সপ্তম শ্রেণীতে একবার ক্লাশ ক্যাপ্টেন হয়েছিলাম। ক্যাপ্টেনের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হতো, যার একটা হচ্ছে শিক্ষকের হুকুমমতো হেডস্যারের কক্ষ থেকে বেত আনা। এই কাজটা করতে খুব একটা ভালো লাগতো না, কারণ পড়া না পারলে বেতের বাড়ি থেকে ক্যাপ্টেনেরও রক্ষা নাই। তবে যেদিন নিজের মার খাবার বিষয় থাকতো না, সেদিন অবশ্যই বেত আনতে-যেতে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতাম। বিশেষ করে কয়েকটা দুষ্ট পোলাপান ছিল, ওদের শায়েস্তা হতে দেখে স্বর্গীয় সুখ দ্বিগুণ বা তিনগুণ না; কয়েকগুণ বেড়ে যেত । শিক্ষকের হাতে মার খাওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে এতোটাই স্বাভাবিক ছিল যে, কোনোদিন কোনো কারণে ক্লাশে মার না খেলে আমরা দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতাম- না জানি কী কেয়ামত হতে যাচ্ছে! কারণ একবার কী এক অপরাধের পর (সম্ভবত পিটি ক্লাশে আমরা কয়েকজন ক্লাশে লুকিয়ে ছিলাম, সেই অপরাধে) নির্ধারিত শিক্ষক আমাদের মারলেন তো না-ই, বরং মিষ্টিমধুর অনেক কথা বলেছিলেন। আর পরবর্তী ক্লাশে এসে প্রধান শিক্ষক পুরো ক্লাশ ধরে পিটিয়ে অন্তত ৬/৭টা বেত ভেঙ্গেছিলেন। পরে জেনেছিলাম, নির্ধারিত শিক্ষক একটু কম পেটাতে পারেন বলে প্রধান শিক্ষককে দিয়ে এই অপরাধে আমাদেরকে পিটিয়েছিলেন। সুতরাং শিক্ষকদের হাতে মার খাওয়া আমাদের কাছে ক্লাশে ফাঁকি দিয়ে টয়লেটে যাওয়ার মতো স্বাভাবিক ঘটনাই ছিলো। তবে মাত্র দুটো ঘটনা শিক্ষকদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার কাজটিকে আমার কাছে মারাত্মক ভীতিপ্রদ, এমনকি ট্রমাটিক করে তোলে।
আমাদের এক বন্ধু, আলামিনের অভ্যাস ছিল গোসল না করে স্কুলে আসা। ওটা আরো অনেকেই না করে আসতো, কিন্তু আলামিনকে দেখলেই কেমন যেন মনে হতো সাতদিন ধরে পানির সাথে তার কোনো যোগাযোগ নাই। সেদিনও আলামিন গোসল না করে বিদ্যালয়ে এসেছিল। কোনো কারণে শ্রেণীশিক্ষক প্রচণ্ড রেগে ছিলেন এবং আমাকে বললেন বেত আনতে। কিছুটা ভয়ে ভয়েই হেডস্যারের কক্ষ থেকে বেত নিয়ে এসেছিলাম। ভয়ের কারণটা ছিল আজকে চোটটা কার ওপর যাবে, সেটি আন্দাজ করতে না পারা। বেত নিয়ে আসামাত্রই শুরু হলো স্যারের পিটুনি- একধার থেকে। মোটামুটি সবারই কোনো না কোনো দোষ পাওয়া গেল এবং সেই দোষের মাত্রানুযায়ী পিটুনি খেতে হলো সবাইকেই। কারো নখ কাটা নেই, কেউ চুলে তেল দেয় নি, কেউ পড়া তৈরি করে নি, কেউ বেঞ্চ থেকে পা বের করে বসেছে। আমার অপরাধ ছিল বেত আনতে দেরি করেছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি মার খেলো আলামিন- কারণ সে গোসল করে আসে নি। শ্রেণী শিক্ষক তাকে পেটাতে পেটাতে পাশের পুকুরে নিয়ে নামালেন; জামাকাপড়সহ তাকে গোসল করতে হলো এবং সেই ভেজা কাপড়ে তাকে হাঁটতে হাঁটতে তিন মাইল দূরের বাড়িতে যেতে হলো। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী কয়দিন জ্বরে ভোগে সে বিদ্যালয়ে আসতে পারে নি এবং এই অপরাধে তাকে আবারো পিটুনি খেতে হয়েছে। আলামিন আমার বন্ধু ছিল- বন্ধুর ওপর এই অত্যাচার সেদিন ছোট মনে বড় ব্যাথা হয়ে বেজেছিল।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল আমার ওপর। পড়া পারি নি বলে শিক্ষক আমাকে দিয়েই বেত আনালেন। এবং কোনো কারণে সেদিন আর কাউকে না পিটিয়ে আমাকে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছিলেন। রক্তাক্ত হাত নিয়ে বাড়ি ফিরে বাবাকে জানিয়েছিলাম, ওই স্কুলে আমি আর পড়বো না। বাবা এসএমসির (স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি) সদস্য ছিলেন বলে পরবর্তী সময়ে এসএমসির সভায় এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন এবং প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকগণ (শুধু পিটুনিদাতা শিক্ষক ছাড়া) আমাকে বাড়িতে এসে সান্ত্বনা জানিয়ে গিয়েছিলেন। এই মারের ফলে আমি একটানা ৮/১০ দিন জ্বরে ছিলাম, ঘুমের ঘোরে আবোলতাবোল বকেছি। আর এই ভয় কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিলো আরো অনেকদিন।
***
হঠাৎ করে এই পিটুনি-সংক্রান্ত স্মৃতিচারণ করার কারণ হলো, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষার্থীদের এখন থেকে আর শারীরিক শাস্তি দেয়া যাবে না- খবরটি (Click This Link) পড়ে বেশ পুলকিত বোধ করছি। ছোট মানুষ বলে তখন অনেক কথাই বলতে পারি নি, অনেক প্রতিবাদ করতে পারি নি। কিন্তু বড় হওয়ার পর নানা কাজের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই শারীরিক শাস্তি বন্ধের জন্য ছোটখাট কিছু কাজ করেছি। অনার্স কোর্সে থাকার সময় মাইক্রোটিচিঙে ঢাকার একটি নামকরা বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমরা কয়েকজন আইইআরের শিক্ষার্থী হাতেকলমে (মানে ছয় মাস নিজেরা ক্লাশ ও পরীক্ষা নিয়ে) বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি কীভাবে ক্লাশ নিলে বেতের প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা থেকে (এডুকেশন ওয়াচের গবেষণাগুলো এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, তবে মূল গবেষণা প্রতিবেদনগুলো ইন্টারনেটে সহজলভ্য নয়। কেউ আগ্রহী হলে এখান থেকে (http://www.campebd.org/content/download.htm) কিছু কিছু গবেষণার সারসংক্ষেপ দেখে আসতে পারেন) দেখা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক শিক্ষার্থীই মাঝপথে ঝরে পড়ে কেবল শিক্ষকদের মারের ভয়ে। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে দেখেছি, যেসব শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পেটান, তাদের অনেকেই পিটিআই থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। পিটিআইতে শিক্ষকদের ভালোভাবেই জানানো হয়, শিক্ষার্থীদের মার দিলে তাদের ওপর কী পরিমাণ প্রভাব পড়ে, কীভাবে পড়ালেখা করালে শিক্ষার্থীদের মার ছাড়াই ভালোভাবে সম্ভব। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে তারা সবই ভুলে যান। অনেকে আগের চেয়েও বেশি পেটাতে থাকেন, এমন উদাহরণও আছে। সরকার যেহেতু এটিকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে, তাই কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি।
তবে, অনেক শিক্ষক যেহেতু মনে করেন, পেটানো ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পড়া আদায় করা যায় না, তাই স্বস্তির নিঃশ্বাসটা পুরোপুরি ফেলতে পারলাম না। হয়তো তারা অন্য কোনো উপায় বের করে ফেলবেন এরই মধ্যে। যতদিন পর্যন্ত না আমাদের শিক্ষককে বুঝানো যাচ্ছে যে, শিক্ষার্থীরা ছোট হলেও মানুষ এবং শিক্ষক হলেও একজন মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের গায়ে হাত তোলার অধিকার নেই- ততোদিন পর্যন্ত বোধহয় এই বিষয়টি নিয়ে একেবারেই নিরুদ্বিগ্ন থাকা যাবে না।