অনেক দুঃসংবাদের মধ্যে গত বছরশেষে তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গার্টনারের দেয়া সুসংবাদটি অপ্রত্যাশিতই বটে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ তালিকা অনুসারে ইন্টারনেটভিত্তিক আউটসোর্সিঙে বাংলাদেশ শীর্ষ ৩০টি দেশের মধ্যে রয়েছে। তালিকায় ভারত ও শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার নয়টি দেশ রয়েছে। মূলত ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রোগ্রামিং, সফটওয়্যার তৈরি, কল সেন্টার, ডেটা এন্ট্রি, কাস্টমার কেয়ার, ডেটাবেজ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ, ওয়েব সাইট তৈরি ইত্যাদি নানা বিষয়ে আউটসোর্সিং হয়ে থাকে। ভারত অনেক আগে থেকেই আউটসোর্সিঙের বড় বাজার দখল করে থাকলেও বাংলাদেশের তরুণরা এ সেক্টরে বেশ ভালো করছে। গার্টনারের তালিকায় বাংলাদেশের নাম তাই তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টর নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
এ সাফল্যের মূল দাবিদার যে তরুণরা তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও মূলত ব্যক্তি উদ্যোগেই আউটসোর্সিং হচ্ছে বাংলাদেশে। সময়মত এবং মানসম্মত পণ্য সরবরাহ করা আউটসোর্সিঙের প্রধান শর্ত এবং এ শর্ত ঠিকমতো পালন করছে বলেই আজকে বাংলাদেশ এ অবস্থানে আসতে পেরেছে। মানসম্মত পণ্য সরবরাহ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে এবং বাংলাদেশ এক্ষেত্রে আস্থা তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু সময়মত সরবরাহ করার বিষয়টি শুধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে না; এর সঙ্গে আরো অনেককিছু জড়িত। আউটসোর্সিঙে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ধরে রাখা বা উন্নতির জন্য আরো কিছু কাজ করা দরকার। যে সীমাবদ্ধতাগুলো প্রকাশ্য এবং আলোচিত, অন্তত সেগুলোর দিকে নজর দেয়া বিশেষভাবে জরুরি। এতে আউটসোর্সিঙের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের দায়িত্ব অনেক বেশি। মাত্র কয়েকটি সীমাবদ্ধতা দূর করতে পারলে আউটসোর্সিং খাত থেকেই বাংলাদেশ প্রতি বছর বড় অংকের আয় করতে পারে। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে এই আয় গার্মেন্টস সেক্টরকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সফল আউটসোর্সিঙের একটি অন্যতম প্রধান শর্ত। বাংলাদেশের বিদ্যুতের অবস্থা নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। বিদ্যুতের কারণে অনেকে সময়মত পণ্য সরবরাহ করতে পারে না। আউটসোর্সিঙের পুরো কাজটি যেহেতু ইন্টারনেটভিত্তিক, তাই কোনো প্রতিষ্ঠান বিদ্যুতের কারণে একাধিকবার পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে পরবর্তীতে ক্রেতা তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সীমিত ইন্টারনেট ব্যবস্থাও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পারার একটি কারণ। ভি-স্যাটের মাধ্যমে ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ। সারাদেশ এখন একটিমাত্র সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত। কোনো কারণে এ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। ইন্টারনেটের গতিও বেশ ধীর। সব জায়গায় ইন্টারনেট নেই। মূলত এই দুটো কারণে পণ্য সরবরাহ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সরবরাহকারীদের বেশ সমস্যা পোহাতে হয়। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারলে এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের অবস্থান আরো উন্নত করা সম্ভব।
ক্রেডিট কার্ডের সীমিত ব্যবহার আউটসোর্সিঙের আরেকটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশ থেকে ইন্টারনেটে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ আদানপ্রদান বা বিদেশে কেনাকাটা করা যায় না। অথচ আউটসোর্সিঙের অধিকাংশ লেনদেনই করতে হয় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। এর বিকল্প পেপল নামক ইন্টারনেটভিত্তিক সেবাটিও বাংলাদেশে নেই। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়, স্বীকৃত ও নিরাপদ এই অর্থ আদানপ্রদানকারী ব্যবস্থাটি বাংলাদেশে এখনো কেন অনুমতি পাচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। পেপলের ওয়েব সাইটে যেসব দেশের নাম রয়েছে, সেখানে স্বল্পপরিচিত অনেকে দেশের নাম থাকলেও বাংলাদেশের নাম না থাকাটা বেশ পীড়াদায়ক। যারা আউটসোর্সিং বা ইন্টারনেটে লেনদেনের সাথে যুক্ত, তারা সবাই বুঝতে পারেন এ সেক্টরে পেপলের প্রয়োজনীয়তা কতোটুকু। শুধু পেপলের অনুপস্থিতির কারণে আরো অনেকের আউটসোর্সিং করার মতো দক্ষতা থাকলেও তারা তা করতে পারে না। হিসেবে করলে দেখা যাবে, যারা আউটসোর্সিঙের সাথে জড়িত, এ সংখ্যাটা তাদের চেয়ে বেশিই হবে। পেপলের নিরাপত্তা সিস্টেম এতোটাই সুরক্ষিত যে, বিদেশে অবস্থানকারী কারো ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে পেপল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করার চেষ্টা করলেও পেপল কর্তৃপক্ষ সেটি বন্ধ করে দেয়। তাছাড়া প্রতিটি লেনদেনের হিসাব তো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে থাকছেই। বিএনপি সরকার তথ্যপাচারের আশঙ্কায় বিনামূল্যে সাবমেরিন কেবল লাইন নেয়া থেকে বিরত ছিল। সম্ভবত সেই একই ধরনের অর্থাৎ অর্থপাচারের আশঙ্কায় পেপলকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু ব্যাংকের নিয়মকানুন মেনে ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে লেনদেন করলে অর্থপাচার বা এ ধরনের আশঙ্কাটা পুরোপুরি অমূলক। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর বেশ কিছু ভালো কাজ করেছেন। দেশে এখন ইন্টারনেটে কেনাকাটা করা যাচ্ছে, সীমিত পর্যায়ে হলেও অর্থ আন্তঃব্যাংক লেনদেন হচ্ছে। তিন মাসের মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং চালু হতে যাচ্ছে। গভর্নর যদি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ও পেপল ব্যবহারের সুযোগটি খুব তাড়াতাড়ি চালু করেন, আউটসোর্সিং খাতে দেশের উপার্জন বহুগুণে বেড়ে যাবে।
আউটসোর্সিঙের ক্ষেত্রে ডাকবিভাগও কিছুটা যুক্ত। প্রথাগত অর্থে আউটসোর্সিং না করে অনেকে নিজস্ব ওয়েব সাইটে নানা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে বেশ ভালো আয় করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ কারো ওয়েব সাইটে গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করলে গুগল ব্যবহারকারীকে নিজস্ব আয়ের একটি অংশ প্রদান করে থাকে। শুধু গুগলের বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে প্রতি মাসে প্রচুর আয় করছেন দেশে এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু এই আয় তুলতে গিয়েও নানা সমস্যায় পড়তে হয়। গুগল অনলাইনে টাকা না পাঠিয়ে সরাসরি চেক পাঠায় যা প্রায়ই ডাকবিভাগ থেকে হারিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। আবার কিছু টাকা খরচ করলে সেটা ফেরতও পাওয়া যায়। ডাকবিভাগের ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে অনেকেই ২৮ ডলার খরচ করে ডিএইচএলে চেক আনান। চেক ছাড়াও বিদেশ থেকে আসা নানা ডকুমেন্টসও ডাকবিভাগ থেকে হারায়। আউটসোর্সিঙের সঙ্গে যারা জড়িতরা তাই ডাকবিভাগের সেবা না নিয়ে বেশি টাকা খরচ করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এসব আনার ব্যবস্থা করেন। অথচ ডাকবিভাগের সেবাকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করলে প্রচুর বিদেশী মুদ্রা দেশেই রাখা যেত।
গার্টনারের প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর অনেকেই নবউদ্যমে এ সেক্টরে কাজ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন। সবাই যে বুঝেশুনে ঝাঁপ দিবেন তা নয়; বরং না বুঝেই অনেকে কিছু একটা করার চেষ্টা করবেন এবং সেক্ষেত্রে বিফল হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। আউটসোর্সিঙে বাংলাদেশের ভালো করার মানে এটা নয় যে- কেউ চাইলে কাল থেকেই কাজ শুরু করে দিতে পারে। মনে রাখা দরকার, আউটসোর্সিং অনেক বড় একটা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র এবং এখানে নিজের যোগ্যতা দিয়েই টিকে থাকতে হয়। টেকনিক্যাল বিষয় জানা না থাকলে আউটসোর্সিং থেকে হতাশাও আসতে পারে। এটা এমন নয় যে একবার টাকা বা শ্রম বিনিয়োগ করলে আস্তে আস্তে রিটার্ন আসতে থাকবে। বরং নিজেকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা, যারা কাজ দেয় তাদের কাছে নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা যথাযথভাবে তুলে ধরা ও সুনাম বজায় রাখা অনেক জরুরি। এগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন না করে আউটসোর্সিঙের কাজ শুরু করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আর এর জন্য দরকার প্রশিক্ষণ।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন না করেও আউটসোর্সিঙে ভালো করা সম্ভব। কিন্তু ইংরেজি ভাষাটা জানতে হবে ভালোভাবে; জানতে হবে কম্পিউটারের বেশকিছু বিষয়ও। ওয়েব সাইট ডিজাইন, প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ, সফটওয়্যার তৈরি, কল সেন্টার ইত্যাদি থেকে শুরু করে ইন্টারনেট টিউশনি বা অনুবাদ করার মতো কাজও বিদ্যমান। কিন্তু সবক্ষেত্রেই ইংরেজির কোনো বিকল্প নেই। কম্পিউটারে যে যেদিকে আগ্রহী, তাকে সেদিকেই নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। আউটসোর্সিং নিয়ে দেশে প্রশিক্ষক বা প্রশিক্ষণ সেন্টারের অভাব রয়েছে। যারা এ বিষয়গুলো ভালো জানেন, তারা সম্ভবত প্রশিক্ষণ বা এ ধরনের কাজে আগ্রহী নন। পত্রপত্রিকায় মাঝেসাঝে আউটসোর্সিঙের বিজ্ঞাপন দেখা গেলেও সেগুলোর মান খুব একটা ভালো নয়। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে আউটসোর্সিঙের কাজ করছে, তারা সীমিত জনসম্পদ ব্যবহার করে হলেও যদি কিছু মানুষকে প্রশিক্ষিত করতে পারে, তাহলে এই প্রশিক্ষণার্থীরাই পরবর্তী সময়ে অন্যদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসাটা খুবই জরুরি। কিছুদিন আগে যখন দেশে কল সেন্টার স্থাপনের হিড়িক উঠলো, তখন ভারতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো। এর আগেও আইটি প্রশিক্ষণে বেশ কিছু ভারতীয় প্রতিষ্ঠান এদেশে রাজত্ব করে গেছে। তাদের সিলেবাস ও প্রশিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একদল মানুষের কাছ থেকে তারা কিন্তু প্রচুর পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে গেছে। আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণেও এমনটি হতে পারে বলে অনুমান করি।
গার্টনারের দেওয়া এই সুসংবাদে যথারীতি সরকার ভাগ বসিয়েছে। বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেজ ওসমান বলেছেন, “তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপের কারণে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে”। দেশের যে কোনো অর্জন বা কৃতিত্বে সরকারের ভাগ বসানোটা স্বাভাবিক; কিন্তু আউটসোর্সিঙের ক্ষেত্রে সরকার রুটিন কাজের বাইরে কিছু করেছে কিনা জানা নেই। সরকারের নীতি বা কর্মপন্থার কারণে অনেক সাফল্য আসতে পারে, কিন্তু রুটিন কাজের বাইরে উল্লেখযোগ্য কিছু না করলে সরকার সেখানে কৃতিত্ব দাবি করতে পারে কি? তবে দাবি করলে প্রচলিত সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠার জন্য প্রধান দায়দায়িত্বও সরকারকে বহন করতে হয়। আশা করব, সরকার আউটসোর্সিঙের অসুবিধাগুলো যতো দ্রুত সম্ভব দূর করার ক্ষেত্রে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করবে।