শিরোনামে মধ্যবিত্তকে হাইলাইট করা হলেও লেখার বিষয়বস্তু উচ্চবিত্ত কিংবা উচ্চ-মধ্যবিত্ত ছাড়া আর যে কোনো শ্রেণীর জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে। তবে লেখক যেহেতু মধ্যবিত্ত (অর্থনীতির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচারে সেটা নিম্ন-মধ্যবিত্তও হতে পারে) শ্রেণীতে পড়েন, সেহেতু মধ্যবিত্তকে কেন্দ্র করে লেখাটাই নিরাপদ। বলা ভালো, অর্থনীতির সংজ্ঞা অনুসারে মধ্যবিত্তের প্রকৃত সংজ্ঞা (অর্থাৎ কী পরিমাণ আয় হলে একজন মানুষ বা একটি পরিবারকে মধ্যবিত্ত বলা যাবে) লেখকের জানা নেই, তবে মধ্যবিত্ততা নিশ্চয়ই কেবল আর্থিক অবস্থা দ্বারা নিরূপণ করা হয় না- এর সাথে মধ্যবিত্তীয় মানসিকতাও অনেকটা মিশে থাকে।
‘মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস’ শব্দদুটো বলার সময় সাধারণত যে চিত্রকল্পগুলো মনে ভেসে উঠে তার একটি হচ্ছে বাজার করতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া। মধ্যবিত্তের জন্য ‘বাজার করা’ কিংবা ‘মানুষকে বাজার করা দেখানো’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বাজার বলতে দৈনন্দিন তরিতরকারি, মাছ-মাংস কেনা ইত্যাদিকে যেমন বুঝায়; তেমনি ধর্মীয় উৎসবের সময় কাপড়চোপড় কেনা, নতুন মডেলের বিলাসদ্রব্য ব্যবহার করা এবং পরিবার-পরিজন কিংবা বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আনন্দফুর্তি করা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া ইত্যাদি ঘটনাকেও বুঝায়। মূলত এ ধরনের কিছু কাজ নিয়মিত করতে পারলেই মধ্যবিত্ত খুশি থাকে। বাজারে চাল-ডাল বা সবজির দাম দু-এক টাকা বেড়ে যাওয়া মধ্যবিত্তের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় না, কিন্তু তেলের দাম পাঁচ টাকা বৃদ্ধি কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ১০-১৫ শতাংশ বেড়ে গেলে তা মধ্যবিত্তের জন্য নাভিশ্বাস উঠার সংকেত হিসেবে কাজ করে। এই বৃদ্ধির হার যদি মাসে মাসে বাড়তেই থাকে, তাহলে স্বল্পসময়ের মধ্যেই মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী সত্যিকার অর্থেই নাভিশ্বাস ফেলতে থাকে।
যেখানে মধ্যবিত্তের এই অবস্থা, সেখানে নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তদের অবস্থা বলাই বাহুল্য! উচ্চ-মধ্যবিত্তদের এসব ছোটখাটো ব্যাপার গায়ে লাগে না, কারণ তাদের ব্যাংকে যে ব্যালান্স থাকে, সেটির মাসিক সুদ দিয়েই একাধিক নিম্ন-মধ্যবিত্তের পরিবার একাধিক মাস চলে যেতে পারে। তারাও যে শঙ্কায় ভুগেন না তা নয়, তবে সেই শঙ্কা মূলত মানসিক। উচ্চ-মধ্যবিত্তদের এই মানসিক শঙ্কা মূলত ব্যবসায় লাভ কম হওয়ার কিংবা আপাতদৃষ্টিতে খরচ বেশি হওয়ার। উচ্চ-মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীর বছরে আয় ও ব্যয় হিসাব করে বছর শেষে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত থাকার কথা, সেই পরিমাণ উদ্বৃত্ত না থাকলে সেটা নিয়ে শঙ্কিত হওয়া তার নাভিশ্বাসের অংশ; কিন্তু এর সাথে দৈনন্দিন আয়-ব্যয়ের টানাপোড়েনের সম্পর্ক ক্ষীণ! হয়তো বাৎসরিক বেড়ানোটা আমেরিকা-কানাডার বদলে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড করতে হয় (তাতে ওই শ্রেণীর অবস্থান বিচারে কিছুটা প্রেস্টিজও হয়তো লস হয়), কিন্তু তাদের আর্থিক অনিশ্চয়তা নিয়ে চিন্তা করার কষ্টটুকু করতে হয় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান লেখায় উচ্চবিত্তদের কথা না আনাই প্রাসঙ্গিক- কারণ উচ্চবিত্তরা সবসময়ই উচ্চতম স্থানে অবস্থান করেন।
বর্তমানে দেশের যে অবস্থা, তাতে সম্ভবত সরকার ছাড়া আর সবাই স্বীকার করবেন জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়েছে এবং বাড়ছে। সরকার কোনো সংকটের কথা সহজে স্বীকার করতে চায় না- জিনিসপত্রের দাম বাড়ার বিষয়টিও তেমনই। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির পরিমাণ আগের মাসগুলোকে ছড়িয়ে গেছে। প্রতি মাসেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। শাকসবজি বা তরিতরকারির মৌসুমে সাময়িক দাম কমা ছাড়া (গত বছরের সাথে তুলনা করলে এই সাময়িক কম দামও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশি) অন্য পণ্য বা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোতে দাম বাড়লে আর কমতে চায় না। গতকালও ডিমের দাম ছিল ৩২ টাকা হালি। দাম বাড়ার বিষয়টি সম্ভবত সবার আগে বুঝতে পারে নিম্ন-মধ্যবিত্ত। কারণ তাকে বাজার করতে হয় সরাসরি আর যাতায়াতের জন্য প্রায়শই নির্ভর করতে হয় রিকশার ওপর। সারাদিন রোজগারের শেষ রিকশাওয়ালাকে যখন বাড়তি দাম দিয়ে পণ্যদ্রব্য কিনতে হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই পরেরদিন তারা রিকশার ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। দূরত্ব ও সেবা বিচারে রিকশা হলো সবচেয়ে খরুচে বাহন, বাড়তি ভাড়ার জন্য রিকশাওয়ালার প্রতি মনে মনে অভিসম্পাত বা গালিগালাজ করলেও এসব ফ্যাক্টকে অস্বীকার করে লাভ নেই।
গত বিএনপি ও তার মিত্রদের সরকার জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির বিষয়টিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। সর্বশেষ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও তাদের ১৪ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দের নানা বক্তৃতা বা বক্তব্যে ধারণা হয়েছিল বর্তমান সরকার এই দাম বৃদ্ধির বিষয়টিকে লাগাম টেনে সামলাতে সমর্থ হবে। বর্তমান সরকার সেটা করতে পারে নি নাকি বা তারাও বিএনপির পথেই হেঁটেছে- সেই বিশ্লেষণের দায় রাজনীতি-বিজ্ঞানী কিংবা অর্থনীতি-বিশ্লেষকদের। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও তাদের চেয়ে আর্থিকভাবে নিম্ন-অবস্থানে থাকা মানুষদের দুর্ভোগ কমেছে বলে মনে হয় না।
মৌলকাঠামো হিসেবে অর্থনীতি এবং আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন সমাজের উপরিকাঠামোতে প্রভাব ফেলে। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি তাই মধ্যবিত্তের মানসিকতাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করতে সক্ষম। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, উপরিকাঠামোতে থাকা বিষয়গুলো নিয়ে মধ্যবিত্ত প্রতিক্রিয়া হয় ভয়াবহ। রাস্তাঘাটে এখন প্রায়ই বর্তমান সরকারের চেয়ে আগের সরকারগুলো ভালো ছিল কিনা তা নিয়ে তর্কবিতর্ক শুনতে পাওয়া যায়। সেটিকে আসলে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির লক্ষণ হিসেবে ধরা যায়, কিন্তু এই মধ্যবিত্তই যখন একাধারে দুই প্রধান দল ও তাদের মিত্রদের শাসনের ব্যাপারে অনাস্থা পোষণ করতে থাকে, তখন বিষয়টিকে চাইলে অন্য মাত্রায় দেখা যায়। দুই প্রধান দলের শাসন অনেকের কাছে দিন দিন বিরক্তিকর হয়ে উঠছে। অনেকে তাই বিকল্প খুঁজে। আজকাল অনেকেই কথায় কথায় নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে দাবি করতে ভালোবাসে, কিন্তু মধ্যবিত্তের জন্য বিকল্প আসলে কারা হতে পারে- এ প্রশ্নের রাজনৈতিক উত্তরে মধ্যবিত্ত কি সন্তুষ্ট থাকে?
শুধু তাই নয়, জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধির সাথে সাথে মধ্যবিত্তের সামাজিক মেলামেশা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তার উপস্থিতি, সমাজ ও উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাচেতনা কিংবা স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলোও পরিবর্তিত হয়। আজকাল বিয়ে-বৌভাত কিংবা জন্মদিনের দাওয়াতে অনেকে যেতে চায় না- কারণ নিদেনপক্ষে ৫০০ টাকা না হলে একটা গিফট কেনা যায় না। সপ্তাহান্তে বেড়াতে বেরুলে যাতায়াত খরচ ও খাওয়া-দাওয়ায় হাজার দুয়েক টাকা বেরিয়ে যায়। এসব কারণে সামাজিক মেলামেশা কি একটু হলেও কমছে না? নানা কারণে অস্থিরতা বাড়ছে সমাজে। মধ্যবিত্ত চায় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে, ফলে সমাজের অস্থিরতা যেমন ব্যক্তি মধ্যবিত্তকে প্রভাবিত করে, তেমনি ব্যক্তি মধ্যবিত্তের অস্থিরতাও সমাজের নানা কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়। এগুলোর সাথে যুক্ত হচ্ছে টেনশন, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ইত্যাদি মানসিক অস্থিরতাও। আজকাল সন্তানকে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করাতে গেলেও মধ্যবিত্তকে নানা হিসাবনিকাশ করতে হয়; উচ্চশিক্ষা বা বাড়তি পড়ালেখার জন্য বড় পরিমাণের টাকা তো খরচ করতে হয়ই। ফলে দেখা যাচ্ছে, এক খাতের দামবৃদ্ধি মূলত সব খাতেই প্রভাবিত করে। তেলের দাম বাড়লে যেমন সবকিছুর দামই বেড়ে যায়, তেমনি মধ্যবিত্তের অস্থিরতা সবাইকেই অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
বিভিন্ন মার্কেট বা শপিং মলে গেলে অবশ্য মনে হয় সবকিছুর উল্টা চিত্র দেখা যাচ্ছে। এটা ঠিক, একদল মানুষের হাতে বেশ কাঁচা পয়সা এসেছে, তারা ধুমসে বাজার করছে, শপিং করছে, মার্কেটিং করছে। পণ্যের দাম দ্বিগুণ হলেও তাদের কিছু যায় আসে না; তারা যেমন উপার্জন করতে ভালোবাসে, তেমনি খরচ করতেও। খরচ করাটা তাদের স্ট্যাটাসের অংশও। খুব ভালো হতো যদি সমাজের অধিকাংশ মানুষই এই শ্রেণীতে অবস্থান করতো কিন্তু অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ীই তা সম্ভব না। যারা অর্থনৈতিক শ্রেণীবিন্যাসের মধ্যবিত্ত অংশে বাস করেন, তাদের ক্ষুদ্র একটি দল দ্রুতই উচ্চ-মধ্যবিত্ত হয়ে যাচ্ছে এবং বিশাল সংখ্যক নিম্ন-মধ্যবিত্তের স্তরে নেমে যাচ্ছে। শ্রেণীবৈষম্য বাড়ায় মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী কি সেই অর্থে শ্রেণী-অস্তিত্বের সংকটেও কি ভুগে না? এখন হয়তো কেউ না খেয়ে বা দুর্ভিক্ষে মারা যায় না, কিন্তু দুর্ভিক্ষ বা না খেয়ে মরার সংজ্ঞাও তো দিন দিন পাল্টাচ্ছে। নিম্নবিত্তের কতজন তিনবেলা ভাত খেতে পারছে কিংবা প্রয়োজনীয় পুষ্টির সংস্থান করতে পারছে? বর্তমান শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে কিংবা শাসন ব্যবস্থা থেকে শ্রেণীবৈষম্য বিলুপ্ত হবে এমন আশা করা বাতুলতা; কিন্তু তারা যদি নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত সবার অনুভূতি ধারণ করে- সেটিই হবে বর্তমান অর্থনীতি-ব্যবস্থার বিচারে সুশাসন। পাশাপাশি এক শ্রেণী থেকে আরেক শ্রেণীর মধ্যকার যে আর্থিক অবস্থার পার্থক্য সেটি যদি বর্তমান সরকার দূর করতে সচেষ্ট হয়, তাহলে সেটি হয়তো অর্থনৈতিক মুক্তির পথে মানুষের অগ্রযাত্রাকে কিছুটা হলেও ত্বরান্বিত করতে পারে।