মা নিয়ে বাংলা ভাষায় এত বড় সংকলন আর দ্বিতীয়টি হয়নি বলে নিশ্চিত করেই বলা যায়। সম্পাদক জগলুল হায়দার জানালেন, সংকলনটা চূড়ান্ত করতে দু বছর লেগে গেছে। সংকলনে স্থান পেয়েছে মাকে নিয়ে বিখ্যাতদের স্মৃতিচারণ, ছড়া-কবিতা, গল্প, অনুবাদ কবিতা, অনুবাদ গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, বই আলোচনা, গীতি কবিতা এবং বিবিধ কিছু লেখা। প্রকাশিত হয়েছে আসছে বইমেলা উপলক্ষ্যে।
বিখ্যাতদের মধ্যে আছেন এ পি জে আবদুল কালাম, মাইকেল জ্যাকসন, এডলফ হিটলার, বেনিতো মুসোলিনি, বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামা, মাহাথির মোহাম্মদ, শেখ হাসিনা, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন, জীবনানন্দ দাশ, হুমায়ূন আহমেদ, তসলিমা নাসরিন, বিশ্বজিৎ সেন, ড. আশরাফ পিন্টু। এ পি জে আবদুল কালামের লেখা বরাবরই আকর্ষণীয়। মাইকেল জ্যাকসনের লেখায় বাচ্চা লালন-পালনের ভালো দিক-নির্দেশনা আছে : অন্যের জিনিশ না বলে না ধরা, পরোপকার, মিলেমিশে থাকা, বিশ্বাস...। মাহাথির মোহাম্মদ লিখেছেন বর্তমানে যে বৃদ্ধাশ্রম কালচার শুরু হয়েছে এটা তাদের সংস্কৃতির অংশ নয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একজন কবি। তার লেখায় মুনশিয়ানা আছে। তসলিমা নাসরিন মায়ের কথা বলতে গিয়ে তার বাবার কাছ থেকে কীভাবে তার মা বঞ্চিত হয়েছেন তা বলেছেন।
ছড়া-কবিতার অংশটা বেশ বড়। ৫ ভাগে দেয়া হয়েছে ছড়া-কবিতা। শাহ মুহম্মদ সগীর থেকে শুরু করে বর্তমানের তরুণতম কবিদের ছড়া-কবিতা আছে এতে। কিছু কবিতা পড়ে তো থমকে যেতে হয়েছে, হৃদয়টা কেঁপে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ সুনীল এবং শুভ দাসগুপ্তের কবিতার কথা বলা যায়। একটাতে বেশ্যালয় থেকে এক মেয়ে তার মাকে বলছে, আরেকটাতে বৃদ্ধাশ্রম মা তার ছেলেকে বলছেন। দুটো কবিতাতেই পাঠক একাকার হয়ে যাবেন কবিতার সাথে। হুমায়ুন আজাদ এবং আবদুল হাই শিকদারের কবিতায়ও অনুভূতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দারুণভাবে। তবে খালেক বিন জয়েনউদদীনের মাতৃভূমি বিষয়ক কবিতাকে কেন মা বিষয়ক কবিতা হিশাবে গণ্য করা হলো বুঝলাম না। একই কথা সুকুমার রায়ের কবিতার বেলায়।
অনুবাদ কবিতার সংখ্যা একেবারেই কম : মাত্র তিনটি। এটা আরো বাড়ানো যেতো কি না সম্পাদকের কাছে প্রশ্ন রইলো।
গল্প আছে মোট ১২টি। শাহেদ আলীর গল্প তো সব সময়ই শ্রেষ্ঠ। আর একই সমতলে তার শ্রেষ্ঠ গল্পের একটা। তবে তরুণ লেখকদের যে সব গল্প দেয়া হয়েছে সেগুলোর দু-একটাকে কোনোভাবেই গল্পের ফ্রেমে ফেলা যায় না।
অনুবাদ গল্প আছে ৪টি। চারটিই অসাধারণ। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন, ম্যাক্সিম গোর্কি, মাৎসুও বাশো এবং কুদরতুল্লাহ শাহাব রয়েছেন এ তালিকায়।
ছড়া-কবিতার তুলনায় গীতি কবিতার সংখ্যাও নেহাৎই কম। মায়ের গান নিয়ে তো অনেক আগে পুরো একটা অ্যালবামই হয়েছিলো। এর বাইরে মাকে নিয়ে অসংখ্য বাংলা গান আছে। এ দিকটাতে সম্পাদক নজর কম দিয়েছেন বলেই মনে হলো।
প্রবন্ধ-নিবন্ধে বৈচিত্র্য আছে। নির্ঝর আহমেদ প্লাবন মায়ের সাথে আবেগকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কোরআন-হাদিসের রেফারেন্সে সমৃদ্ধ লেখা অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইউনুছের। সাফওয়া জেরিন এবং মাহফুজা শিরিন সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টি থেকে তাদের লেখাগুলো লিখেছেন। যে সব মা সন্তানের উপরে জোর খাটাতে যান তাদের বিষয় উঠে এসেছে তাদের লেখায়।
বিবিধের তালিকায় বৃদ্ধাশ্রম থেকে ছেলের কাছে এক মায়ের লেখা চিঠি, যাতে তিনি তার ছেলেকে বলেছেন তার নাকফুলটা বিক্রি করে তার দাফনের ব্যবস্থা করতে, হয়তো যে সব কুলাঙ্গার মা-বাবাকে অবহেলা করে তাদেরকে কিছুটা হলেও নাড়া দিতে পারবে।
৪৩২ পৃষ্ঠার সংকলনো ১৬৩ পৃষ্ঠাই খেয়ে ফেলেছে ছড়া-কবিতা। বাড়া উচিত ছিলো গল্পের সংখ্যা। একটা বিষয়ের অভাব দারুণভাবে বোধ করেছি। সেটা হচ্ছে সাক্ষাৎকার। মাকে নিয়ে সংকলন, কিন্তু তাতে মায়েদের নিজেদের কথা নেই। সাক্ষাৎকারে সেটা উঠে আসতো। বিখ্যাতদের মা, প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি, শ্রমজীবী মা এ রকম নানান পেশা ও অবস্থানের মায়েদের সাক্ষাৎকার নেয়া যেতো। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে একটা ভারসাম্য আসবে, সংকলনও আরো ভারী হবে।
সর্বোপরি কথা হলো বাংলা সাহিত্যে এটা একটা অসাধারণ কাজ হয়েছে। ধন্যবাদ সম্পাদককে, ধন্যবাদ প্রকাশককে। প্রত্যেকের সংগ্রহে থাকার মতো একটি সংকলন এটি। বহুল প্রচার কামনা করছি।
ইনভেলাপ পাবলিকেশন্স মা
জগলুল হায়দার সম্পাদিত
প্রকাশক : ইনভেলাপ পাবলিকেশন্স
মূল্য : ৬৭৫
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৩