ধারণা ছিল বাংলাদেশের নষ্ট রাজনীতির ক্ষতিকর ভাইরাস বুয়েট নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করতে পারবে না। দেশের বিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা এখানে নোংড়া রাজনীতির চর্চা করবেন না এটা শুধুমাত্র বুয়েট পরিবারের নয় পুরো জাতির প্রত্যাশা।
সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি.সি পরিবর্তন অনেকটা লজিক্যাল সিকোয়েন্সের মতই আমাদের কাছে সহনীয় হয়ে পড়েছে। বুয়েটে নিয়োগ পেল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির দায়ে ছাত্র-শিক্ষকদের চাপের মুখের পদত্যাগ করা ভি.সি. জনাব নজরুল ইসলাম। তিনি না'কি আ:লীগের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন! উনার আরেকটি পরিচয় আছে, উনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হোম টিউটর(শিক্ষক) ছিলেন। ভি.সি পদ পাওয়ার অধিকার তারই আছে। বুয়েটে উনি ছাড়া আ:লীগের আর কোনো যোগ্য ও সিনিয়র টিচার যে নেই তা নয়। উনি সবচেয়ে ত্যাগী এবং দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ। আরেক জন্য ত্যাগী নেতা আছে, তদকালীন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ছিলেন, উনাকে পদ দেয়ার জন্য বুয়েটে নতুন পদ সৃষ্ট করা হল প্রো-ভি.সি।
নজরুল স্যার ভি.সি হয়েই একের পর এক দলীয় এজেন্ডা বাস্তাবায়ন শুরু করেন। যার অংশবিশেষ রেজিস্ট্রার পরিবর্তন, প্রতিটি হলের হল প্রভোষ্ট পরিবর্তন। জেষ্ঠ্যতা লঙ্ঘন করে দলীয় আনগত্যই হল যোগ্যতার মাপকাঠি।
যার কাছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোন সমস্যা নিয়ে গেলে উনার সময় থাকে না। আর ছাত্রলীগের কেউ গেলে তার সমস্যা সমাধান পারলে নিজে হাতেই করে দেন কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই। ছাত্রলীগের একজনের(০৬ ব্যাচের) ফলাফল পরিবর্তন করে দেয়ার মত গর্হিত কাজ করতে তার বিবেকে এতটুকুও বাধে নি! এই না হলে ত্যাগী নেতা!!
বিষয়টি অনান্য জেষ্ঠ্য শিক্ষকদের দৃষ্টিগোচর হলে বাধে যত বিপত্তি। কয়েক ডজন অভিযোগের সাথে একাডেমিক কার্যক্রমে দুর্নীতি শিক্ষক সমিতিকে আন্দলনের ঠেলে দেয়। প্রায় ১৫টিরও বেশি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ভি.সি প্র-ভি.সির পদত্যাগের দাবীতে শিক্ষকরা অর্ধদিবস কর্মবিরতির পালন করতে থাকে। এরপর যখন পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে যায় তখন প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে স্যাররা ক্লাসে ফিরে যান।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পেন্টিয়াম-১ প্রসেসরে সমস্যা সমাধান আর হয় না! শিক্ষকরা দুর্নীতিবাজ ভি.সি-প্র ভিসি অপসারণে আবারো কর্মবিরতি দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু আমাদের স্বঘোষিত সৎ ভি.সি মহোদয় বুয়েটে গ্রীষ্মকালীন ছুটি আমাদানী করে রমজানের ছুটির সাথে একত্রিত করে মোট ৪৪ দিনের ছুটি ঘোষণা করে আন্দলনকে দমিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস চালায়। ইতোমধ্যে জৈনিক এক ইতর আইনজীবির রিট আবেদনে হাইকোর্ট শিক্ষক সমিতির আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষনা করে রুল জারি করে এবং অবিলম্বে বুয়েট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেয়। যা দুর্ণীতি বিরোধী আন্দলনে নগ্ন বাঁধার শামিল।
এরপর ঈদের পর বুয়েট খোলা হয় ২৫ আগষ্টে। এর পর থেকে কিছু ধারাবাহিক ঘটনা নিম্নে তুলে ধরা হল-
প্রথম সপ্তাহ:
২৫ আগষ্ট-৩১ আগষ্ট: বুয়েটে কোন শিক্ষক ক্লাসে আসেনি। ছাত্রছাত্রীরাও ক্লাসে উপস্থিত হয় নি। কিন্তু ছাত্ররা দুর্নীতিবাজ ভিসি প্রভিসি অপসারণের আন্দলনের প্রস্তুতি নেয়।
২য় সপ্তাহ:
১ সেপ্টেম্বর: সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ সমাবেশ, ছাত্রছাত্রীদের আন্দলনে শিক্ষকদের ব্যাক্তিগতভাগে অংশগ্রহন, বিক্ষোভ মিছিল, ভি.সি ও প্রভিসি অফিস ফেরাও। শিক্ষকমণ্ডলী ও ভিসির মধ্যে আলোচনায় হঠাৎ ছাত্রলীগের অনুপ্রবেশ, শিক্ষকমণ্ডলীরা লাঞ্চিত হয়, ভিসি মহোদয় পুলিশী সহায়তায় বাসবভনে চলে যায়। ছাত্র ছাত্রীরা তাদের সাথে সাথে যায় এবং বাসবভনের সামনে অসহিংস অবস্থান করে।
২ সেপ্টেম্বর: ভিসি, প্রভিসির কুশ-পুত্তলিকা দাহ। ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভ মিছিল, শিক্ষকদের অংশগ্রহন, ভিসি. প্রভিসি অফিসে অনুপস্থিত, ভিসি অফিসে শিক্ষক-ছাত্রদের অবস্থান কর্মসূচী, পুলিশের বাঁধা, ছাত্রলীগের সাদা পোষাকধারী বহিরাগতদের ক্লাশ শুরুর দাবিতে মিছিল, ভিসি অফিসে বহিরাগত ছাত্রলীগের অনুপ্রবেশের চেষ্টায় দরজায় বাধা, ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহৃত মাইক কেড়ে নেয় ছাত্রলীগ, মাইকের রিক্সাওয়ালাকে বেধরক মারধর করে, শিক্ষকদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে তারা।
৩ সেপ্টেম্বর:
সকালে প্রতীকী রক্তপাত কর্মসূচি পালন করেন। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল ভবনের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের শরীর থেকে সিরিঞ্জ দিয়ে রক্ত সংগ্রহ করে তা বোতলে জমা করেন। এরপর তাঁরা একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে প্রশাসনিক ভবনে উপাচার্যের কার্যালয়ে যান। সেখানে উপাচার্যকে না পেয়ে তাঁরা সামনের সিঁড়িতে দুই বোতল রক্ত ঢেলে দেন। এরপর তারা পলাশীর মোড়ে অবস্থান নিয়ে বেলা প্রায় তিনটা পর্যন্ত রাস্তা অবরোধ করে রাখেন।
প্রতীকী রক্তপাত কর্মসূচি চলাকালে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ‘বুয়েটের বর্তমান উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে সেখানে একটি খুনের ঘটনা ঘটে। এরপর তিনি সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হন। আমরা আশঙ্কা করছি, মিথ্যা মামলা ও সন্ত্রাসী দিয়ে হামলা চালিয়ে বুয়েটেও রক্তপাত ঘটাতে চাইছেন তিনি। তাই আমরা নিজেরা আমাদের রক্ত সংগ্রহ করে উপাচার্যকে দেব। আমরা তাঁকে বলতে চাই, আমাদের রক্ত নিন, তার পরও বিদায় হোন।’
শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী এই দুজনের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন। এর পাশাপাশি বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেন।
পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। তাই সরকার না বললে পদত্যাগ করব না।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) চলমান আন্দোলন কাল মঙ্গলবার বেলা ১১টা পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।আজ সোমবার শিক্ষা সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন স্থগিত করা হয়। তবে কাল বেলা ১১টার পর থেকে আবারও পরবর্তী কর্মসূচি পালন করা হবে বলে আন্দোলনরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।
মন্তব্য: বুয়েটের ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয় এই আন্দোলন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা এতে শামিল হয়েছেন যাদের একটা বড় অংশ আ:লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তবুও তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন সেখানে ছাত্রলীগ ও সরকারের ভূমিকা অনেকটা একত্তরের রাজাকারদের মতই জনগণবিরোধী। যা তরুন সমাজ সহ পুরো দেশবাসীকেই হতাশ করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৮:২৮