somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাণিজ্যে বন্ধ শিক্ষা!

১১ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট’ বলে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর একটা দুর্নাম আছে। যদিও হিসাব করলে দেখা যাবে, ছুটির দিক দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। কিন্তু কখন থেকে শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর কাঁধে এ দুর্নাম চেপে বসলো বলা মুশকিল। একসময় শোনা যেত, অনেকে নাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চাইতেন এই ছুটিছাটা বেশি থাকার কারণেই। ‘প্রাথমিক স্কুলে মাস্টারি করে আরাম’ কিংবা ‘প্রাইমারি স্কুলে কাজের চাপ কম’ ইত্যাদি কথা একসময় অনেক শোনা গেছে। সাম্প্রতিককালে অবশ্য এগুলো কম শোনা যায়। বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এ অবস্থা বরং অনেকটাই বদলে গেছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ এখন আর কম নয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা কম এবং এ কারণে শিক্ষককে সামর্থ্যের চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। তাছাড়া পাঠদান ছাড়াও নানা ধরনের সরকারি কাজ যেমন- শিশু জরিপ বা নির্বাচনের কাজে সহায়তা করা ইত্যাদি অনেক কাজ শিক্ষকদের করতে হয়। অন্যদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর জবাবদিহিতাও বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। শিক্ষকদেরকে এখন কমিউটনিটির সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়, যেসব শিক্ষার্থী প্রায়ই বিদ্যালয়ে আসে না, তাদের বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে সচেতন করতে হয়, এসএমসি মিটিং করতে হয়। এরকম অনেক কাজ আছে। তাছাড়া স্থানীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে রিপোর্টিং করার পরিমাণও বেড়েছে। আগে প্রধান শিক্ষক অন্তত পঞ্চম শ্রেণীর গণিত বা ইংরেজি ক্লাশ করাতেন। শিক্ষা অফিস বা সরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের রিপোর্টিং এখন এমন মাত্রায় বেড়েছে যে, প্রধান শিক্ষকরা এখন আর ক্লাশ নেয়ার সময় পান না; এসব অফিসিয়াল কাজ করতে করতেই সময় চলে যায়। প্রধান শিক্ষকদের আবার স্থানীয় পর্যায়ে নানা ধরনের সভায়ও অংশ নিতে হয়। ফলে যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, তারা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারেন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো এখন আর আরামের জায়গা না।

তারপরও প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ভ্যাকেশন ডিপার্টমেন্ট বলার দুর্নামটা পুরোপুরি ঘুচে যায় নি। শিক্ষকদের কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান না থাকা বা অন্য যে কারণেই হোক, মানুষের মধ্যে ওই ধারনাটা রয়েই গেছে। রমজান মাস উপলক্ষ্যে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করার খবরটা প্রচারিত হলো, তখন মানুষের যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি- তাতে মনে হয়েছে মানুষের ওই ধারণাটা আরো পোক্ত হচ্ছে। এটা শুধু ঢাকার চিত্র। ঢাকার বাইরেও নানা সময়ে মানুষজনের সাথে মিশে মনে হয়েছে, মানুষ এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়কে একটি ফ্লেক্সিবল কাজের এলাকা হিসেবেই দেখে। শিক্ষকরা যে নানা ধরনের কাজ করছেন, সেগুলো সাধারণের মাঝে দৃশ্যমান নয়। অপরদিকে মানুষ দেখে নানা সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো নানা কারণে বন্ধ থাকছে। এলাকায় ছোটখাটো কিছু হলেও সবার আগে বন্ধ বা ছুটি হয়ে যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ই। মানুষের একবার কোনো কিছু ধারণা করলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সহজ নয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থাটা সেরকমই।

উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগের পর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর পর যতোদিন মানুষ প্রাথমিক বিদ্যালয় না ছাড়ে, ততোদিন পড়ালেখা বন্ধ। আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ছেড়ে যাওয়ার পরও ছোটবড় ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আরো সময় চলে যায়। যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম হয়, সেখানকার চিত্রটাও ভিন্ন কিছু নয়। বিদ্যালয়ের পাশে বাজার থাকলে মাঝে মাঝেই বিদ্যালয় ছুটি হয়ে যায়। নদী কিংবা হাওরের পাশে বিদ্যালয় থাকলে পানি বাড়লেই বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। এমনিতে বাংলাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বছরে মোটামুটি ১৫০ দিনেরও বেশি বন্ধ থাকে। এর মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটি (শুক্রবার) ৫২ দিন, সাধারণ ছুটি, নির্বাহী আদেশে সরকারি ছুটি, ঐচ্ছিক ছুটি (ধর্মভিত্তিক) ইত্যাদি মিলিয়ে আরো প্রায় ৬০ দিনের মতো ছুটি থাকে। গরমের ছুটি বা স্থানীয় পর্যায়ে ছুটি তো আছেই। তাছাড়া বছরে তিনটি পরীক্ষার জন্য সবমিলিয়ে কমপক্ষে এক মাস কোনো ক্লাশ হয় না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছুটির পরিমাণটা নেহায়েত কম না। হয়তো সব ছুটি শিক্ষকরা ভোগ করতে পারেন না, কিন্তু শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সময়টা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসে। পড়ালেখা ঠিকমতো চালানোর জন্য ছুটির প্রয়োজন আছে, কিন্তু সব ছুটিই দরকার আছে কিনা সেটি ভেবে দেখা দরকার। আমাদের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্য অনেক কম সময় পায়, সেটির জন্য হলেও এই বিষয়টি নতুন করে ভাবা দরকার।

*
রমজান মাস উপলক্ষ্যে রাজধানী ঢাকার বিদ্যালয় বন্ধ হওয়াটা এখন নিয়ম হয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত চট্টগ্রামেও একই অবস্থা। বলা হচ্ছে, যানজট কমানোর লক্ষ্যে এই উদ্যোগ। প্রশ্ন হলো, রমজানে যে যানজট বাড়ে, তার জন্য তো বিদ্যালয় দায়ী নয়। রমজানে মানুষজনের কেনাকাটা বেড়ে যায়, বাড়ে মার্কেটের ব্যস্ততা। বাড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য। এই ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াটা কতোটুকু যৌক্তিক?

রাজধানী ঢাকায় সারাবছরই বেশ ভালো যানজট থাকে। স্কুল শুরু ও শেষের সময় যানজট সহ্যসীমার বাইরে চলে যায়। একই কথা প্রযোজ্য অফিস শুরু ও ছুটি এবং মার্কেটের পিক আওয়ারের ক্ষেত্রেও। যে যানজটের দোহাই দিয়ে মাসব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো, সেই একই দোহাই দিয়ে কি অফিস আর মার্কেট বা বিপণীবিতানগুলো বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব? সেটা কখনোই হবে না। বরং রমজান মাস এলে দোকান বা মার্কেটের সুবিধা বাড়িয়ে দেয়া হয়। রাত আটটায় বন্ধের বদলে ১০টা বা আরো পরে বন্ধ হয়। মার্কেটের সাপ্তাহিক ছুটির দিনও বাতিল করা হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু সরকার কিছু বলে না। বরং রমজানে কেনাকাটা বা বাণিজ্য বাড়ানোর ব্যাপারে সরকার আন্তরিক। তার মানে দেখা যাচ্ছে- সরকার একদিকে রাত আটটার পর মার্কেট চালু রাখতে দিচ্ছে, ছুটির দিনে খোলা রাখতে দিচ্ছে, অন্যদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব রমজানের শুরুতেই বন্ধ করে দিয়েছে। এ থেকে যদি কেউ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, সরকার শিক্ষার চেয়ে বাণিজ্যকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে কিংবা বাণিজ্যকে সুবিধা দিতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে, তাহলে কি খুব ভুল হবে?

সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখেই যানজট সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুক্রবারে বন্ধ না রেখে একেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একেকদিন ছুটি দিলে যানজট অনেকটা কমে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু ও বন্ধ করার সময়ও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, যেমনটা আছে সরকারি ও বেসরকারি অফিসগুলোর জন্য। প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারে বন্ধ না করে দিয়ে শিক্ষাকার্যক্রমের সময় কিছুটা কমিয়ে আনা যেতে পারে। কিংবা যদি এসময়ে ছুটি দিতেই হয়, শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত গ্রীষ্মের ছুটি বা অন্য ছুটিগুলোকে রমজান মাসের ছুটির সাথে সমন্বয় করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার জন্য অধিকাংশ বিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা নেই। সরকার তাদেরকে নিজস্ব পরিবহনের জন্য তাগিদ দিতে পারে। মাঝে মাঝেই সরকার বিদেশ থেকে ২০০-৩০০ বাস আনছে বিআরটিসির জন্য। সেগুলো থেকে কিছু কিছু যদি বিদ্যালয়কে দেয়া হয়, তাহলেও অনেকটা উপকার হয়। প্রয়োজনে বিদ্যালয়গুলোকে আস্তে আস্তে এরকম পরিবহন বা বাসের ব্যবস্থা করতে বলা হোক।

সরকার চাইলে নানা উদ্যেগ গ্রহণ করে বিদ্যালয়গুলোকে খোলা রাখতে পারে- এটা তেমন কঠিন কাজ নয়। রমজানে বাণিজ্য বাড়বে, স্বাভাবিক। অর্থনীতির জন্য এটা হয়তো সুস্বাস্থ্যের পরিচায়কও। কিন্তু এর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বলি দেওয়া সুবুদ্ধির পরিচয় নয়। বাণিজ্যের কারণে শিক্ষা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা দরকার। বাণিজ্য-শিক্ষা দুটোই বাড়ুক, কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।

(লেখাটি এর আগে বাংলাদেশের শিক্ষা সাইটে প্রকাশিত)
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কাঁঠালের আমসত্ত্ব

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯



এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে ।
...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×