বছরকয়েক আগে এক তুমুল বর্ষার দিনে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে হাজির হয়েছিলাম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে তুলনামূলকভাবে নতুন কলাতলী বিচে নামি যখন, সেখানে তখন আমরা ছাড়া আর মাত্র ৫-৬ জন পর্যটক উপস্থিত ছিলেন। অফ-সিজনে কক্সবাজারে বেড়ানোর ওই স্মৃতি এখনও আমাদের মনে পড়ে। বেড়াতে ও অন্যান্য কাজে বেশ কয়েকবার কক্সবাজার যাওয়া হয়েছে, কিন্তু সেই ভ্রমণে যে আনন্দ করেছিলাম আমরা, তার সঙ্গে অন্য ভ্রমণগুলোর তুলনা করা দায়। সেই স্মৃতির কথা মনে রেখে এবারও দিন কয়েক আগে ঘুরে এলাম কক্সবাজার থেকে। বলতে দ্বিধা নেই, অফ-সিজনে কক্সবাজারে বেড়ানোর আনন্দ একেবারেই অন্যরকম। অন-সিজনে পাওয়া সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে তুলনা করলে অফ-সিজনে বেড়ানো রীতিমতো ঈর্ষণীয়।
বছর পনের আগেও দেশে পর্যটনের যে বেহাল অবস্থা ছিল, সেটি সম্ভবত অনেকটাই কাটিয়ে উঠা গেছে। তবে সেটা সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে যতোটা না, তার চেয়ে বেশি পর্যটকের সংখ্যার দিক থেকে। পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দিক দিয়ে অবস্থা আগের মতোই রয়ে গেছে। অন্যদিকে পর্যটকের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন পর্যটন মন্ত্রী জি এম কাদের বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কতোটুকু কী করলেন তা জানার উপায় নেই। কোনো দৃশ্যমান উন্নতি এখনও নজরে আসে নি। বরং তুলনা করলে দেখা যাবে অনেকক্ষেত্রে পর্যটনের বেহাল অবস্থা হয়েছে- বিশেষত যাতায়াতের দিক দিয়ে। আগে কক্সবাজারে যেখানে ঢাকা থেকে ৮-৯ ঘণ্টায় যাওয়া যেত, এখন সেখানে গড়ে ১২-১৪ ঘণ্টা সময় লাগে। এটি খুবই আশ্চর্যজনক যে, এসব সীমাবদ্ধতার মাঝখানেও দেশীয় বা অভ্যন্তরীণ পর্যটক-সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। ঈদের বন্ধে কক্সবাজার-কুয়াকাটা-জাফলং-সেন্টমার্টিন ইত্যাদি জনপ্রিয় পর্যটন ক্ষেত্রগুলোতে মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। হোটেল-রিসোর্টে জায়গা না পেয়ে মানুষজনকে ভাড়া করা গাড়িতেও ঘুমাতে দেখা যায়। এই চিত্রই বলে দেয়, দেশের মানুষের মধ্যে বেড়ানোর আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আগ্রহটি ধরে রাখতে না পারলে পর্যটন ব্যবসায় এখন যে আপাতঃরমরমা অবস্থা বিরাজ করছে, সেখানে ধ্বস নামতে পারে।
পর্যটক সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার যে কথাগুলো উপরে বলা হলো, সেগুলো কিন্তু অন-সিজনের কথা মাথায় রেখে। কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে আমাদের দেশের মানুষজন শীত বা শীতের আশেপাশের সময়টাকেই বেড়ানোর উপযুক্ত বলে ধরে নেয়। অথচ আমাদের দেশের যে আবহাওয়া, তাতে চাইলে কিন্তু বছরের যে কোনো সময়ই বেড়ানো যায়। অনেকে বলেন, গরমের সময় বেড়ানোতে ঝামেলা, বৃষ্টির উৎপাতে বেড়ানো মুশকিল ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হলো এবং এদেশে পর্যটনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানকার আবহাওয়া এতোটা চরমভাবাপন্ন নয় যে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বেড়ানো বন্ধ করে দিতে হবে। ভারতের নয়া দিল্লি কিংবা আগ্রায় জুন-জুলাই মাসে প্রচণ্ড গরম পড়ে, রাজস্থানের মরুভূমির লু হাওয়া রীতিমতো তাঁতিয়ে দেয়। অন্যদিকে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কাশ্মীরের পাহাড় থেকে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাসে মারাত্মক শীতে রাস্তায় বেরুনোই দায়। এই অবস্থায়ও সেদেশের এবং অন্য দেশের লাখ লাখ মানুষ আগ্রার তাজমহল কিংবা আগ্রা ফোর্ট দেখতে যায়। ওখানকার মতো এরকম চরম আবহাওয়া আমাদের মোকাবিলা করতে হয় না। পুরো বছরটিই কিন্তু আমাদের জন্য অন-সিজন হতে পারে।
অফ এবং অন সিজনের এই তুলনামূলক আলোচনার কারণ হলো, বাংলাদেশের পর্যটন স্পটগুলোতে অন সিজনে যে পরিমাণ মানুষের আনাগোনা ঘটে, অফ সিজন সেই তুলনায় একেবারেই খালি থাকে। এবারে কক্সবাজারে গিয়ে এ উপলব্ধিটিই আরও দৃঢ় হলো যে, অদৃশ্য বা অজানা যে কারণে আমরা অফ-সিজনে বেড়াতে যাই না, সেই কারণটি (যদি আদৌ সেরকম কোনো কারণ থেকে থাকে) একেবারেই মূল্যহীন। এদেশে ছয়টি ঋতু। একেক ঋতুর আবেদন ও বৈশিষ্ট্য একেকরকম। যিনি প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে চান, বেড়ানোর পাশাপাশি প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো দেখতে চান, তিনি সব ঋতুতেই বেড়াতে পারেন। একজন খাঁটি পর্যটকের কাছে অফ বা অন-সিজন বলে কিছু নেই। একেক ঋতুতে প্রকৃতি একেকরকম, বেড়ানো একেকরকম। একজন পর্যটকের কাছে তো এটাই আকর্ষণীয় হওয়ার কথা!
তারপরও অফ-সিজন আমাদের দেশে বাস্তবতা! দেশের পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকদের আসা-যাওয়ার সংখ্যা হিসেব করে বছরের কয়েকটি মাসকে অফ-সিজন বলে ঘোষণা করে। সে সময় হোটেল-রিসোর্টের ভাড়া ৪০ থেকে ৮০ ভাগ পর্যন্ত কমে যায়। পর্যটন স্পটগুলোর রেস্তোরাঁতেও খাবারের দামে হেরফের হয়। যাতায়াতের বাহনে ভাড়া কিছুটা হলেও কমে। কমে পর্যটকদের জন্য গড়ে ওঠা সারি সারি দোকানের পোশাক-ঝিনুক-শামুকের দাম। অন-সিজনে গেলে যাওয়া-আসা-থাকা-খাওয়ার জন্য যে খরচ হয়, অফ-সিজনে সেটা নেমে আসে প্রায় অর্ধেকের কোটায়, ক্ষেত্রবিশেষে এক-তৃতীয়াংশেও। কিছুদিন আগে কক্সবাজারে যে হোটেলের কক্ষে আমরা থেকে এসেছি, অন-সিজনে সেটির প্রতি রাতের ভাড়া ৩৬০০ টাকা। কিন্তু অফ-সিজন বলে এই একই ভাড়া দিয়ে আমরা থাকলাম একদিনের বদলে তিন দিন। অনেক হোটেল এর চেয়েও বেশি ছাড় দিচ্ছে। কক্সবাজার থেকে ইনানি বিচে যাওয়া-আসা করতে হলে অন-সিজনে চারজন মানুষের খরচ হয় ৮০০-১০০০ টাকা। আমরা পাঁচশ টাকার মধ্যেই সে কাজটি করে ফেললাম। এই তথ্যগুলো দেয়ার একটাই উদ্দেশ্য- অফ-সিজনে বেড়াতে গেলে খরচ কম হয়; আরামে বেড়ানো যায়। প্রায় একই সময় সিলেটের জাফলং, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, সুন্দরবন এবং রাজশাহী থেকে বেরিয়ে আসা পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে প্রায় একই তথ্য জানা গেল। যেখানে খরচ কমানোর অপশন নেই, সেখানে কোলাহলমুক্ত আরামে বেড়ানোর সুবিধাটা অন্তত পাওয়া যায়।
অবশ্য অফ-সিজনে বেড়ানোর কিছুটা অসুবিধেও রয়েছে। সাধারণত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে দিকে সন্তানদের পড়ালেখার চাপ কম থাকে। চাকুরিজীবিদের অনেকেও কিছুটা নির্ভার অব্স্থায় অফিস করতে পারেন। এদেশে মূল পর্যটক বোধহয় এই চাকুরিজীবি মধ্যবিত্ত মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই বছরের অন্য সময়গুলোতে তারা সময় বের করতে পারে না। কিন্তু শুক্র-শনিবারের ছুটির সঙ্গে আর এক-দুইদিন ছুটি নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসা খুব একটা কঠিন ব্যাপার বলে মনে হয় না। তাছাড়া সবসময় কক্সবাজার-কুয়াকাটা-সেন্টমার্টিনেই কেন যেতে হবে? আজকাল ছোটখাটো হলেও প্রায় প্রতিটি জেলাতেই কিছু না কিছু পর্যটন স্পট গড়ে উঠছে। সেগুলোতে যাওয়া যেতে পারে। তাতে স্থানীয় পর্যটনও উৎসাহিত হবে। ব্যবসায়ীরা তো যে কোনো সময়ই বেড়াতে যেতে পারেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ যদি এই তথাকথিত অফ-সিজনে বেড়াতে যায়, তাহলে অফ-সিজনে বেড়ানোর যেসব অসুবিধা পোহাতে হয় সেগুলোও সহজেই দূর করা সম্ভব হবে। অনেক জায়গায় অফ-সিজনে হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকে। পর্যাপ্ত পর্যটক পেলে নিশ্চয়ই সেগুলো বন্ধ থাকবে না! তবে অফ-সিজনে নিরাপত্তা একটি বড় ব্যাপার। যেহেতু মানুষজন এ সময়টায় কম থাকে, পর্যটকরাও সঙ্গত কারণেই নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এদিকটায় মনোযোগ দিলে একদিকে যেমন পর্যটকদের নিরাপত্তা বাড়বে, তেমনি স্থানীয় এলাকার মানুষজনও একটু বেশি নিরাপত্তা পাবে। তবে একতরফাভাবে সরকার বা পর্যটকদের উদ্যোগে কাজটি করা সম্ভব হবে না। দুপক্ষ থেকেই অফ-সিজনে বেড়ানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার বিশেষত পর্যটন কর্পোরেশন যদি পর্যটকদের নানা সুযোগ-সুবিধা উল্লেখ করে অফ-সিজনে বেড়ানোর আহ্বান জানায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই অনেক পর্যটক বাড়বে। এ কাজে এগিয়ে আসতে পারে বেসরকারি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিগুলোও। অনেক বেসরকারি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি বছরের নানা সময়ে নানা ধরনের সেমিনার, অভ্যন্তরীণ ও বার্ষিক সভার আয়োজন করে। সেগুলো হতে পারে নিকটবর্তী জেলার পর্যটন স্পটে। এতে তাদের অফিসিয়াল জীবনে যেমন কিছুটা পরিবর্তন আসবে, তেমনি স্থানীয় পর্যটনও উপকৃত হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানা ধরনের প্রমোশনাল ট্যুর বা বোনাসের ব্যবস্থা করে থাকে। পর্যটন হতে পারে সেরকমই একটি আকর্ষণীয় অফার। পরিবার-পরিজনদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় অফিস থেকে কিছুটা সহায়তা করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অফিসের প্রতি অনুরাগ যেমন কিছুটা হলেও বাড়বে; তেমনি নতুন চাকুরিপ্রার্থীদের জন্যও সংশ্লিষ্ট অফিস কাঙ্ক্ষিত হতে পারে। পর্যটন নিয়ে নতুন নতুন ডাইমেশন সৃষ্টি করা যেতে পারে। খোদ পর্যটন কর্পোরেশন ব্যক্তি বা অফিসকে নানা ধরনের প্রমোশনাল অফার দিতে পারে। মোবাইল কোম্পানি, কর্পোরেট হাউজ, এমনকি প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক-ইন্টারনেট মিডিয়াও এ ধরনের কাজে যুক্ত হতে পারে। অবশ্য বেসরকারি সংস্থা এসব কাজে যুক্ত হলে সেবার বদলে বিজ্ঞাপন ও ব্যবসাটা মুখ্য হয়ে উঠে- সেটি যেন না হয় সেই বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। সরকারি সংস্থা হিসেবে পর্যটন কর্পোরেশনের নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কিন্তু সমন্বয় এবং মনিটরিঙের কাজটা তারা করতে পারে সহজেই। ট্যুর বা ট্রাভেল কোম্পানিগুলোও ভাবতে পারে এসব নিয়ে। পর্যটনকে নিয়ে ভাবার দায়িত্ব সবার, কিন্তু অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে পর্যটন কর্পোরেশনকে। অফ-সিজনে পর্যটন যে সার্বিক অর্থে পর্যটন শিল্পকেই নতুন গতি দিতে পারে, পর্যটন সংশ্লিষ্ট সবাইকে এটা উপলব্ধি করতে হবে।