সুরজিতের মনে হল একফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। হ্যাঁ, বৃষ্টিই তো! এইতো জারুল গাছটার নিচে ছোট লজ্জাবতীর পাতার উপর একফোঁটা বৃষ্টি জমে আছে। টলটলে ফোঁটাটা সদ্যজাত। ধুলায় ধূসরিত লজ্জাবতীর পাতায় নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। এই বুঝি পড়ে যাবে। মাটিতে গিয়ে মিশে যাবে চিরতরে। যখন বৃষ্টি ফোঁটাটা মাটিতে পড়বে ঠিক তখনই সুরজিতের মনে হল সত্যি বৃষ্টি পড়ছে। এক ফোঁটা বৃষ্টি তার বা হাতের কব্জিতে পড়েছে। এইতো সেই বৃষ্টি।
বৃষ্টির কথা মনে হলে সুরজিতের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে খুব। বৃষ্টি শুরু হলে তাকে ঘরে ধরে রাখা যেত না কখনো। ঝড়ে পড়ে থাকা আম কুড়াতে গিয়ে একদিন তার মনে হল হয়তো মানুষের জীবনটাই এমন। অপেক্ষা করে ঝড়ে যাওয়ার জন্য। এভাবেই সে চিঠি লিখেছিল বালিকাকে। স্কুল পেড়োনো বালিকাটি প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখত সুরজিতকে। বালিকা ঝড়ে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হতে পারেনি। তার যুক্তি শুধু ঝড়ে যাওয়া কেন, ঝড়ে যাওয়ার পূর্বে জীবনটা কি অনেক সুখের নয়? সুরজিত মেনে নিয়েছিল বালিকার কথা, মনে নিয়েছিল কি না তা জানি না তবে সে খুব সুন্দর কবিতা লিখেছিল এ ঝড়ে যাওয়া নিয়ে। বালিকার তখন বেজায় রাগ সুরজিতের উপর। কেন সে ঝড়ে যাওয়া নিয়ে কবিতা লিখবে? সে কেন বালিকাকে নিয়ে কিছু লেখে না? বালিকা অপেক্ষায় থাকে।
সুরজিত গল্প লেখে। কবিতা লেখে। নাটক লেখে আর নাটক বানায়। মাঝে মাঝে অভিনয়ও করে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়তে পড়তে ভাবে একদিন সেও ট্রামের নিচে নিজেকে সঁপে দিবে। সেখানেই চির শান্তি। পথ চলতে চলতে সে পথের ধুলো বালির সাথে কথা বলে। দু হাত বাড়িয়ে মাটি ছুঁয়ে দেয়। আবার এ মাটির ওপর বসে থেকে কত কিছু ভাবে। লোকজন সুরজিতকে পাগল বলে। পিতৃ-মাতৃহীন সুরজিত খুব একটা মিশুক না। গ্রামের কারো আপদে বিপদে তাকে সচরাচর দেখা যায় না। তবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুরজিতের ঠিকই ডাক পড়ে। সে সানন্দে এসে মঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করে। তার দরাজ গলায় কবিতা শোনার পর শ্রোতারা কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে থাকে। যেন এক ধুমকেতু। প্রচন্ড গতিতে হৃদয়ে তোলপাড় করে দেয়। সাহিত্য মহলে তার বেশ সুনাম। স্থানীয় পত্রিকায় লেখালেখি করে। মাঝে মাঝে কারো অনুরোধে প্রচ্ছদও আঁকে। সবাই সুরজিতকে স্নেহ করে। সুরজিতের পারিশ্রমিক নিয়ে কেউ কখনো ভাবে না। এ নিয়ে সুরজিতেরও কোনো উচ্চ বাক্য নেই। দিন শেষে চালার ছোট্ট ঘরে গিয়ে রান্না করে। প্রতিদিনই একই খাবার। চাল, ডাল, আলু আর কখনো সবজি থাকলে তা দিয়ে খিচুরি রান্না। পূর্ণিমাতে উঠোনে বসে গান গায়- আমার গায়ে যতো দুঃখ সয়...। চাঁদ যেন তার সাথে কথা বলে। তারা গল্প করে রাত পার করে দেয়। সুরজিত কিছু কবিতা লিখে ফেলে ঝটপট। তারপর গিয়ে শুয়ে পড়ে। এমন সময় বৃষ্টির শব্দে তার ঘুম ভাঙ্গে। উঠোনে দাঁড়িয়ে সে বৃষ্টিতে ভেজে। তার দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ে। সে গেয়ে চলে- আমার গায়ে যতো দুঃখ সয়...।
সুরজিতের ’আলোক নাট্যদল’ নামে একটা নাটকের দল আছে। এ নাট্যদল নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। এ নাট্যদল দিয়ে কিছু সৃষ্টিশীল মানুষ গড়বে সে। তারা যেন জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে পারে এ তার আজীবনের স্বপ্ন। সুরজিতের আলোক নাট্যদলে নতুন পুরোনো অনেক মুখ। তাদের রিহার্সেলের ধ্বনিতে মুখরিত থাকে রাধাকৃষ্ণপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল প্রঙ্গন। জেলার সম্মিলিত নাট্যপরিষদের সদস্যভুক্ত মোট ১৮ টি নাট্য সংগঠনের মধ্যে ২ টি সংগঠন স্কুল ছুটির পর বিকেলে তাদের রিহার্সেল করে স্কুলের রুমে। স্কুলের একটি রুম বরাদ্দ দেয়ার জন্য জেলা সম্মিলিত নাট্যপরিষদের সহ-সভাপতি এবং সুরজিতের বাল্যবন্ধু শরিফুল্লাহ মতিনের কাছে বেশ ছোটাছুটি করতে হয়েছে তাকে। শরিফুল্লাহ মতিন রাধাকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের মেয়র। সুরজিতের বাল্যবন্ধু হলেও সুরজিতের সাথে শরিফুল্লাহ মতিনের সম্পর্ক খুব একটা ভাল না। বিভিন্ন ব্যবসা মতিনের। প্রবল প্রতিপত্তি। গ্রামের সবার কাছে ডাকাত মতিন হিসেবে পরিচিত। কথিত ডাকাতি মতিন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা মিলে করে তাদের পাশের গ্রমের সম্ভ্রন্ত খান সাহেবের বাড়িতে। টাকা পয়সা এবং সোনাদানা মিলে প্রায় ৫৭ লাখ টাকার সম্পদ তারা লুন্ঠন করে। ডাকাতি করে আসার সময় খান সাহেবকে খুন করে আসতে ভুলে না। সেই থেকে মতিনের প্রতিপত্তি বাড়লেও অজানা কথা গ্রমের কারো কাছে অজানা থাকে না। ধীরে ধীরে ডাকাত মতিন হিসেবে নামও জুটে যায় তার।
মতিনের এক কথা, দেখ সুরজিত আমরা একই সাথে খেলাধুলা করেছি। একই স্কুলে পড়েছি। তুই লেখাপড়ায় বেশ ছিলি। কোথায় চাকরি করবি তা না, নাটকের দল নিয়ে এ গাঁয়ে পড়ে আছিস।
সুরজিত বরাবরের মতো চুপচাপ শুনে যায়। কোনো কথা পছন্দ হলে মাঝে মাঝে মাথা নাড়ে।
মতিন আবার বলে, তোকে কবে থেকে বলছি ঐ ভিটে বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আয় ...
মতিনের কথা শেষ করতে দেয়নি সুরজিত। সে ঠিক জানে মতিন এবার কি বিষয়ে কথা বলবে। মতিনের হীন প্রস্তাব শোনার কোনো ইচ্ছে নেই সুরজিতের। তাই সে দেরি না করে কাজ আছে বলে দ্রুত বের হয়ে আসে মতিনের দোতলা বাড়ির কার্পেট মোড়ানো ড্রয়িং রুম থেকে।
সুরজিত ভেবেছিল স্কুলের ঘর বুঝি আর হল না। কিন্তু সুরজিতকে অবাক করে দিয়ে শরিফুল্লাহ মতিন সুরজিতকে চিঠি পাঠায়। জেলা সম্মিলিত নাট্যপরিষদের সভাপতির সিগনেচার করা চিঠিতে রাধাকৃষ্ণপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটা রুম আলোক নাট্যদলের জন্য স্কুল ছুটির পর নাটকের রিহার্সেলের কাজে ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার পর সুরজিত মতিনের প্রতি একটু নমনীয় হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় জেলা সম্মিলিত নাট্যপরিষদের আয়োজনে তিন দিন ব্যাপি নাট্য উৎসবে ‘আলোক নাট্যদল’ প্রদর্শিত ’শিখন্ডী কথা’র প্রদর্শনী নিয়ে। সবকিছু ঠিক ঠাক চলছিল। রিহার্সেলও শেষ পর্যায়ে কিন্তু উৎসবের আগের দিন সুরজিতকে জানানো হয় উৎসবে শিখন্ডী কথা প্রদর্শীত হবে না। যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে সুরজিতের মাথায়। হতাস সুরজিত কি করবে ভেবে পায় না। সে দ্বারস্ত হয় শরিফুল্লাহ মতিনের কাছে। এবার মতিনের রুদ্রমূর্তি দেখে সুরজিত।
মতিনের সাফ কথা, সমাজের হিজরা সম্প্রদায় নিয়ে আবার কিসের নাটক? নাটকের মতো জায়গায় তাদের কথা তুলে ধরে তুই কি এ উৎসবের সম্মান নষ্ট করতে চাস?
মতিনের বেহিসেবি কথা শোনার পর সুরজিত প্রচন্ড রাগে ফুঁসতে থাকে। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারে না। শুধু মতিনের অফিস থেকে বের হয়ে আসার সময় খুব শান্ত ভাবে সুরজিত বলে- তোর মতো ডাকাত নাটকের আর কিইবা বোঝে! খুনিরা কখনো সংস্কৃতি ধারন করে না।
চিরচেনা শান্ত ভীরু সুরজিতের দ্বারা নিজের অঙ্গাত পরিচয় সবার সামনে উন্মোচিত হয়ে যাওয়ায় মতিন রাগ সামলাতে না পেরে টেবিলে রাখা পানি ভর্তি গ্লাসে ডান হাত দিয়ে জোরে ধাক্কা মারে। দেয়ালে বাঁধা পেয়ে গ্লাস ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে যায়। মতিনের একান্ত সহকারি, তার অনেক দুঃস্কর্মের সাক্ষী রুস্তম মতিনের কাঁধে হাত রাখে। ইশারা পেয়ে মতিন অফিস রুম থেকে বের হয়। মতিনকে অফিস সংলগ্ন তাদের ছোট্ট গোপন কক্ষে নিয়ে যায় রুস্তম। মতিনের তীব্র লাল চোখের দিকে তাকিয়ে রুস্তম শান্ত গলায় বলে, মতিন ভাই আপনার না একটা ইট ভাটা করার কথা ছিল রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামে? ঐ যে সুরজিতের বাড়িটার জন্য ভাটার কাজ এগুতে পারছে না। আপনার এতো বড় জমির মাঝে সুরজিতের ঘর। ঐ ঘরটা না থাকলে আপনি অনায়াসে ভাটার কাজ শুরু করতে পারতেন।
ক্রোধের প্রথম ধাপ পেরিয়ে মতিন এখন দ্বিতীয় ধাপে। তার কথা গুলিয়ে যাচ্ছে। একটা শব্দ আর একটা শব্দের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। সে কোনো ভাবে বলে, ঐ সুরজিতের জন্যই তো হচ্ছে না। বেটার বড় বড় কথা। ইট ভাটা বানালে না কি পরিবেশের ক্ষতি হয়। আহম্মক কোথাকার!
রুস্তম বলে, মতিন ভাই চাক্কু জুলফা বলছিল সে অনেক দিন বেকার বসে আছে। আফটারঅল সে তো আপনারই গোলাম। আমি কি তাকে আপনার ইট ভাটার জায়গা ক্লিয়ার করে দিতে বলব?
শরিফুল্লাহ মতিনের চোখ লাল। বড় বড় চোখ নিয়ে সে রুস্তমের দিকে তাকিয়ে আছে। যে কোনো মুহ’র্তে রুস্তম অনুমতি পেয়ে যেতে পারে। সাথে চাক্কু জুলফার বেকারত্বও ঘুচবে। শরিফুল্লাহ মতিন অনুমতি দেয়।
২.
নাট্য উৎসবের আজ প্রথম দিন। সুরজিতের আলোক নাট্যদল উৎসব থেকে বাদ পড়েছে। সুরজিতের আজ মনটা খুব খারাপ। রাস্তায় এলোমেলো ভাবে হাঁটছে আর বৃষ্টি পতনের অপেক্ষা করছে। একফোঁটা বৃষ্টি সুরজিতের ঠিক চোখের কোণে পড়ল। সুরজিত ডান হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল মুছল। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছে। এখন পর্যন্ত কিছু খাওয়া হয়নি। দিন শেষে টের পায় খুদার উপস্থিতি। কোনো রেস্টুরেন্টে খাবার মতো টাকা সুরজিতের পকেটে নেই। পকেটে বারবার হাত দিয়ে খুঁজে দেখল যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়। তখনই তার মনে হল ‘দৈনিক তিস্তা’ র সম্পাদক জনাব মুশফিকুর রহমান তাকে দেখা করতে বলেছিলেন। বালিকাকে নিয়ে সুরজিত প্রথম একটা কবিতা লিখেছিল। ভয়ে ভয়ে সেটা দৈনিক তিস্তায় পাঠায়। পরদিনই কবিতাটা ছাপা হয়। বালিকাকে দেবার মতো অবশেষে একটা কবিতা সে লিখেছে। পত্রিকা যদি আজ পোস্ট করি তাহলে তিন দিন পর নিশ্চই বালিকা কবিতাটা পাবে। এই চিন্তা করে সুরজিত দৈনিক তিস্তা’ র অফিসে যায়।
সম্পাদক সাহেব খুবই অমায়িক মানুষ। পঞ্চাশোর্ধ টাক মাথার মানুষটিকে কোনো পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে মনে হয় না সুরজিতের। সুরজিতের মনে হয় মুশফিকুর রহমান কোনো ধর্ম প্রচারক। খুব স্মিত হাসেন। পরিমিত কথা বলেন। সবসময় একটা পবিত্র ভাব বজায় থাকে মুশফিকুর রহমানের মুখে। মুশফিকুর রহমানের ব্যবহারে মুগ্ধ সুরজিতের হঠাৎ শরিফুল্লাহ মতিনের কথা মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে একটা তেতো অনুভ’তি সুরজিতের গা গুলিয়ে দেয়। সে মতিনের কথা ভাবতে চায় না।
মুশফিকুর রহমান অনেকক্ষণ ধরে সুরজিতের সাথে গল্প করলেন। চা খাওয়ালেন এবং আসার সময় সুরজিতকে দুই কপি পত্রিকার সাথে মুখ বন্ধ একটা খাম ধরিয়ে দেন।
রাত তখন ১১ টা। টিপটিপ বৃষ্টি থেমে গেছে ভর বিকেলে। আকাশে মেঘ জমেছে। চাঁদের আলোর বিন্দু মাত্র ছিটেফোঁটা নেই। চৌরাস্তার মোড় পেরিয়ে সুরজিত উঠে পড়ে পশ্চিম দিক লাগোয়া ছোট্ট রাস্তার মোড়ে। রাস্তা আজ একেবারে ফাঁকা। কোথাও জন মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই। প্রফেসর পাড়াটা অনেক উন্নত। বেশ কিছু সুন্দর দোতলা তিনতলা বাড়ি। প্রফেসর পাড়ার শেষ প্রান্তের অপ্রসস্ত রাস্তা পেরোলেই হঠাৎ এক ঘন অন্ধকার গ্রাস করে সুরজিতকে। এখান থেকেই রাধাকৃষ্ণপুর গ্রমের শুরু। তাকে যেতে হবে আরো তিন কিলোমিটার। ভাঙ্গা কাঁচা রাস্তার দু পাশে বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত। হঠাৎ দু একটা ঘর চোখে পড়ে। রোজ এ পথ ধরেই সুরজিত বাড়ি ফেরে। পথিমধ্যে রাধাকৃষ্ণপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের কাছাকাছি এসে সুরজিত থমকে দাঁড়ায়। তার নাটকের রিহার্সেলের শব্দ সে শুনতে পায়। স্কুলের বারান্দায় একটা ৪০ ওয়াটের বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। স্কুলের অফিস ঘরের বারান্দায় দুটো কুকুর গুটি শুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। কোথাও কেউ নেই অথচ সুরজিত স্পষ্ট শুনলো কে যেন কথা বলছে। সুরজিত পেছনে তাকায়। আর এমন সময় মুখোশ পড়া ভয়ানক শক্তির এক মানুষ সুরজিতের সামনে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে উঠার আগে কে যেন পেছন থেকে সুরজিতের কিডনী বরাবর চাকু চালিয়ে দেয়। সামনের জন দু হাত চেপে ধরে সুরজিতের আর পেছনের জন অনায়াসে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় সুরজিতের নিম্নাংশ। রক্তাক্ত চাকু ঘুরাতে ঘুরাতে চলে যায় দুজন অচেনা মানুষ।
সুরজিত দু হাতে পেট চেপে ধরে। দাঁড়াতে পারছে না। চিৎকার করতে গিয়ে বুঝতে পারে তার মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছে না। শুধু গোঙ্গানির মতো একটা আওয়াজ। সুরজিত পড়ে যায় মাটির ওপর। আর তখনই অর্ধ চাঁদ মুখ তুলে তাকায় মেঘের আড়াল থেকে। সুরজিত তাকিয়ে দেখে স্কুলের সাথে বিশাল এক কদম গাছের নিচে সে পড়ে আছে। মনে পড়ে যায় তার ছোটবেলার কথা। একদিন স্কুল থেকে বাড়িতে ফেরার সময় দেখতে পায় স্কুলের সাথে ঝোপের ভিতর নতুন একটা চারা গাছ। জন্জাল সরিয়ে প্রতিনিয়ত সে গাছটার যত্ন করেছে। বেড়া লাগিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিন পানি দিয়েছে গাছের গোড়ায়। এক অদৃশ্য ভাললাগায় সুরজিতকে বেঁধে রেখেছিল কদম গাছ। গাছটি আস্তে আস্তে বড় হয়। প্রতি বর্ষায় ফুল ধরে। সুরজিত তাকিয়ে দেখে কত দ্রুত গাছটি বড় হয়ে গেছে। নাটকের রিহার্সেলের ফাঁকে সুরজিত কদম তলায় গিয়ে বসে থাকত। দু হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইতো গাছটাকে। যেন কত আপন! দু হাতে জড়িয়ে ধরে সে বুঝতে চাইতো গাছের কথা। গাছের যন্ত্রণার কথা। কদমের ছায়ায় বসে সুরজিত কত কবিতা লিখেছে! বালিকাকে নিয়ে লেখা কবিতাও এ কদমের ছায়ায় বসে লেখা। হয়তো কবিতা বালিকা পেলেও কবিকে কখনো পাবে না।
সুরজিত উঠতে চেষ্টা করে। পারে না। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ঘাসে জমে থাকা রক্ত সুরজিতের চোখে মুখে লেগে আছে। সে দুচোখ মেলে কদম গাছটাকে আর একবার দেখার চেষ্টা করে। সবকিছু ঘোলা লাগে। সে কিছুই দেখতে পারে না। তার শুধু মনে হয় খুব ছোটবেলায় মারা যাওয়া মার কথা। যেন তার মা দাঁড়িয়ে আছেন আর বলছেন তোর কোনো কষ্ট হতে দেব না খোকা! আমি তো আছিই।
মারা যাওয়ার পুর্ব মুগূর্তে সুরজিতের মুখ থেকে বের হওয়া শেষ উচ্চারন ছিল-আহ...
শব্দটি চরম যন্ত্রণা না কি পরম প্রশান্তি থেকে উৎসারিত, তা জানা যায় নাই।
আহ গল্পে বর্ণিত চরিত্র, স্থান, ঘটনা প্রবাহ চলমান নাগরিক জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। তবে কারো বাস্তব জীবনের সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ি হবেন না। আমি গল্পে আনন জামান রচিত ’শিখন্ডী কথা’ নাটকের কথা উল্লেখ করেছি। এ নাটকের জন্য আনন জামানকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
গল্পটি নিচের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত। বন বিষয়ক হরেক স্বাদের লেখার মাঝে আমার এই আহ... গল্পটাও ঠাঁই পেয়েছে।
এই ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আমারও ভূমিকা আছে। প্রচ্ছদটা কেমন, জানাবেন।