১৫২৬সালে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাট বাবর ,মাত্র চার বছর ভারত শাসন করেন । তার পুত্র হুমায়ুন এর রাজত্বের বেশিরভাগ সময় যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে কেটে যায় । মূলত মোঘল সাম্রাজ্যের প্রথম প্রকৃত শাসক যিনি দীর্ঘদিন উপমহাদেশ শাসন করেছেন তিনি সম্রাট আকবর । অল্প বয়সে সিংহাসনে আরোহনের পর উপমহাদেশ জুড়ে একচ্ছত্র ও অবিভক্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন । যদিও বেশ কিছু অঞ্চল তখনও মোঘলদের অধিকারে আসেনি । কিন্তু তারপরও তার রাজ্য ছিল বিশাল ও প্রজাদের মধ্যে ছিল স্পষ্ট ধর্মীয় বিভাজন ।কারন প্রাচীন কাল থেকে ভারতে ডজন এর উপর ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর বসবাস ছিল । প্রতিটি ধর্মের মানুষ তাদের ধর্মীয় আচরনের সাথে ছিল আপোষহীন । অপরদিকে মুসলমানদের উপমহাদেশ বিজয় তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে । কারন মুসলিম শাসনের মূল নীতি ছিল শরীয়া আইনের বাস্তবায়ন । অন্যধর্মের শাস্ত্রগুলোর মতো শরীয়া আইন শুধু একটি ধর্মের মানুষের জীবনাচরন নিয়ন্ত্রনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং রাষ্ট্রের অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের ভূমিকা রাষ্ট্রে কেমন হবে তাও নির্ধারন করে দিত এবং তা স্বাভাভিকভাবে অন্য ধর্মের অনুসারীদের কাছে সম্মানজনক ছিলনা । যেমন অন্য ধর্মের অনুসারীদের বাধ্যতামূলক জিজিয়া কর দিতে হতো । তাছাড়া মুসলমানদের গোত্র বিভক্তহীন সমতার নীতি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আকৃষ্ট করে যারা চিরায়তভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার ছিল । তারা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে রাজকীয় আনুকূল্যে স্বাভাবিক জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয় যা উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের পছন্দ হয়নি । আবার মোঘলরা পূর্বাপর বিদেশীদের মতো ভারতের সম্পদ লুট করে নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে উপমহাদেশে তাদের স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় মনোনীবেশ করে । এর ফলে উপমহাদেশের পূর্ববর্তী রাজপরিবার গুলো ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে । এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রাজস্থানের রাজপুতানারা ।এভাবে মোঘলদের বিরূদ্ধে চরম অসন্তোষের আগুন ধীরলয়ে সমগ্র উপমহাদেশে একটু একটু করে বারতে থাকে । অনেক ক্ষেত্রে এই অসন্তোষ বিদ্রোহে রূপ নেয় । আকবর সফলতার সাথর অনেকগুলো বিদ্রোহ দমন করলেও তার সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পরেন ।সাম্প্রদায়িকতার এই বিষ বাষ্প থেকে ভবিষ্যতে মোঘল সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য তিনি পথ খুজতে থাকেন । তাছাড়া তিনি নিজেও ন্যায়পরায়নতার সাথে সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী ছিলেন ।মোঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রজাদের মধ্যে বিদ্যমান অসন্তোষ নিরসনে তার প্রথম পদক্ষেপ ছিল জিজিয়া কর বিলুপ্ত করা । রাজপুত রাজকুমারী যোধাবাঈকে বিয়ে করার মাধ্যমে তিনি আমেরের রাজপুতদের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করেন ।এছারা মেওয়ারের সিসোরিয়া এবং রাথামেরের হারাসদের সাথে সন্ধি করেন । হারাসদের রাজা সূর্য শর্তসাপেক্ষে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিধানের শর্তে সন্ধিতে রাজি হয়েছিলেন । কট্টোরপন্থী আলেমদের বিরোধীতা সত্বেও এসকল কর্মকান্ডের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল , ভিন্নধর্মাবলম্বীদের বিশ্বস্ততা অর্জন করে মোঘল শাসনের জন্য একটি নিরাপদ সাম্রাজ্য রেখে যাওয়া । এই নীতিতে তিনি সফলতা ও অর্জন করেন । কিন্তু তার গৃহিত এসকল পদক্ষেপগুলোকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি স্থায়ী মোঘল ধর্মীয় নীতি । এই লক্ষে তিনি একটি ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করেন । এই ইবাদতখানায় তিনি আমন্ত্রন জানান পুরো আরব ও উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেমদের । তিনি তাদের সাথে নিয়ে শরীয়া আইনের ভিত্তিতে একটি সহনশীল ধর্মীয় নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহন করেন । কিন্তু তিনি লক্ষ করেন মুসলিম মনিষীরা শুধু শরীয়া আইন নিয়ে দ্বিধাবিভক্তই না বরং তাদের মতামত পরস্পরবিরোধি ও প্রত্যেকে তাদের স্থানে কট্টর । তাদের পারস্পরিক বিতর্ক এক সময় ব্যাক্তিগত গালাগালির পর্যায়ে চলে গেলে একটি সার্বজনীন ধর্মীয় নীতি প্রনয়নে তিনি এক জটিল পরিস্থিতির মুখে পরেন এবং তার উপদেষ্টা পরিষদ যা তখন নবরত্ন নামে পরিচিত ছিল তাদের ইবাদত খানায় আমন্ত্রন জানান । তার বিশ্বস্ত পারিষদ ফয়েজি তাকে একটি অভিনব প্রস্তাব প্রদান করেন । তিনি শুধু মুসলিম শরীয়া আইনের উপর নির্ভর না করে বরং সবগুলো ধর্ম থেকে মানবিক নীতি গুলো নিয়ে একটি সার্বজনীন ধর্মীয় নীতি গ্রহনের প্রস্তাব দেন ।তার এই প্রস্তাব আকবরের পছন্দ হয় এবং তিনি ইবাদতখানায় তদকালীন সকল ধর্মের পন্ডিতদের আমন্ত্রন করেন । তার আমন্ত্রনে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দেন শিয়া, সুন্নী , সনাতন , খ্রিষ্টান , বৌদ্ধ , জৈন সহ সকল ধর্মের পন্ডিতগন । অবশেষে সম্রাট সকল ধর্মের মানবিক দিকগুলো নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেন যার নয়টি মূলনীতি হল :
১.মুক্ত ও উদার মানসিকতার নীতি
২.ক্ষমা ও ক্রোধ দমনের নীতি
৩.ইহজাগতিক লালসা ত্যাগের নীতি
৪.ভোগ বিলাস থেকে দূরে থাকা
৫.সাহসিকতার সাথে মহত কর্তব্য পালন
৬.কোমল কণ্ঠে ও বিনয়ের সাথে কথা বলা
৭.সবার সাথে ভালো ব্যবহার করা
৮.অসত ব্যাক্তিদের সাথে কোন রকম সম্পর্ক না রাখা
৯.সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য
আচার্য হিরা বিজয় নামক জৈন পন্ডিতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি তার রাজ্যে প্রাণী হত্যাকেও নিরুতসাহিত করেন ।
এভাবে প্রজাদের জন্য অনুসরনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করলেও তিনি নির্দিষ্ট কোন প্রার্থনা পদ্ধতির প্রচলন করেননি বা নিজেকে নবী এমনকি দরবেশ বলেও কোনদিন দাবি করেন নি ।তাই দ্বীন-ই-ইলাহি কে আকবর প্রবর্তিত নতুন ধর্ম বলার পেছনে যৌক্তিক কোন কারন খুঁজে পাওয়া যায়না । কিন্তু তারপরও দরবারের গুরুত্বপূর্ন ১১ জন ব্যাক্তিকে দ্বীন ই ইলাহি ধর্মের অনুসারী বলা হয় যার মধ্যে ছিলেন যুবরাজ সেলিম (পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত ) । সম্রাট আকবরকে বন্দী করে তিনি সিংহাসনে আরোহন করলেও আকবরের প্রনীত দ্বীন ই ইলাহি তিনি তার সাম্রাজ্যেও সমানভাবে কার্যকর করেন । সম্রাট জাহাঙ্গীরের পর সম্রাট শাহজাহান সিংহাসনে আরোহন করেন এবং তিনিও তার রাজ্যে দ্বীন ই ইলাহির নীতি কার্যকর করেন । এভাবে ১৫৪২ থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত ১২৪ বছর মোঘল সাম্রাজ্য ছিল সুসংহত ও ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ । মোঘল সাম্রাজ্যের উদার ধর্মীয় নীতি পরিহার করে কট্টর শরীয়া আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্বীন ই ইলাহি নীতির সমাপ্তি টানেন সম্রাট আওরঙ্গজেব । নতুন কিছু সাম্রাজ্য জয় এর মাধ্যমে তিনি মোঘল সাম্রাজ্যকে সামান্য বিস্তৃত করলেও অন্যান্য ধর্মের রাজা যারা মোঘলদের অধীনে নিজ রাজ্য শাসন করতেন এবং মোঘলদের কর প্রদান করতেন তাদের মনে চরম অসন্তোষের জন্ম দেন । যার ফলে পরবর্তীতে মারাঠা বিদ্রোহ সহ কয়েকটি বিদ্রোহ মোঘল সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে ফেলে ।ফলশ্রুতিতে সম্রাট আওরঙ্গজেব এর মৃত্যুর সাথে মোঘলদের সৌর্য ও শক্তি এক পর্যায়ে ধুলিস্যাত হয় এবং মোঘল সম্রাটগন কাগুজে বাঘে পরিণত হয় ।এক পর্যায়ে বিদেশী ইংরেজ কোম্পানী যখন উপমহাদেশ আক্রমন করে তখন তাদের বাধা দেওয়ার মতো ঐক্যবদ্ধ শক্তি আর অবশিষ্ট ছিলনা । সবাই ছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের আড়ালে সাম্প্রদায়িক আবেগের শিকার ও একই সাথে দুর্বল । তাই ইংরেজদের জন্য একটি একক রাষ্ট্রের পরিবর্তে শতছিন্ন রাজ্যের দুর্বল রাজাদের পরাজিত করা কঠিন কাজ ছিল না ।
মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে অনেক কারন ছিল । কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিভক্তি পতন এর সূত্রপাত করে পতনকে ত্বরান্বিত করে । আর এই পতনের বীজ বপন করা হয় দ্বীন ই ইলাহির গায়ে ধর্মীয় তকমা লাগিয়ে তা বর্জন করার মধ্য দিয়ে ।