সন্ধ্যার আগেই মারা গেলেন চাঁন মিয়া।
মৃত্যুর খবর পেয়ে চাঁন মিয়ার আত্মীয়স্বজন ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসে। লাশ নিয়ে যেতে হবে বিনোদপুরে। সেখানেই চাঁন মিয়ার বাড়ি। ঢাকা থেকে বিনোদপুরের দূরত্ব প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার। লাশবাহী গাড়িতে ধরাধরি করে চাঁন মিয়ার লাশ উঠানো হল। তার লাশের উপরে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল। লাশের গাড়ীতে আর কে যাবে? তা নিয়ে সংশয় দেখা দিল। শেষ পর্যন্ত চাঁন মিয়ার বড় ছেলে কবির এবং দুইজন হুজুর লাশের গাড়িতে উঠে বসলেন। তারা দোয়া-দুরুদ পড়তে শুরু করলেন।
লাশবাহী গাড়ী এগিয়ে চলছে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে অর্ধেকটা পথ পেরিয়ে গেল। এতক্ষণ রাস্তার চারপাশে হালকা আলো থাকলেও এখন তার রেশমাত্র নেই। এখন রাস্তার দু’পাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে মাঝে দূরে কোথাও শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে গাড়ি দু’টি দূরন্ত গতিতে ছুটছে। হঠাৎ করে লাশবাহী গাড়িটি থেমে গেল। হুজুরের নিজেদের মাঝে বলতে লাগলেন, ‘ঘটনা কী? মাঝপথে লাশের গাড়ি থামল কেন?'
লাশবাহী গাড়ির চালক তেমন কোন জবাব দিল না। সে ছোট টর্চ হাতে গাড়ি থেকে নেমে এল। গাড়ির সামনের চাকার দিকে ঝুকে টর্চের আলো ফেলে সে কি যেন দেখতে লাগলো। বোধহয় চাকায় কোন সমস্যা হয়েছে। সে কিছুটা সময় নিয়ে সামনের দু’টি চাকার স্ক্রু শক্ত করতে লাগলো। মাইক্রোতে কয়েকজন বলাবলি করতে লাগলো, ‘লাশের গাড়ি কোথাও থামাতে নাই। থামালেই বিপদ হয়।’
চাকার সমস্যা সারাতে কিছুটা সময় পার হয়ে গেল। নতুন করে লাশবাহী গাড়িটি যাত্রা শুরু করলো। গাড়িটি আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু বড় পরিবর্তন দেখা গেলো খানিক বাদে। হঠাৎ করে কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করলো। রাতের অন্ধকারের কুকুর ডাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হয় তখনই, যখন একসাথে এতগুলো কুকুর কর্কশভাবে ডেকে ওঠে। এমনকি সবগুলো কুকুর কালো বর্ণের। তারচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল, সেই কুকুরগুলো পাল্লা দিয়ে লাশের গাড়ির সাথে ছুটছে।
লাশের গাড়ির গতি আগের চেয়ে বেড়ে গেল। সেই সাথে বেড়ে গেল কুকুরদের দৌড়ের গতি। অনেকক্ষণ যাবত কুকুরগুলো লাশের গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দুই-একটা কুকুর লাশের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পথ রোধ করতে চাচ্ছে। আবার মুহূর্তেই সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতর একে অপরের দিকে তাকাল। কোন বিপদ নয় তো! লাশবাহী গাড়ির চালক বিচক্ষণ মানুষ। তিনি এ লাইনে অনেকদিন যাবত কাজ করছেন। আদি অন্ত বুঝতে তার তেমন কোন কষ্ট হয় নি। তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছেন। এখানে অস্বাভাবিক কিছু একটা হতে চলেছে। এখন কিছুতেই গাড়ি থামানো যাবে না। গাড়ি থামালেই যে কোন বড় ধরণের বিপদ হয়ে যেতে পারে। এমনকি চালক ভেতরের হুজুরদের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, ‘হুজুর জোরে জোরে দোয়া-দুরুদ পড়েন। লাশ নেওয়ার জন্য একদল চইলা আইছে। আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকেন হুজুর। নাইলে বিপদ হইয়া যাইবো। বড় ধরনের বিপদ।’
কুকুরের কর্কশ গর্জন এতক্ষণ পর্যন্ত জোরালো ছিল। এখন কিছুটা ক্ষীণ হয়ে আসছে। অবশ্যি, এখন কোন কুকুর দেখা যাচ্ছে না। তবে কুকুরের ‘ঘেউ ঘেউ’ শোনা যাচ্ছে। যদিও সেটা কিছুটা অস্পষ্ট। এমন সময় ঘটে গেল আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা। সকলের নাকে এক ধরণের উৎকট গন্ধ ভেসে আসতে লাগলো। এই গন্ধ অনেকটা পচা লাশের গন্ধের মত। এবার হুজুর দুইজন নিজেদের মধ্যে কি যেন বললেন। তারপর তারা শব্দ করে ‘সুরা ইয়াসিন’ তেলাওয়াত করতে লাগলেন। লাশবাহী গাড়ির চালক কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলেন। লাশবাহী গাড়ির সকল জানালা বন্ধ করা। খুব দ্রুত গাড়ি চলছে। এমন অবস্থায় কিছুতেই গাড়ির বাহির থেকে ভেতরে দুর্গন্ধ আসার কথা নয়। তাহলে কিভাবে এসব হচ্ছে? তবে কি বিপদ চলেই এল! চালক কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছেন না।
ভোরে লাশের গাড়িটি বিনোদপুরে চাঁন মিয়ার বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায়। বাড়ির সামনে চেনা অচেনা অনেকের ভিড় লক্ষ করা গেল। সকলেই শেষবারের মত এ গাঁয়ের একমাত্র কবিরাজ চাঁন মিয়াকে দেখতে এসেছেন। উঠানে চাঁন মিয়ার লাশ রাখা হল। পরান মসজিদ থেকে হুজুর ডেকে আনলো। চাঁন মিয়াকে গোসল করাতে হবে। এরই মাঝে একজন এসে চাঁন মিয়ার কবরের মাপ নিয়ে গেল। মাটি থেকে মানুষের জন্ম। আর মাটিতেই শেষ ঠিকানা। এই সত্য মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই মানবজাতির।
উঠানের একপাশে পর্দা দিয়ে বেষ্টনী দেওয়া হল। ধরাধরি করে চাঁন মিয়াকে সেই বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে যাওয়া হল। তিনজন হুজুর চাঁন মিয়াকে গোসল করাতে লাগলেন। একজন হুজুর বরই পাতা মিশ্রিত গরম পানি একটু একটু করে তার শরীরে ঢালতে লাগলেন। আর আলতো হাতে পরিস্কার করছেন তার শরীর। গোসলের এক পর্যায় চাঁন মিয়াকে একপাশ করে শোয়ানো হল। আর তখনই ঘটে গেল বিনোদপুরের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা।
চাঁন মিয়ার লাশ নড়ে উঠলো। হুজুরেরা একে অপরে দিকে তাকালেন। হুজুরেরা ভাবলেন, তারা হয়তো ভুল দেখেছন। এই ভেবে তারা আবার চাঁন মিয়াকে গোসল করাতে লাগলেন। তখন চাঁন মিয়া চোখ খুললেন। ভয়ে একজন হুজুর চিৎকার দিয়ে সেখান থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। বাকি দুইজন হুজুর যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছেন না। এবার চাঁন মিয়া শোয়া থেকে উঠে বসলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি পাশে রাখা সাদা কাফনের কাপড় শরীরে পেঁচিয়ে নিলেন। তারপর কাফনের কাপড় শরীরে জড়িয়ে তিনি পর্দার বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে গেলেন।
চারপাশের শত শত জোড়া উৎসুক চোখ চাঁন মিয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এ তারা কি দেখছে? একটু আগেও এই মানুষটি মৃত ছিল। এখন জীবিত হল কিভাবে? তারা ভুল দেখছে না তো
উপন্নাসঃ 'মায়াস্নান'
লেখকঃ গোলাম রাব্বানী
প্রকাশনীঃ নওরোজ কিতাবিস্তান
প্রকাশিত হবে অমর একুশে বইমেলা ২০১৯ এ ...........
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:২২