নীচের উপত্যকার দিকে নেমে যাচ্ছিলাম ... সেখানেও যেন আমি ঈশ্বরকে দেখতে পেলাম।
বৃত্তের তা-সিন
মনসুর আল- হাল্লাজ
অনুবাদঃ রায়হান রাইন
১১.
তিনি ভয় ও বিস্ময়ে পূর্ণ ছিলেন
এবং পরিহিত ছিলেন সত্যের পোশাক,
তিনি বেরিয়ে এলেন এবং সমস্ত সৃষ্টির প্রতি
'আহা!' ধ্বনি দিয়ে কাঁদলেন।
কে তুমি বলো আমার কণ্ঠস্বরে
মওলানা জালাল উদ্দিন রুমি
সমস্ত দিনমান ভেবে ভেবে আকুল আমি এখন রাত্রে বলছি শোনো,
কোথা থেকে এসেছি আর কেনই বা
আমি তার কিছুই জানি না
আমার আত্মা এসেছে অন্য কোথাও থেকে, হ্যাঁ আমি নিশ্চিত
এবং আখেরে সেখানেই ফিরতে চাই
আমার এই উন্মত্ততার শুরু অন্য কোনো পান্থশালা থেকে
তার চৌহদ্দির ভেতর পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই
পুরোদস্তুর স্বাভাবিক হয়ে উঠবো আমি
এ পাখিরাজ্যে আমি যেন এক ভিন্ মহাদেশী আগন্তুক
সময় ঘনিয়ে আসছে আমার উড়ে যাবার
কিন্তু এ কে ভর করেছে আমার কর্ণমূলে
কে শুনছে আমার কথা
কে বলে কথা আমার কণ্ঠস্বরে?
এ কে যে দেখছে আমার চোখ দিয়ে? আত্মা কী?
এ প্রশ্নগুলো না করে পারি না আমি
অন্তত একটি উত্তরের এক কণা স্বাদও যদি চাখতে পারতাম
তবে এ নেশার গারদ ভেঙে বেরুতে পারতাম
এখানে স্বেচ্ছায় আসিনি আমি, যাবোও না
যে এনেছে ফিরিয়ে নেবার দায় তার
আমি মোটেই জানি না এখানে, এ কবিতায় কি বলতে চেয়েছি
এ প্রকল্প আমার নয়
আর যখন এ কথাগুলো বলতে পারি না
আমি নিপাট শান্ত হয়ে যাই এবং
আদৌ কথাই বলি না
ভালোবাসার সক্ষমতা, দ্বিধার পৃথিবী এবং আশ্চর্য দিন
মুলঃ মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী
অনুবাদকঃ আলাউদ্দিন আহমেদ সরকার
ভালবাসার সক্ষমতা
আমি ছিলাম মৃত, জীবিত হয়েছি
কাদছিলাম পরে হেসেছি!
আমাকে পেয়ে বসেছে ভালোবাসার সক্ষমতা
কখনো সিংহের হিংস্রতায়; আবার কখনো
সন্ধ্যা তারা হয়ে স্নিগ্ধ আলো ছড়াতে থাকি!
দ্বিধার পৃথিবী
দ্বিধার পৃথিবী অনুপযুক্ত ভালোবাসায়!
তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকায়
যেন—
মরণ; আমার আত্নাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়।
আমার হৃদয়, সবুজ সুন্দর!
লক্ষাধিক প্রাণের অধিক আমার হৃদয়
কিন্তু কী অদ্ভুত! তোমার এক চিলতে হাসি
আমাকে দেউলিয়া করে দ্যায়!
আশ্চর্য দিন
কী আশ্চর্য দিন আজ! যুগল সূর্য ছড়াচ্ছে আলো!
কী আশ্চর্য দিন, ফেলে আসা দিন নয়
চেয়ে দ্যাখো--
তোমার হৃদয় ছড়াচ্ছে আলো
যান্ত্রজীবন থেমে গ্যাছে!
তোমরা আজ যারা নীজেদের মন পড়তে পারছো
কী আশ্চর্য দিন,
তোমাদের আজ!
==========================================
ট্যাং কবিতা
লি বাই
মদের পাত্র নিয়ে ফুল গাছ তলে
একা একা খাই বন্ধু কেউ নাই
পেয়ালা উঠায়ে চাঁদরে দেখাই
সে আমি আর আমার ছায়া এই নিয়ে তিন
চন্দ্র হায় আফসোস! এ রস চেনে না
ম্যাঁদামারা ছায়া পাশে পড়ে থাকে
চাঁদের মত বন্ধু ছায়ার মত চাকর
দেখি যেন বৃথা না যায় বসন্ত দিন আমার
আমার গানে চাঁদ শুধু মিটিমিটি হাসে
আমার নাচে ছায়া খালি জড়ায় গড়ায়
সজাগ যতক্ষন - তত ফুর্তি
বেহুঁশ হলেই যার যার তার তার
এসো বার বার হারাই এই ভবঘুরে শূন্যতায়
আর মিলি দুধসাদা সেই তারার মেলায়
যে পথে হয়নি চলা
রর্বাট ফ্রষ্ট
একটি হলুদ বনে দু'টি পথ দু'দিকে বিস্তৃত,
এবং দুঃখিত আমি পারি না উভয় পথে যেতে
একই পথচারী হ'য়ে। বহুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে
ভাবি, দেখি যতদূর দৃষ্টি যায়- একটি কোথায়
বেঁকেছে কোন সে বনবাদাড়ের নিচে অবশেষে।
তারপর অন্য পথে চলি, যে-ও বেশ চমৎকার,
হয়তো এটির দাবি টের বেশী অন্যটির চেয়ে,
কেননা এ-পথ ঘাসে ঢাকা আর পথচিহৃহীন;
যদিও পায়ের ছাপে ক্ষয়ে ক্ষয়ে অন্যটির মতো
অবিকল সে-ও হয়ে যাবে একদিন সুনিশ্চয়।
সে দিন সকালে জানি দু'টি পথই সমপরিমানে
ছিল পাতা-ছাওয়া আর পড়ে নিকো পদচিহৃ কোন;
প্রথমটি রেখে দিই আহ কোন দিনের আশায়;
অথচ একটি পথ অন্য পথে মিশে বিলক্ষণ,
বুঝি তাই কোন দিন ফিরি কিনা ছিলতো সংশয়।
আজ থেকে যুগ যুগ পরে হয়তো কোথাও
দীর্ঘশ্বাসে ফেলে শুধু চলবো এ কথাই- দুটি পথ
গিয়েছে একটি বনে, আর আমি- আমি চলি সেই
পথে যেটি পদচিহেৃ এযাবত যথেষ্ট মলিন
হয় নিকো, তাতেই ঘটেছে এই যা- কিছু তফাৎ।
এপ্রিল এবং নীরবতা
টমাস ট্রান্সট্রোয়েমার
অনুবাদ- প্রাণেশ কুমার চৌধুরী
বসন্ত পরিত্যক্ত মরুভূমির মতো পড়ে আছে,
কালো মখমলের পরিখা
আমার পাশ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছে
তার কোন প্রতিফলন নেই।
যা একমাত্র উজ্জ্বল দেখা যাচ্ছে
তা হচ্ছে হলুদ ফুল।
আমার ছায়া আমাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে
যেমন বাদ্যযন্ত্র বেহালা কালো বাক্সে
বন্ধ করে রাখার হয়।
আমি একমাত্র জিনিস যা বলতে চাই
তা আমার নাগালের বাইরে
দূরে আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে
বন্ধকি দোকানে সঞ্চিত রৌপ্যখন্ডের মতো।
সূর্যালোকিত ভূ- নিসর্গ
ট্রমাস ট্রান্সটমার
রহমান হেনরী
ঘর বাড়ির পেছন থেকে জেগে উঠেছে সূর্য
দাড়িঁয়ে পড়ছে পথের ঠিক মাঝখাটায়
আর আমাদের দিকে ছুড়ে দিচ্চে তার
রক্তিম বাতাসের নিঃশাস।
যদিও আজ আমি ফেলে যাচ্ছি তোমাকে ইন্সবুক।
তবুও আগামী দিনে
এখানে, এই ধূসর, আধমরা বনভূমি জুড়ে
জেগে উঠবে প্রদীপ্ত এক সূর্য
যেখানে, অবশ্যম্ভবীরুপেই, বেঁচে থাকবো আমরা আর কাজ করে যাব।
কবি কোথায়?
জন কিটস্
অনুবাদ:শেখ নজরুল
কবি কোথায়? তাকে দেখাও, দেখাও।
সম্ভবত আমি চিনতে পারছি তাকে
এই সেই লোক যে অন্য এক লোকের সঙ্গে থাকে
সে থাকে রাজার মতো, রাজার সমান।
অথবা, কোন অচ্ছুত ভিখেরীর প্রতিবাদে
অথবা এর চেয়ে আশ্চর্য অনেক কিছুতে।
লোকটি থাকে প্লেটো কিংবা কোন মহাকব্যে
এই সেই লোক যে থাকে পাখির সঙ্গে
গায়িকা পাখির মতো গানে গানে অথবা
ঈগল-এর মতো খুঁজতে থাকে খাদ্য।
এই সেই লোক যে থাকে
সিংঘের দৌঁড়ের সহজাত প্রবৃত্তি পায়ে
এবং অনুভব করতে পারে গলা থেকে রক্ত গ্রহণের স্বাদ।
এই সেই লোক যার সঙ্গে থাকে বাঘের গর্জন
অথবা মায়ের মধুর ডাক শোনর মতো সচকিত কান।
=================================
বনলতা সেন
জীবনান্দ দাস
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে ;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারি দিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ; অতি দূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে ; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তথন গল্পের তরে জেনাকীর রঙে ঝিলমিল ;
সব পাখী ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ-জীবনের সব লেন দেন ;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
আকাশলীনা
জীবনানন্দ দাশ
সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে - আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? - তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস -
আকাশের ওপারে আকাশ।
তুষারঝরা সন্ধ্যায় একটি বনের পাশে
রবার্ট ফ্রস্ট
অনুবাদ – ফিরোজ আহমেদ
এই বনটা কার তা আমি জানি বলে মনে হচ্ছে
এ গ্রামেই তার বাড়ী, তবু-
সে দেখতে পাবে না যে, আমি
এখানে তার বন তুষারপাতে ভ’রে যেতে দেখার জন্য থেমেছি,
আশেপাশে কোনো খামার ছাড়া
বন ও বরফে পরিণত খালের মাঝখানে
বছরের সবচেয়ে অন্ধকারময় সন্ধ্যায় এখানে দাঁড়ানোটাকে
আমার ছোট ঘোড়াটি নিশ্চয়ই অদ্ভুত বলে ভাবছে।
সে তার গলায় বাঁধা ঘন্টাটি মৃদু বাজায়
কোনো ভুল হচ্ছে কি-না তা জানতে;
আর অন্য একমাত্র শব্দ হচ্ছে মৃদু-প্রবাহিত
বাতাস আর পতনশীল তুষারের শব্দ।
মনোরম অরণ্য। অন্ধকার ও গভীর।
কিন্তু আমার অনেক প্রতিশ্রুতি রাখবার আছে;
ঘুমাবার আগে অনেক মাইল যাবার আছে
অনেক মাইল যাবার আছে ঘুমাবার আগে।।
ভালবাসতাম
আলেকজান্ডার পুশকিন
তোমাকে ভালবাসতাম, বোধকরি এখনো বাসি
সে দীপশিখাটি নিভেনি আজো, অবশ্য
এটা আমার ভেতর এখন এতো শান্তভাবে জ্বলছে যে
তোমার বিব্রত বোধ করার কোনো কারণ নেই
নীরবে প্রতিদানহীনভাবে তোমাকে চেয়েছিলাম
খুব ঈর্ষা হতো কখনো, কখনো শরমিন্দা
ঈশ্বর যেন তোমাকে এমন একজন মিলিয়ে দেন
যে তোমাকে ভালবাসবে ঠিক আমারই মতো
সন্তর্পণে ও বিশ্বস্ততায়।
খণ্ড কবিতা ১৫৯
- সাপ্ফো’
অনুবাদ: জুয়েল মাজহার
আমি আগে আগে যাব?
আমার পেছেনে তুমি?
হে, পুরুষ তুমি মূঢ়!
তোমার শূন্যগর্ভ কান,
এতো অগভীর তোমার মন,
তুমি কখনোই পারবে না!
নিঃস্ব
হেনরিক হাইনে
অনুবাদ: হুমায়ুন আজাদ
অনেকে আমাকে করেছে নিঃস্ব,
আমার জীবন নষ্ট হয়েছে শেষে:
অনেকে নিঃস্ব করেছে ঘৃণায়,
অনেকে করেছে প্রেমে আর ভালোবেসে।
আমার পেয়ালা বিষে ভরে গেছে,
আমার রুটিতে মিশিয়েছে তারা বিষ:
কেউ মিশিয়েছে ভালোবেসে আর
কেউ মিশিয়েছে ঘৃণায় অহর্নিশ।
তবে যার বিষ শোচনীয়তম করেছে আমাকে,
যার বিষ সবচে সর্বগ্রাসী,
সে কখনো বলেনি একটিও ঘৃণার কথা-
কখনো বলেনি- প্রিয়তম ভালোবাসি।
একাকী এক মেঘের মত ঘুরে বেড়াই আমি
ওয়ার্ডসওয়ার্থ
অনুবাদ – ফিরোজ আহমেদ।
একাকী এক মেঘের মত ঘুরে বেড়াই আমি
পাহাড় আর উপত্যকার ঐ উঁচুতে যে মেঘ ভেসে যায়
ঠিক তখনই হঠাৎ করে দেখতে পেলাম এক সমাবেশ,
থোকায় থোকায় গুচ্ছে গুচ্ছে স্বর্ণালী ড্যাফোডিল;
লেকের ধারে বৃক্ষসারির নিচে,
মৃদু হাওয়ায় দোল খায় আর নাচে।
ছায়াপথের মাঝে উজ্জ্বল ঝিকিমিকি
তারকারাজির মত সুবিন্যস্ত,
তারা বিস্তিৃত হয়ে আছে
বেলাভূমির সীমানা বরাবর অশেষ সারিতে।
একনজরে দেখতে পেলাম অযুত-লক্ষ (ফুল)
মাথা দোলাচ্ছে তারা স্বতঃস্ফুর্ত নাচের মুদ্রায়।
তাদের পাশে ঢেউগুলো নাচছিল কিন্তু তারা
হাস্যে-লাস্যে ঝিকিমিকি ঢেউগুলিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছিল;
এরকম আমুদে এক সঙ্গী পেলে কোনো কবি
আনন্দিত না হয়ে পারে না।
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম; ভেবে পেলাম না-
আমার জন্য এই দৃশ্যের মাঝে কী সম্পদ রাখা ছিল
কারণ যেমনটি প্রায়শঃই আমি শূণ্যমনে ব্যথাবিধুর হৃদয় নিয়ে
বিছানায় শুয়ে থাকি
তখন তারা (ড্যাফোডিলগুলি) দৃশ্যমান হয়ে উঠে আমার
অর্ন্তগত দৃষ্টির সামনে (যে দৃষ্টি) নিঃসঙ্গতার দান;
আর তখনই আমার হৃদয় আনন্দে ভরে ওঠে
আর নাচতে থাকে ড্যাফোডিলের সাথে।
গানেতেই
ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকা
প্রতিটি গানই
থেকে যায়, রয়ে যায় ভালোবাসার।
বরং প্রতি আলোতেই
পড়ে সময়ছাপ,
সময়ের এক গেরোতেই ।
ভারী দীর্ঘশ্বাস তাই
হাসে, কান্নার রেশ আর !
জানালার ধারে সকাল
টি.এস. এলিয়ট
ওরা মাটির নিচের রান্নাঘরে সকালের নাশতার প্লেট নাড়াচাড়া করছে,
আর আমি বুঝতে পারছি সড়কের পায়ে মাড়ানো প্রান্ত ধরে
গৃহপরিচারিকাদের স্যাঁতসেতে আত্মা
এলাকার গেটগুলোতে নিরাশায় ফুটে উঠছে।
কুয়াশার বাদামি ঢেউগুলো সড়কের তলা থেকে
ভাঙাচোরা মুখগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছে আমার দিকে
আর ছিঁড়ে আনে কাদাভর্তি স্কার্টপরা এক পথচারীর
অকারণ হাসি, যা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে
ছাদের কাছাকাছি এসে মিলিয়ে যায়।
আমি একা নই
গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল
রাত্রি, এটি পরিত্যক্ত
সমুদ্র থেকে পাহাড়।
অথচ আমি, যে তোমাকে কাঁপায়,
আমি একা নই!
আকাশ, এটিও পরিত্যক্ত
যেহেতু, চাঁদ পড়েছে সমুদ্রে।
অথচ আমি, যে তোমাকে ধরে থাকে,
আমি একা নই!
পৃথিবীও পরিত্যক্ত
দেখ যে, বাঁচা কী করুন।
অথচ আমি, যে তোমাকে জড়িয়ে থাকে,
আমি একা নই!
দাঁড়কাক
মূল: এডগার অ্যালান পো
অনুবাদ: শাবা আবদুল্লাহ
একদা এক বিবর্ণ মধ্যরাতে, ভাবছি বসে তণুমন ক্লান্ত তাতে
পড়ছিলাম কোন এক পুরোনো দিনের লোক-গাঁথা—
চোখে ঢুলুনী, ঘুম তাড়াতে নাড়ছিলাম মাথা,
হঠাৎ কোথায় যেন ঠক ঠক শব্দ শুনি, কেউ একজন নাড়ছে কড়া দরজায় বুঝি।
"সে এক অতিথি হবে," বলছি মনে, "কড়া নাড়ছে যে দরজায় আমার,
ব্যাপারটা এই, নয় কিছু আর।"
ওহ! কী শীতল ছিল সেই ডিসেম্বর, সব কিছু ঠিক মনে আছে আমার
অগ্নিপাত্রে হচ্ছিল শেষ জ্বলন্ত অঙ্গার, যেন ফ্লোরে নাচছে কোন ভূতুরে কঙ্কাল
খুব আগ্রহে আমি পড়ছি বই, হয়তো শেষ হবে আগামী কাল,
যার বেদনা ভুলতে কেবলি পড়ছি, সে তো লেনোর
প্রিয়তমা, বধু আমার—বিরল সুন্দরী স্বর্গীয় লেনোর
নামহীন এখানে এখন, হায়! ফিরবে না কখনো আর।
হীম বাতাস বইছিল, রেশমি পরদাগুলো খসখস করছিল
আমি শিহরিত, অদ্ভুত এক আতঙ্কে গা ছমছম করছিল,
ভয়ে অন্তরাত্মায় পেটুনি দিচ্ছে, আমি দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করছি
“এ এক আগন্তুক মাত্র, অনুমতি চাচ্ছে কামরায় ঢোকার
একজন নিশুতি পরিদর্শক মাত্র, যে অনুমতি চাচ্ছে ঢোকার,
এ ছাড়া নয় কিছু আর।”
(সংক্ষেপিত)
আয়না
সিলভিয়া প্লাথ
রূপোর মতো স্বচ্ছ আমি। পেছনের ধারনা নেই কোনো।
দ্রুত বুঝে নিই সবকিছু অবিকল,
অপছন্দ বা ভালবাসার প্রচ্ছন্নতা দিয়ে নয়।
নিষ্ঠুর নই, সত্যের কথক শুধু—
এ যেনো এক সামান্য চারকোণা দেবতার দৃষ্টি।
ছোট্ট গোলাপের বিন্দুর মতো
আমার ধ্যান লেগে থাকে বিপরীত দেয়ালে।
দেখেছি অনেকক্ষণ,
ভেবেছি এ আমার হৃদয়ের অংশ। অস্থির, কম্পমান।
মুখের ছবি আর অন্ধকার বিচ্ছেদ টেনে দেয় বার বার।
এখন আমি হ্রদের মতো।
কোনো এক রমণী ঝুঁকে আছে আমার ওপর,
খুঁজে ফিরছে গন্তব্য।
তারপর ফিরে আসে সেই মিথ্যুকদের কাছে,
মোমবাতি অথবা চাঁদের কাছে।
তাঁর পেছনটা দেখি,বিশ্বস্ততায় বিম্বিত।
আমাকে উপহার দেয় অশ্রু, দু’হাতের অস্থিরতা।
আমি খুব মূল্যবান তাঁর কাছে। আসে আর যায়।
প্রত্যেক সকালে অন্ধকার স্থান করে তাঁর অবয়বে।
বালিকার বেশে ডুবে আছে সে আমার ভেতরে।
আর আমার মধ্যে এক বৃদ্ধা রমণী
উঠে আসে তাঁর কাছে, দিনের পর দিন,
ভয়ানক মাছের মতো।
সকালের গান
সিলভিয়া প্লাথ
ভালোবাসা তোমাকে এক মূল্যবান ঘড়ির মতো চালায়
পায়ের নীচে আলতো আঘাত করে ধাত্রী রমণী আর
তোমার নিষ্ফল কান্না থিতু হয় কিছু একটায়।
প্রতিধ্বনি তোলে আমদের কন্ঠ। জানায় জাঁকালো উপস্থিতি,
নতুন অবয়ব। তোমার স্বচ্ছতা ছায়া দেয় খসড়া যাদুঘরে, আমাদের আশ্রয়ে।
দাঁড়িয়ে যাই আমরা সুগোল শূন্য দেয়ালের মতো।
আমি আর তোমার মা নই
সেই মেঘের চেয়েও নই বেশিকিছু— ঝ’রে পড়ে ধীরে আয়নার প্রতিবিম্বে
মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।
সারারাত তোমার রেশমী নিশ্বাস
অস্থির কেঁপেছে গোলাপের পাঁপড়ির ওপর।
জেগে উঠেছি শুনবার জন্যে:
কানের কাছে দূর সমুদ্রের শিহরণ।
কান্নার শব্দে নেমে এলাম বিছানা ছেড়ে, নিদারুণ পুষ্পিত হৃদয়ে,
আমার গায়ে ভিকটোরিয়ান নাইট গাউন।
বিড়ালের পরিচ্ছন্ন মুখের মতো খোলা তোমার মুখ। জানালার চত্বর।
শুভ্রতা আর অগভীরতায় পূর্ণ করে এর নিঝুম তারকা।
তুমি এখন নিবিড় ক’খানা চিঠিতে;
স্বচ্ছ কিছু বর্ণমালা উঠে আসে বেলুনের মতো।
সোনার তরী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
মরুর বুকে
Stephen Crane
"মরুর বুকে......"
এই শুষ্ক ভূমিতে প্রখর রদ্দুরের কোন একদিনে
আমার সাথে দেখা হয়েছিল অনন্য এক প্রাণের,
নগ্ন এবং হিংস্র।
প্রচণ্ড দাপটের সাথে জানান দিয়ে চলছে
নিজের অস্তিত্বের,
তার হাতে রক্তাক্ত এক হৃদয়,
সম্ভবত তারই হৃদয়....
আমাকে অবাক করে দিয়ে সে সেই হৃদয়ের
পুরোটা পুরে নিল তার মুখে,
আমি অবাক বিস্ময়ে জানতে চাই
"কেন এমন করলে ?"
সে অস্ফুট স্বরে জানালো,
আমার সারাজীবনের সব ব্যাথা বহন করে
আমার হৃদয় আজ তিক্ত......অনেকটা নীলকণ্ঠীর মত,
কিন্তু তবুও আমি ভালবাসি আমার হৃদয়টাকে;
দুষিত হলেও এটা যে আমারই হৃদয়............
শিশির
পল সেলান
শিশির।
আর আমি শুয়েছিলাম তোমার সাথে, তুমি, আবর্জনার মধ্যে,
একটি থিকথিকে চাঁদ
আমাদের উপর করেছিল উত্তরের শিলাবৃষ্টি,
আমরা গুঁড়ো হয়ে ভেঙে যাচ্ছিলাম
আমরা গুঁড়ো হয়ে হচ্ছিলাম এক:
ঈশ্বর রুটিটি ভাঙলেন,
রুটিটি ঈশ্বরকে ভাঙল।
প্রহর-ভর্তি তোমার হাত
পল সেলান
অনুবাদ- খোন্দকার আশরাফ হোসেন
প্রহর-ভর্তি তোমার হাত, তুমি এলে আমার কাছে- আর আমি বললাম;
তোমার চুল বাদামি নয়।
তাই তুমি তোমার চুল তুলে দিলে দুঃখের দাঁড়িপাল্লায়, সে হলো
আমার চেয়ে ভারী…
জাহাজে চড়ে ওরা আসে তোমার কাছে, ওকে করে পণ্য, তারপর
কামনার বিপণীবিতানে বিক্রির জন্য সাজায়….
তুমি গভীর থেকে আমার দিকে চেয়ে হাসো, আমি কাঁদি তোমার জন্য
হাল্কা রয়ে-যাওয়া দাঁড়িপাল্লা থেকে।
আমি কাঁদি: তোমার চুল ধুসর নয়, ওরা দেয় সমুদ্র থেকে লোনাজল
আর তুমি ওদের দাও তোমার কেশরাজি….
ফিসফিসিযে বলো: ওরা পৃথিবীকে ভরিয়ে দিয়েছে আমাকে দিয়ে, তোমার
হৃদয়ে আমি এক শুন্য পথ আজো।
তুমি বলো: সরিয়ে রাখো তোমার বয়সের পত্রালি- এখনই সময়
তুমি এসো আমার কাছে, করো চুম্বন আমাকে।
বয়সের পত্রালি ধুসর, ধুসর নয় তোমার চুলগুলো।
নিঃস্ব
হেনরিক হাইনে
অনুবাদ: হুমায়ুন আজাদ
অনেকে আমাকে করেছে নিঃস্ব,
আমার জীবন নষ্ট হয়েছে শেষে:
অনেকে নিঃস্ব করেছে ঘৃণায়,
অনেকে করেছে প্রেমে আর ভালোবেসে।
আমার পেয়ালা বিষে ভরে গেছে,
আমার রুটিতে মিশিয়েছে তারা বিষ:
কেউ মিশিয়েছে ভালোবেসে আর
কেউ মিশিয়েছে ঘৃণায় অহর্নিশ।
তবে যার বিষ শোচনীয়তম করেছে আমাকে,
যার বিষ সবচে সর্বগ্রাসী,
সে কখনো বলেনি একটিও ঘৃণার কথা-
কখনো বলেনি- প্রিয়তম ভালোবাসি।
আরেকটু ঘুমাও, শুভ্র মুক্তাটি আমার
জন কীটস
রহমান হেনরী
সুনিদ্রিতা! ওহ, আরেকটু ঘুমাও, শুভ্র মুক্তাটি আমার!
তোমার শিয়রে বসে নতজানু প্রার্থণায় মগ্ন হতে দাও,
আশীর্বাদের মত বেহেস্তের নূর নেমে চুমু দিক চোখে,
স্বর্গ থেকে ওইসব শুভাশীস পেড়ে আনতে দাও!
প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতে দাও চিরন্তন সুখের বাতাসে,
তোমাকেই ছুঁয়ে দিক এরা, নিঃশেষে মুড়িয়ে দিক সুখে__
স্বতঃপ্রণোদিত এই আত্মসমর্পণ, দাসত্বের স্বেচ্ছা-অঙ্গীকার,
আকস্মিক এই পুজা, প্রেম, নৈবেদ্য আমার আত্মার।
ফুল
পল সেলান
পাথর।
আকাশের পাথর যাকে আমি অনুসরণ করেছি।
তোমার চোখ, পাথরের মতো অন্ধ।
আমরা ছিলাম হাত
হাত,
আমরা অন্ধকারকে গাঁট বেঁধে করেছি শূণ্য, আমরা দেখেছি
সেই শব্দ যা গ্রীষ্মকে আরোহণ করেছে :
ফুল।
ফুল- এক অন্ধ মানুষের শব্দ।
তোমার চোখ এবং আমার :
তারা আকুল
জলের জন্য।
বৃদ্ধি
হৃদয় প্রাচীরের উপর হৃদয় প্রাচীর
যোগ করে তাতে পাপড়ী।
এ রকম আরেকটি শব্ধ, এবং হাতুড়িগুলো
খোলা প্রান্তরের উপর ঘুরবে।
অনুবর্তিতা, সাউথ আফরিকার জন্য
ডেনিস ব্রটাস
১.
সোনালি ওক আর জাকারডিয়
ফুল
চমৎকার চিত্রকল্প
আমার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে তুলে নেবার জন্য
২.
রাত্রিবেলা
নিজেকে ঘুমিয়ে তোলার জন্য
আমি অক্ষরের খেলা খেলি
কিন্তু তোমার কথা ভেসে ওঠে মনে
আর আমি কেঁদে ফেলি
৩.
আমি লন্ডনে আর প্যারিসে
অ্যামস্টারডম আর রটরডমে
মিউনিখ আর ফ্রংকফুর্টে
ওয়রস আর রোমে
শুতে বাধ্য হয়েছি–
কিন্তু তবু বাড়ির জন্যে ফুঁপিয়ে উঠি।
হেমন্তের মৃতদেহের জন্য আয়না
আদুনিস
দেখেছ কি একজন নারীকে
যে হেমন্তের মৃতদেহ বয়ে বেড়ায়,
নিজের মুখশ্রীকে মিশিয়ে ফ্যালে পাথরপ্রতিমার সঙ্গে
আর বৃষ্টির আঁশ দিয়ে বুনে ফ্যালে
নিজের পোশাক,
যখন জনগণ
ফুটপাতের ছাইগাদায়
স্ফূলিঙ্গের গনগনে শবে রূপান্তরিত ?
একজন নারীর মুখ
আদুনিস
আমি একজন নারীর মুখশ্রীতে বসবাস করি
যে থাকে একটা ঢেউয়ের ওপর
জোয়ার যাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে নদীর তীরে
যে নদীতীর তার বন্দরকে লুকিয়ে রেখেছে
একটি শামুকের মধ্যে।
আমি একজন নারীর মুখশ্রীতে বসবাস করি
যে আমায় হত্যা করেছে
যে হয়ে উঠতে চাইছে
একটি মৃত ইশারা
আমারই রক্তের ভেতরে ভাসমান
পাগলামির শেষ বাঁক পর্যন্ত।
অপর পার
ওকতাভিও পাজ
দিনের পাতাটা ওলটাই
আমায় যা বলা হয়েছে তা লিখি
তোমার চোখের পাতার ইশারায় ।
তোমাতে প্রবেশ করি,
অন্ধকারের সত্যতা
অন্ধকারের প্রমাণ চাই, আমি চাই
কালো রঙের মদ পান করি
আমার চোখদুটো কচলাই
রাতের এক ফোঁটা
তোমার বুকের চূড়ায়
কারনেশান ফুলের রহস্য
নিজের চোখ বুজে
তোমার চোখের ভেতর পাতা মেলি
সবসময় জেগে
তোমার রক্তবর্ণ খনিজ বিছানায়
তোমার ভিজে জিভ
ফোয়ারা রয়েছে
তোমার রক্তশিরার বাগানে
রক্তের মুখোশ পরে
আনমনা তোমার চিন্তার অপর পারে যাই
আমাকে পথ দেখায় স্মৃতিহীনতা
জীবনের ওপারে নিয়ে যাবার জন্যে।
যে কোনো মৃত্যুর জন্যে অনুতাপ
হোর্হে লুই বোরহেস
আশা বা স্মৃতি থেকে মুক্ত,
সীমাহীন, বিমূর্ত, ঠিক যেন ভবিষ্যৎ
মৃত লোকটি মৃত মানুষ নয়: ও হল মৃত্যু
অতীন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বরের মতন
যাঁর সম্পর্কে বলা সব কথা অস্বীকার করতে হয়,
যে মৃত, সমস্ত জায়গায় পরক
সে বিধ্বস্ত ও তার জগত অনুপস্হিত।
তার যাবতীয় আমরা লুঠ করে নিই,
তাকে কোনো রঙ বা শব্দাংশের মতনও বাঁচিয়ে রাখি না
এখানে, এই উঠোন যা ওর চোখ আর দেখতে পায় না
ওখানে, পথের ধারে যেখানে ওর আশা অপেক্ষারত ।
এমনকি আমরা যা ভাবছি তাও,
হয়তো ও ভাবছে
ভোরের মতন আমরা ভাগাভাগি করে নিয়েছি
রাত্রি আর দিনের লুঠের মাল ।
হেমন্ত শেষের গান
রবার্ট ফ্রস্ট
ধানকাটা শেষ হলে, যখন গিয়েছি হেঁটে ওই মেঠোপথে__
শীর্ষভারহীন, খাড়া, গুচ্ছ-ধানগাছে,
প্রশান্ত খড়ের ঘুম, জমে-ওঠা শিশিরের রথে;
পাশেই বাগান, পথও আধোখোলা আছে।
আবার যখন আমি ফিরে আসি বাগানের 'পরে__
খড়খড়ে লতাগুল্ম ফুঁড়ে ওঠে বিষন্ন আওয়াজ
শান্ত যত পাখিদের ডানা থেকে, ঝুর ঝুর ঝরে;
জগতের কোনও শব্দে নেই এতো বেদনার সাজ!
পাঁচিলের পাশে খাড়া নগ্নগাছ, মৃদু চোখ রাখি,
হয়তো আমার আসা, চিন্তারাশি, বিঘ্নিত করে নাই তাকে__
নিঃস্ব-বাদামী পাতা, ঝরে যেতে যেতে তবু অপেক্ষায় থাকে;
হয়তো অপেক্ষা শেষ, টুপ করে খ'সে যেতে বাকি।
বেশি দূর এগোতে পারি না আর , যতি টানি__
মলিন-ধুসর হয়ে যেতে থাকা শেষ নীল-ফুলটিরও রঙ
খুঁটে তুলি; হৃদয়ের যত্নে তাকে সাথে বয়ে আনি,
ভেবে রাখি, দেবো এটা পুনর্বার তোমাকে বরং!
‘আমি কেউ নই, তুমি কে?’
এমিলি ডিকিসন
আমি কেউ নই, তুমি কে?
তুমিও কি কেউ নও?
তবে আমরা যুগল হলাম,— কাউকে বোলো না !
তারা নির্বাসনে দেবে,— বুঝেছ !
কেউ একজন হওয়া কত ভয়ানক!
কতটা প্রকট একটি ব্যাঙের মতো
ব’লে যাওয়া কারো নাম সমস্ত দিন
শোভন জলাভূমির কাছে!
আমি জীবনের শেষে অনুগ্রহ চাই
এমিলি ডিকিনসন
মাজেদুল হক
আমি জীবনের শেষে অনুগ্রহ চাই
আমি চেয়েছিলাম অনুগ্রহ প্রধানত
যখন দক্ষ জীবন শেষে ানুগ্রহ প্রয়োজন
তখন নতুন করে মরতে চাই না।
আমি বিশ্বাস করি না মানি না- দৃঢ় সংকল্প থাকলে
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে হবে
'প্রার্থনা কর' অমরত্বের জন্য অনন্তকাল
মৃত্যুর দেশে যাওয়ার জন্য।
এককজন নারী
এজরা পাউন্ড
"নারী হয়ে ওঠা......"
"আমার অনেক দিনের চেনা শরীরের ভেতর
আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে আশ্চর্য একটা চারা গাছ,
আমার অন্ত্র থেকে ধীরে ধীরে শুষে নিচ্ছে সমস্ত প্রাণরস।
আমার বুকের মাঝে বাড়ছে,
আমার ভেতরে বিস্তৃত করে চলেছে তার শাখা প্রশাখা,
আমার একান্ত চারা গাছটা
হয়ত এখন বাঁচতে শেখেনি একা একা;
তাই মধ্য রাতে যখন বাতাসের সাথে
সে নাচতে চায়-
তিব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠি আমি।
একটা সত্যিকারে শিশু বেড়ে উঠছে আমার ভেতর,
আমার অহংকার হয়ে
সারা পৃথিবীর কাছে তুই আজও বিস্ময়,
এসেছিস আমার নারীত্বকে পূর্ণ করতে .....।"
যথেষ্ট, বলল রমণী
ইউসুফ আল-খাল
অনুবাদঃ সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ
যথেষ্ট, বলল রমণী।
কষ্ট আমার ঠোঁটে,
বুকে কষ্ট,
আমি কষ্টময়।
যথেষ্ট।
বাতিটা নেভাও, ঘুম যাও,
কালো-কালো দাগে নোংরা প্রভাতের আলো।
আমিও ঘুমাব,
আর সারা দুনিয়াটা আমার সঙ্গে ঘুম যাবে,
কোনো স্বপ্ন
আমাদের জাগাবে না; স্বপ্নের মরণ জাগাবে।
জাগরণ
পুড়ে-ছাই-হ’য়ে-যেতে-থাকা ঘন বন।
অশ্বারোহীর গান
ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকার
করদোবা ।
বহু দুর এবং নির্জন ।
পূর্ণিমা, কালো ঘোড়া,
জিনে অলিভ গাছের ছোঁয়া ।
যদিও প্রতিটি পথ আমি চিনি
কখনও করদোবা পৌঁছোতে পারব না ।
বাতাসের মাঝ বরাবর, উপত্যকা হয়ে,
লাল রঙের চাঁদ, কালো ঘোড়া ।
মৃত্যু চেয়ে আছে আমার দিকে
করদোবার মিনার থেকে ।
হেই হো, এই পথ কতদুর যায় !
হেই হো, আমার দুঃসাহসী ঘোড়া !
হেই হো, মৃত্যু অপেক্ষা করছে,
আমি করদোবা পৌঁছোবার আগে ।
করদোবা ।
বহু দুর, এবং নির্জন ।
===========================================
বিদ্রোহী
কাজী নজরুল ইসলাম
বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর -
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন "আরশ" ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র-ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর -
আমি চির-উন্নত শির!
আমি চিরদুর্দ্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
আমি দুর্ব্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ'লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃংখল!
আমি মানি নাকো কোনো আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম,
ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জ্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর!
আমি বিদ্রোহী আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল বীর -
চির উন্নত মম শির!
(সংক্ষেপিত)
আমি ওখান থেকে এসেছি
মাহমুদ দারবিশ
অনুবাদ: ইমন জুবায়ের
আমি ওখান থেকে এসেছি এবং আমার আছে স্মৃতি
জন্মেছি, মরণশীলেরা যেভাবে জন্মায়, আমার একজন মা আছে
আর আছে একটি জানালাময় ঘর
ভাই আছে আমার, আছে বন্ধু,
আর আছে শীতল জানালাসহ কারাকক্ষ।
আমার আছে ঢেউ, যে ঢেউ সমুদ্রচিল দ্বারা লাঞ্ছিত,
আমার রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি,
আর আছে অতিরিক্ত একটি ঘাস।
আমার আছে চাঁদ, যে চাঁদ শব্দের কিনার থেকে দূরে,
আর অনেক পাখি আছে আমার,
আর আছে অবিনশ্বর সব জলপাই গাছ।
তরবারি সক্রিয় হওয়ার পূর্বেই
এ ভূখন্ডে হেঁটে গেছি আমি ।
আমি ওখান থেকে এসেছি। আকাশের মায়ের কাছে আমি
আবৃত্তি করি আকাশ
আকাশ যখন তার মায়ের জন্য কাঁদে।
আর আমি ফিরতি মেঘের জন্য
আমার উপলব্দির তরে কাঁদি।
আমি শিখেছি রক্তের দরবারে কথারা প্রশংসার যোগ্য
আমি তাই ভাঙ্গতে পারি নিয়ম।
প্রতিটি শব্দই আমি শিখেছি আর সেসব ভেঙ্গে
শিখেছি একটিই শব্দ বানাতে: জন্মভূমি …
মুখোশ
পাবলো নেরুদা
অনুবাদকঃ অনীক ইকবাল
ব্যর্থ সেসব শতাব্দী, ব্যর্থ সেসব সময়
হতভাগ্য সে শতকের সকল মানুষ- সুখী কিংবা বিধ্বস্ত যুদ্ধাহত।
যেসব কাজ আমরা করে যেতে পারিনি-
হয়তো আমাদের কোনো দোষ নেই...
এক টুকরো ইস্পাতের বড় প্রয়োজন ছিলো সেদিন।
সব ইস্পাত আমরা ক্ষয় করেছি যুদ্ধে, ধ্বংসে
শেষ পর্যন্ত এসবের কিন্তু কোনো মানেই নেই,
যে কতগুলো বছর যুদ্ধের ক্ষত বুকে বয়ে বেড়িয়েছি
বছরের পর বছর দুর্বল হয়েছি,
শত্রুশিবিরে আটকে পড়ে হতাশার আগুনে পুড়েছি...
কখনো না কখনো তো বলতেই হবে কথাগুলো,
একবার নয়, বারবার,
প্রয়োজনে ফিসফিসিয়ে যেন কেউ শুনতে না পায়-
আমি লজ্জিত, আমরা সবাই বিধবার মত নিশ্চুপ নিস্তব্ধ,
সত্য আজ পঁচাগলা লাশ নগরীর শতসহস্র গোরস্তানে-
জেনে রেখো- আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে-
এই উৎসবের বছরে কেউ পরাজিত নয়
আজকে সবাইকে বিজয়ের মুখোশ পড়ে থাকতে দাও।
প্রজাপতি
চিনুয়া আচেবে
গতি মানে সহিংসতা
শক্তি মানে সহিংসতা
ভর মানে সহিংসতা
আলোকের ভেতর, ভরহীনতার ভেতর
তরঙ্গমুখর উড়ালের ভেতর প্রজাপতি খুঁজে ফিরে সুরক্ষিত পথ
তবু রাস্তার বাঁকে পুরনো সব বৃক্ষ থেকে দুর্বিনীত নতুন মহাসড়কে
ছড়িয়ে পড়ে বিচিত্র আলো।
তবু আমাদের ভিন্ন ভিন্ন ভ্রমণগুলো সংঘর্ষে লিপ্ত হয় মুখোমুখি
জোড়া শক্তির মোড়কে আমি আসি
এবং আমার কঠিন সিলিকন ঢালের মুখে
ভদ্র প্রজাপতি সোনার আলোয় আলোয়
বিলিয়ে দেয় নিজেকে।
আলবাট্রস
শার্ল বোদলেয়ার
অনুবাদ : বুদ্ধদেব বসু
মাঝে মাঝে, সকৌতুকে, নাবিকেরা তাকে ধরে ফেলে ।
বিশাল আলবাট্রস, সমুদ্রের বিহঙ্গপুঙ্গব,
তিক্ত ফেনা পেরিয়ে যে চলে আসে মৃদুমন্দ তালে,
জাহাজের সহযাত্রী, সঙ্গদাতা, পথের বান্ধব ।
যে-মুহূর্তে ওরা তাকে ধরে এনে রাখে পাটাতনে,
লজ্জায় বিকল এই নীলিমার সম্রাট তখনই
বিরাট, করুন,শুভ্র ডানা তার, ক্ষুব্ধ নিপাতনে
নাড়ে, যেন দাঁড়-ভাঙ্গা, অসহায়, সন্ত্রস্ত তরণী ।
এই সে-আকাশযাত্রী, কত রূপ ছিল সম্প্রতি ও!
অপ্রতিভ কুশ্রীতায় প্রহসন-পুত্তলি এখন !
কারো বা খুড়িয়ে-চলা বিদ্রূপে সে অনুকরণীয়,
অথবা হুকোর নল চঞ্চুপুটে দেয় কন্ডুয়ন !
মেঘলোকে যুবরাজ ! এইমতো, কবিও হেলায়
তুফানে ঝাপট দেয়, ব্যর্থ করে কিরাতের ফলা ;
কিন্তু এই মৃত্তিকার নির্বাসনে, উল্লোল মেলায়
মহান ডানার ভারে অবরুদ্ধ হয় তার চলা ।
==========================================
মৃত্যুসংঙ্গীত
পল সেলান
প্রত্যুষের কালো দুধ আমরা তাকে পান করি সন্ধ্যায়
আমরা তাকে পান করি সকালে পান করি রাত্রে
পান করি আর পান করি
আমরা খুঁড়ি এক কবর মৃদুল হাওয়ায় সেখানে শুয়ে থাকে
কেউ একজন অবরোধহীন
বাড়ির ভেতর বসত করে একজন সে কেউটে সাপ খেলে
সে লেখে, সে লেখে যখন গোধূলি ঘনায় জার্মানীতে
তোমার সোনালী চুল মার্গারেট
সে লেখে আর দরোজার বাইরে পা বাড়ায় আর তারাগুলো চমকায়
সে তার শ্বাপদগুলোকে ছেড়ে দেয় শিস্ দিয়ে
(সংক্ষেপিত)
শাকর-এর জন্য শোকগাথা
আল-খানসা
অনুবাদঃ ইমন জোবায়ের
শাকরের জন্য চিৎকার করে কাঁদো
দেখ, উপত্যকায় একটি পাখিও
শোকার্ত।
যখন যোদ্ধারা হালকা অস্ত্রে হয় সজ্জিত
যখন তরবারীর রঙ স্বচ্চ নুনের মতন
যখন ধনুকের টঙ্কার করে আর্তনাদ
যখন বাঁকানো বর্শাগুলো সব ভিজে
সাহসী, দূর্বল নয়-
বরং অরণ্যে শিকারী সিংহের ন্যায় সাহসী
যে যুদ্ধ করেছে তার বন্ধুদের জন্য
আত্মীয়বর্গের জন্য-তারাও সিংহের ন্যায় সাহসী।
ঝড়ঝঞ্ছা থেকে সে তার গোত্রকে বাঁচিয়েছে
বাঁচিয়েছে মরুভূমির একাকী পথিককে
বাতাসের গর্জন করে উঠলে তার মানুষেরা সুখি
যখন জমাট মেঘের নিচে উড়বে বাতাসের ধূলা।
==========================================
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:৩৯