আজ সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টি। বিকেল থেকে বৃষ্টিতে ভিজছি। কখনো দাঁড়িয়ে থেকেছি চোখ ধাঁধানো শপিং মলের বারান্দায়, কখনো ভিজে যাওয়া সিগারেট বের করে তাতে আগুন ধরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছি। আজ মন ভাল নেই। যখন মন ভাল ছিল তখন আজকের এই মন খারাপের দিনটির কথা ভুলে ছিলাম। কেউ কেউ এমন থাকেই মন খারাপ যাকে ছেড়ে যায় না কখনো। ভেবে দেখেছি শুধু ভালবাসাই নয়, যে কোন শুদ্ধ অনুভূতির কোন মুল্য নেই এখানে। প্রতিনিয়ত ধাক্কা খাওয়া। রোদ সামলে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বৃষ্টিতে ভিজে যায় মন; তার কোন নিয়ম নেই। নিয়ম নেই এই জীবন প্রবাহের। হাত বাড়িয়ে দাও এবং জেনে রেখো সেখানে কেউ হাত রাখবে না, রাখবে তো এক দলা থুথু অথবা কর্দমাক্ত ভালবাসা।
আমি কোন যুক্তিতে যেতে চাই না আর। কোন সমাধানে যেতে চাই না। আমি চাই না আর কোন নতুন স্বপ্ন দেখতে। স্বপ্ন তারাই দেখে যাদের অজস্র ভাল থাকার দিন আছে, ছিল। আমি অবাক হচ্ছি, নিজেকে বোঝানোর জন্যে যথেষ্ট যুক্তি আমি এখনো বহন করে চলেছি। একজন খুনিও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়। হ্যাঁ, আমি খুনি। আমি নিজেকে খুন করেছি। আর যখন বুঝে গেছি কখনো নিজেকে আর নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করবো না তখন অবাক হচ্ছি নিজের দুর্বল সত্ত্বার কথা ভেবে। স্বপ্ন বড় বেশি প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে মানুষের জীবনে। কি হতো স্বপ্ন আর মানুষ নামের জীবটিকে আলাদা ভাবে, সম্পূর্ণ ভিন্ন করে, পরস্পর থেকে অনেক দূরে; যেখানে এই দুই অকল্পনীয় বন্ধু যুগলের দেখা হবার সম্ভবনা নেই এমন কোন দূরত্বে রেখে দিলে! হয় না এসব হয়তো, তবে সে সব হয় সেখানে যেখানে মন ভাঙ্গার কারিগর নিত্য নতুন মন ভাঙ্গে, গড়ে, স্বপ্ন দেখায় আবার পুনরায় দেদারছে ভেঙ্গে ফেলে।
মাথাটা আজকে নষ্ট হয়ে যাক। এই অকেজো মাথা দিয়ে সৃষ্টিশীল কিছু সৃষ্টি হয়নি। ভেক ধরা এই নগরে শুদ্ধ চিন্তার যেমন মুল্য নেই যেমন ঠিক তেমনই অনুর্বল মস্তিস্ক দিয়ে মন ভাঙ্গার কারিগরকে কাজে লাগান ছাড়া আর কিছুই হবার নয়।
বারের লম্বা টুলে বসে আছি। তিন পেগ হুইস্কি খেয়েছি। গাঁজা হলে বেশ হতো। এইসব অত্যাধুনিক এলকোহল ঠিক নেশায় ডুবাতে পারে না। দেশীয় দ্রব্য যতটাই নগন্য হোক না কেন তা আমার কাছে আপন সত্ত্বার মতোন। আমি ভেসে যেতে অভ্যস্ত। আমি অভ্যস্ত রোদেলা তোমার চোখের মায়ায় হারিয়ে যেতে। শিট, আবার আমি ফিরে যাচ্ছি অতীত হয়ে যাওয়া সময়ের ফাঁদে।
''কি ছিল তোমার? তুমি যেসব কথা আমাকে বলেছ, অবশ্যই তোমার ভাষায় ভালোবাসার কথা, সে সব অসংখ্য বার শোনা হয়ে গেছে আমার। তুমি কাল কি বলবে তা আমি ভাল করেই জানি। সো এইসব আমাকে আর বলবে না। আমি টায়ার্ড হয়ে গেছি এই সব প্রেম ভালোবাসার নানা রঙের কথা শুনতে শুনতে। সবাই ফেইক। এমনকি তুমিও।''
ছোটবেলায় মনে হতো যদি এমন কোন ইন্সট্রুমেন্ট থাকতো যা দিয়ে মনের কথা সহজেই বোঝানো যেত তাহলে এতো দীর্ঘ সময় ধরে চোর পুলিশ খেলার প্রয়োজন পড়তো না। কে ভাল, কে নির্দোষ তা খুব সহজেই বের করা যেত। আর নির্দোষ মানুষ স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণায় পড়তো না বারবার। রোদেলা আমার যদি এই ইন্সট্রুমেন্ট থাকতো তবে তোমার সামনে মেলে ধরতাম। তুমি দেখতে তোমার এই অবিশ্বাসী দৃষ্টি ভঙ্গী আমার ক্ষেত্রে ঠিক মিলবে না। তুমি মানুষ বাছাই করতে পারো নি হয়তো। হয়তো আমি বুঝতে পারিনি যে কথা আমি পবিত্র ভেবে নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলাম শুদ্ধ আবেশে, সে সব কথা অন্য কেউ তোমাকে অথবা আরো অসংখ্য ভালোবাসিয়েদের বলে সুযোগ নিয়ে ফেলেছে। আমি জানিনি। আমি বুঝিনি ভালবাসা এখন রাস্তার ফেরিওয়ালার কাছে খুব কম মুল্যে পাওয়া যায়। আজকে তোমার কথার যথার্থ জবাব দেয়ার একটা মাত্র পথই খোলা ছিল, মাইন্ড রিডিং ইন্সট্রুমেন্ট।
তোমার চলে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না আমার। ভয় পেয়েছিলাম খুব, যদি পেছন থেকে আমার ডেকে ওঠা কথা শুনে তুমি বলে ফেলো, এইসবও অনেক শুনেছি আমি। প্লিজ আমাকে আর এইসব বলবে না।
আমি ডাকিনি। আর ডাকব না কাউকেই। আমি আর নিজেকেও ডাকব না। তোমাকে অসংখ্য ঠোঁটে ঠোঁট রাখা মেয়ে মানতে চাইনি আমি। নিজের মতো তোমাকে শুদ্ধ করে নিতে চেয়েছিলাম। বুঝিনি, তোমরা কখনো ফেরো না। কারো বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরো না। তোমরা এভাবেই হেসে খেলে মানুষ ভুলিয়ে রসালো ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আবেগের ফুল ঝরাও। ফুল ঝড়িয়ে যাবে হয়তো ততদিন যতদিন সে ঠোঁটে বিকেল না পোরে। আর শ্রীকান্ত নামের অমানুষগুলো বোকা বোকা দুর্বল শব্দে ভালবাসা জানাতে জানাতে হয়তো তাদের ভালবাসা জানানোর আর কিছুই থাকবে না। ততদিনে যে অনেক ফেইক ভালবাসা ডানা গজিয়ে আবিষ্কার করে ফেলবে আবিষ্কৃত না হওয়া প্রেমের গায়ের যাবতীয় কালো কালো তিল।
হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলাম এক পেগ স্কচ। যেন এক গ্লাস নীল বিষ। সব বিষেই আজ মন ভরাবো; হোক তা লাল অথবা নীল। বিষ কে তুলে দিল হাতে? ও হ্যাঁ, রুদ্র। লম্বা ছিপছিপে ছেলেটার চোখে ঘৃণা দেখছি। তবে আমাকে কেন? এই ঘৃণা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাও। আমাকে শুধু বিষ দাও। ঘৃণা আর গ্রহণ করতে পাড়ব না।
''নিকোটিন? আপনার কাছে সিগারেট নেই? কাউকে ড্রিংকস অফার করলে সাথে স্মোকও অফার করতে হয়। জানেন না?''
নির্লিপ্ত রুদ্র সিগারেট এগিয়ে দিল। ঘৃণার আবরণ খুলে বলে উঠল, ''আপনার কি মন খারাপ?''
''মন? জানি না তো?''
যে ঠোঁট পুড়েছে সিগারেটের আগুনে
আর যে ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বনেও বসন্ত হাসে না
আক্ষরিক অর্থে সে সব যৌথ ঠোঁট বিষাক্ত হলেও
জেনে রেখো তুমি ঠোঁটের পতিতালয় গড়েছ
আর আমি সিগারেটে প্রতিবার ভালবেসেই ঠোঁট ছোঁয়াই।
''এই সেরেছে। কবি নাকি আপনি?''
রুদ্র গতানুগতিকতার বাইরে যেতে পারেনি এখনো। নিশ্চয়ই আজকের পর নতুন স্বপ্নে বিভোর হবে সে।
ঝরঝরে গলায় বলতে ইচ্ছে হল “এই রঙ্গমঞ্চে আমরা সবাই কবি। আমি হলাম সদ্য বৈধব্যপ্রাপ্ত কবি শ্রীকান্ত আপনি কবি রুদ্রপ্রতাপ।”
পৃথিবী দুলছে। আমি দুলছি, রুদ্র দুলছে। বারের লাল নীল আলো দুলছে আর ঐ কর্ণারে বসে রোদেলা নতুন কারো কাছে প্রেমের গল্প শুনছে। গলা দিয়ে বেড়িয়ে এলো একদলা কষ্ট। রুদ্র ছিল বিধায় শারীরিক কষ্ট শিথিল হতে পেরেছে।
চোখে ধোঁয়া ভাসছে। নতুন আহ্বান। অগ্রাজ্য করি কি করে? মদিরা?
হা হা হা। “ঐ মেয়েটাকে দেখছো? তার কিন্তু অনুভূতি নেই। পেটে যন্ত্রণা থাকলে অনুভূতিরা পালায়।
সুদীপ্তর লিঙ্ক
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৩:৩০