সাম্প্রতিক সময়ের হরতালের কারণে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে কয়েকটি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে। পুরো শিডিউল উলটপালট হয়ে গেছে তাদের। এর জের টানতে হবে বহুদিন। তাদের ফলাফল বেরুতে দেরি হবে। একইভাবে পিছিয়ে যাবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পরীক্ষাগুলোও। মোটকথা ক্ষতিটা দীর্ঘমেয়াদী। আগের প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের এই দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে বছরের পর বছর। হরতালের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে জনমত গঠিত হচ্ছে। আশা করা হয়েছিল, বর্তমান রাজনীতিকরা জনমতের প্রতিফলন ঘটাবে তাদের কর্মসূচিতে এবং হরতালের মতো কঠোর ও চূড়ান্ত পর্যায়ের কর্মসূচি একেবারে শেষ মুহূর্ত ছাড়া প্রয়োগ করা হবে না। কিন্তু কোনো পরিবর্তনই আসে নি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে।
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের এ এক বড় অসুবিধা! রাজনীতিতে বড় কোনো ঘটনা ঘটুক- বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানেই বিদ্যালয় বন্ধ। বিদ্যালয় তখন ব্যবহৃত হয় আশ্রয়খানা হিসেবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বড় আকারের হলে বিদ্যালয় মাসের পর মাসও বন্ধ থাকে। আশ্রয় সেন্টার হিসেবে বিদ্যালয় ব্যবহৃত হওয়ার পরও অনেকদিন লেগে যায় সেটিকে ঠিকঠাক এবং সাফসুতরো করতে। স্থানীয় কিংবা জাতীয় নির্বাচনে বিদ্যালয় প্রাঙ্গন এবং বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই। ফলাফল হিসেবে পড়ালেখা ও পরীক্ষা বন্ধ। এলাকায় বড় কোনো মেলা বা বার্ষিক হাট বসলেও অনেকক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের মাঠটিকেই ব্যবহার করা হয়। মোট কথা, ঘটনা বা অঘটনে বিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে ঝড়ঝাপটা বয়ে যাওয়া নিয়মে পরিণত হয়েছে। এর তাৎক্ষণিক ফলাফল হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা এবং পরীক্ষা বন্ধ আর দীর্ঘমেয়াদী ফল হচ্ছে পড়ালেখার মান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হওয়া।
সাধারণত এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো হরতালের মতো বড় কর্মসূচি দেয় না। সাম্প্রতিককালে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম. ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে দলটি লাগাতার হরতাল কর্মসূচি দিয়েছে ও দিচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে হরতাল কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ অন্তত এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে হরতাল না দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু তাতে লাভ হয় নি! বিএনপি দাবি করেছে, তারা এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ব্যাপারে সচেতন, কিন্তু হরতাল না দিয়ে তাদের কোনো উপায় ছিল না।
বিএনপির এই হরতালগুলো যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক; একাধিক দিনের বদলে একদিন পালন করলেই তা যথার্থ হতো কিনা- সেই বিতর্কে না গিয়ে আমরা যদি পরীক্ষার্থীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি, তাহলে বলতেই হবে এ ধরনের কর্মসূচিতে শিক্ষার্থী, বিশেষত এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা অপূরণীয় ক্ষতি ও হয়রানির মুখোমুখি হয়েছে। সাদাচোখে মনে হতে পারে, যে কয়দিন হরতাল হয়েছে, পরীক্ষা সে অনুযায়ী পিছিয়ে দিলেই তো হয়! বিষয়টি আসলে এতো সহজ নয়। কারণ একেকটি পাবলিক পরীক্ষা আয়োজনের পেছনে লাখ লাখ মানুষের পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। বিপুল পরিমাণ টাকাপয়সা খরচ তো হয়ই। পাবলিক পরীক্ষার আয়োজনটা এতোটাই বিশাল যে একদিনের ঝামেলায় সমস্ত পরিকল্পনা উলটপালট হয়ে যেতে পারে। মনে রাখা দরকার, বিপুল জনসংখ্যার কারণেই বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম বড় শিক্ষাব্যবস্থাগুলোর একটি। মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা এতোটা বড় না হলেও একেবারে কম নয়। সীমিত সম্পদে এরকম বড় শিক্ষাব্যবস্থা এবং বিশেষত পাবলিক পরীক্ষা সামাল দেয়া কতোটা কঠিন তা সংশ্লিষ্টরা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে উপলব্ধি করাটা খুবই কঠিন। দেশ পরিচালনায় পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় বিএনপির নেতৃবৃন্দের এই বিশালতা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারার কথা। যে ইস্যুতে বিএনপি হরতাল ডেকেছে, সেটির তুলনায় দেশব্যাপী এইচএসসি পরীক্ষা অগুরুত্বপূর্ণ কিনা, সেই প্রশ্ন বিএনপির নেতৃবৃন্দকে করাই যায়। এমনকি বিএনপির আন্দোলনে সংহতি জানাতে গিয়েছে কাদের সিদ্দিকীও বিএনপির নেতৃবৃন্দকে হরতালের পরিবর্তে অন্য কোনো কৌশল অবলম্বনের কথা বলেছেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে হরতাল কর্মসূচিকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু কোন সময়ে হরতাল ডাকলে তা ফলপ্রসূ হবে বা তাদের দাবিদাওয়ার পক্ষে যাবে তা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপলব্ধি করা দরকার।
এবারের প্রথম পর্যায়ের হরতালের ধরনও কিছুটা ভিন্নরকম ছিল। একদিনের হরতাল কর্মসূচি পালিত হওয়ার পর পরেরদিনের হরতালের ঘোষণা দেয়া হয়, অর্থাৎ তাৎক্ষণিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে দলটি। দ্বিতীয় পর্যায়ের হরতাল অবশ্য পূর্বঘোষিত কিন্তু বিএনপি এরপরও লাগাতার হরতাল দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পড়ালেখার পরিকল্পনার বিঘ্ন ঘটেছে। আগের দিন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এক বিষয়ের পড়ালেখা করে যদি সন্ধ্যায় আরেক বিষয়ের পড়ালেখা করতে হয়, তাহলে তা স্বাভাবিকভাবেই তাদের পড়ালেখার গতিকে ব্যাহত করে। পরীক্ষা হবে কিনা এ আশঙ্কা থাকলে পড়ালেখা ভালো হওয়ার কথা না। বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন পরীক্ষা একরকম; আর এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি ভিন্নরকম হওয়ারই কথা। এই পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গতিধারা নির্দিষ্ট করে দেয়। পরীক্ষায় ভালো না করতে পারলে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী এই স্তরেই ঝরে পড়ে। খরচের দিক দিয়েও চিন্তা করলে দেখা যায় পাবলিক পরীক্ষাগুলোর মধ্যে এইচএসসি পরীক্ষাই বেশি ব্যয়বহুল। এই পরীক্ষার আয়োজন করতে সরকারের যেমন বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তেমনি শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে খরচের পরিমাণটাও নেহায়েত কম না। সব মিলিয়ে একদিনের পরীক্ষা বন্ধ মানে বিপুল ক্ষতি!
পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের মানসিক ক্ষতিটাও কম নয়; যদিও এই দিকটা প্রায়শই উপেক্ষা থাকে। একেকটি পরীক্ষার পেছনে শিক্ষার্থীদের যে পরিমাণ মানসিক শ্রমের প্রয়োজন হয়, কিংবা মানসিকভাবে তাদেরকে যতোটুকু প্রস্তুতি নিতে হয়, সেটি সাধারণত মূল্যায়িত হয় না। একই পরীক্ষা নির্দিষ্ট দিনে দেওয়াতে শিক্ষার্থীদের যে ফলাফল করার কথা, হঠাৎ করে পিছিয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ছন্দপতন ঘটে। তাছাড়া পাবলিক পরীক্ষা যেহেতু নির্দিষ্ট একটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়, সুতরাং ওই সেন্টার ছাড়া উপজেলার বাদবাকি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেন্টারের আশেপাশে থাকার ব্যবস্থা করতে হয়। যাদের বাড়ি একটু দূরে, তাদের যাতায়াতের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হয় যাতে ঠিকমতো পরীক্ষার হলে পৌঁছানো যায়। পরীক্ষা পিছালে এই বাবদ ব্যয় কিংবা প্রস্তুতির পুরোটাই নষ্ট! নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হয়, ব্যয়ও হয় সে অনুপাতেই।
শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার এসব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আদৌ চিন্তাভাবনা করে কিনা সন্দেহ। শুধু বিএনপি নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগীরাও পূর্ববর্তী সরকারের আমলে তাদের ডাকা হরতালে শিক্ষার্থীদের কোনো ছাড় দেয় নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল বা জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়ার সময় অন্য অনেক কিছু বিবেচনায় নিলেও শিক্ষার্থী এবং পড়ালেখার কথা বিবেচনা করা হয় না। হরতাল ডাকা হলে বিদ্যালয়গুলো হয়তো অফিসিয়ালি ছুটি ঘোষণা করে না বা করতে পারে না। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠায় না। এর ফলাফল হিসেবে সেদিনের পড়ালেখা বন্ধ থাকে। এমনিতেই আমাদের বিদ্যালয়গুলো নানা ধরনের ছুটির ভারে আক্রান্ত। এর মধ্যে এসমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে অনির্ধারিত ছুটিগুলো শুধু পড়ালেখাকেই যে মারাত্মকভাবে ব্যহত করে তা নয়; শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে বিকাশেও মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। যদিও আমাদের বিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের কাছে ততোটা আকর্ষণীয় নয়; কিন্তু তারপরও বিদ্যালয়ের পড়ালেখার একেকটি দিন কিংবা পরীক্ষার দিনগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে নানা অর্থে তাৎপর্য বহন করে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উচিত তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড গ্রহণের পূর্বে শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো বিবেচনা করা।
হরতাল কিংবা এ ধরনের গুরুতর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কিছু কিছু সেবাকে ছাড় দেওয়া হয় মানবিক কারণে। হরতালের কঠোর পিকেটিং-এও অ্যাম্বুলেন্স স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারে। খোলা থাকে ওষুধের দোকান। বিদেশগামী যাত্রীদের বাহনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় তুলনামূলকভাবে কম। এ সবই করা হয় মানবিক দিকগুলো বিবেচনা করে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা অর্থে অসুখ-বিসুখে ভুগছে। যে মানসম্মত শিক্ষার কথা আমরা প্রতিনিয়ত উচ্চারণ করি, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সার্বিকভাবে সেই মানে পৌঁছতে গেলে আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। নির্ধারিত ও অনির্ধারিত নানা বন্ধ-ছুটির কারণে একজন শিক্ষার্থীর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ হতে হতে অতিরিক্ত কয়েকটি বছর পার হয়ে যায়। এ অবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি অনুরোধ থাকবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা। তাদের বহনকারী যানবাহন যাতে নিরাপদে বিদ্যালয় ও বাসায় যাতায়াত করতে পারে সেই ব্যবস্থাটুকু গ্রহণ করা। প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় অসহনীয় মাত্রার হরতালের কারণে দেশবাসী এখন কর্মসূচি হিসেবে হরতালকে অপছন্দই করে। হরতাল একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার- একে নিষিদ্ধ করাটা হয়তো যৌক্তিক নয়। কিন্তু হরতালের কারণে কতোটুকু ক্ষতি হচ্ছে এবং কী ক্ষতি সেটি হিসেব করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত। বিরোধী দলগুলো যদি অপ্রয়োজনীয় হরতাল বাদ দেয় এবং প্রয়োজনীয় হরতালে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রেহাই দেয়, তাহলে তাদের পক্ষে জনসমর্থন একটু বাড়লেও বাড়তে পারে।