আম্মু, ওটা কি?
-ওটা আকাশ বাবা।
আম্মু, ওটার রঙ সাদা নাকি নীল?
-আকাশ নীল হয় বাবা।
আম্মু, তাহলে মাঝে মাঝে সাদা দেখায় কেন?
-নীলের মাঝে সাদার ছোপ, কিন্তু এটা নীল ই হয় বাবা।
আম্মু, তুমি পারো নাই, বলে কোলের ছেলেটি হাহাহাহা করে হেঁসে উঠে। সেই হাঁসি দেখে তার মা ও সমস্ত সুখ উজাড় করে দিয়ে হাঁসে। এ হাঁসি যেন পৃথিবীর সব সুখ কেই হার মানে।
আম্মু, চল না একটু ছাদে যাই। সকালে যে আকাশ টা তুমি দেখিয়েছ তা রাতে দেখতে কেমন সেটা দেখবো। মায়ের প্রচণ্ড মাথা ব্যথা। সারাদিন অফিস করে, বাসায় এসে ময়লা কাপড় চোপড় ধুয়ে, রান্না করে তিনি এখন বড্ড পরিশ্রান্ত। মাথা ব্যথায় ভেঙ্গে পড়ছেন রেহানা বেগম। কিন্তু "যুদ্ধ" কে কিছুই বুঝতে দেন নি। যুদ্ধ তার একমাত্র ছেলের নাম। যুদ্ধের ছাদে যাওয়ার কথা শুনে মাথা ব্যথা নিয়েই ছাদের দিকে হাঁটা দিলেন। এই অসুস্থ শরীরে ছেলেকে কোলে নিয়ে সিঁড়ী ভেঙ্গে একে একে পাঁচ তলার ছাদে উঠলেন।
আম্মু, দেখছ রাতের আকাশ টা কত সুন্দর?
-হ্যাঁ, বাবা রাতে সবাই ঘুমোতে যায় তো তাই আকাশ টা অনেক সুন্দর হয়।
আম্মু, ঐ উপরে যে বাতি জ্বলে, ওটার নাম কি?
-ওটা তোমার চাঁদ মামা।
আম্মু, এটা কি তাহলে তোমার ভাই?
-আমার ভাই হবে কেন?
তাহলে, সে আমার মামা হবে কেন?
এটা সবার ই মামা। আমার মামা, তোমার মামা, আবার তোমার বাবারও মামা।
-তোমার মামা হলে আমার মামা হবে না, আমার নানা হবে। যুদ্ধ মায়ের কোলে থেকে আবার জোরে জোরে হাঁসে। সেই সাথে মা ও হাঁসে। তাঁর মাথা ব্যথারা ঘুমোতে গেছে।
আচ্ছা, আম্মু বললা না? আব্বু কই?
-তোমার আব্বু চাঁদ মামার বাড়িতে ঘুমিয়ে আছে। ঘুম শেষ হলেই চলে আসবে।
-কবে আসবে আব্বু? তুমি সেই কবে থেকেই বলে যাচ্ছ আব্বু আসবে, আব্বু আসবে, কিন্তু আব্বু তো আর আসে না। তাহলে কি সবার যেমন আব্বু আছে, আমার সে আব্বু নাই?
যুদ্ধের এমন প্রশ্ন রেহানা বেগম আর উত্তর দিতে পারেন নি। সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তেই তাঁর চোখ ছলছল করে উঠে। মনে পড়ে যায় যুদ্ধের জন্মের ৩ মাস আগের কথা। কোন এক এক্সিডেন্ট এ মারা যান তাঁর স্বামী শরীফ মির্জা। তার পর পরই শুরু হয় রেহানা বেগমের যুদ্ধ, জীবনের যুদ্ধ, বেঁচে থাকার যুদ্ধ, টিকে থাকার যুদ্ধ, অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ, আর যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর জীবন পার করতে হবে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তাই ছেলের নাম রাখেন "যুদ্ধ"। মাত্র ২৭ বছরে বিধবা হয়ে যান তিনি। বাবার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য অনেক চাপ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি করেন নি। যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ করতে হবে বলে আর কাউকে গ্রহণ করেন নি। বাকি জীবন টাও এভাবেই পার করে দিবেন তিনি। তিনি একজন মা। তাঁর সন্তানের ভালোর জন্য তিনি যে কোন কিছুই করতে পারেন।
আমাদের প্রত্যেকের মায়ের জীবনে হয়তো চেয়ে বড় বড় ক্ষতের দাগ আছে। কিন্তু কোনদিন আমাদের তা বুঝতে দেন নি। সবসময় হাঁসি মুখে সব করে যান তিনি। একটু মনে করুণ, ছোট বেলার কথা, জাস্ট একটু মনে করার চেষ্টা করুন। উত্তর পেয়ে যাবেন। সব অপূর্ণতা দূরে ঠেলে কানা কানায় পরিপূর্ণ করে তুলেছেন মায়ের ভালোবাসা দিয়ে।
আমরা টাকা চাইলে শাড়ির আঁচল থেকে টাকা দেন, খেলনা চাইলে নিজের ঈদের জামা না কিনে আমাদের খেলনা কিনে দেন, আরও কত কি।
ছোটবেলায় মাকে কত জ্বালাতন করেছি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এখন আমরা অনেক বড় হয়ে গেছি। আমরা নিজেদের অনেক কিছু ভাবি। আমাদের খারাপ সময়ে মা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে আমরা সে হাত ঝাড়া মেরে ফেলে দেই। আমাদের সাথে কথা বলতে আসলে আমরা বলে দেই কথা বলার টাইম নেই আরও কথা শুনিয়ে দেই "এতো বেশি কথা বল কেন তুমি?"। কিন্তু ভুলে যাই চাঁদ মামার রহস্য উদঘাটনে মাকে কত বিরক্ত করেছি কিন্তু মা সব হাঁসি মুখে উত্তর দিয়েছেন। একটুও বিরক্ত হন নী। এমনকি আমাদের রিলেশন ব্রেক আপ হলে সেই রাগ ও সারাই মায়ের উপর দিয়ে। মা সব বুঝে কিন্তু সব হাঁসি মুখে উড়িয়ে দিয়ে নিজের সন্তান কে নিজের আঁচলে বেঁধে নেয়। কারণ এটাই যে তাঁর ধর্ম। তাই সন্তান যাই বলুক না কেন, আড়ালে চোখ ছলছল করে উঠলেও আমাদের তা বুঝতে দেয় না।
আমার কাছে না খুব অবাক লাগে। যার একদিনের জন্য মা দিবস পালন করে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় মা কি শুধুই ১ দিনের জন্য? তাহলে আমরা একদিনের জন্য কেন পালন করছি? কেন ৩৬৫ দিনের জন্য নয়? কেন প্রতিটি মুহূর্তের জন্য নয়? কেন জন জনমের জন্য নয়?
কিছু প্রশ্ন রেখে দিলাম আপনার কাছে,
-আপনার মা সত্যি ই ভালো আছেন তো?
-তাঁর হাঁসির মাঝে কষ্ট গুলো লুকিয়ে নেই তো?
-অন্তত আপনার মা আপনার ব্যবহারে অসুখী নন, এটা কি নিচ্ছিত করতে পারবেন? বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন আপনি?
-তাঁর কি এমন দুঃখ, একটু চেষ্টা করলে খুঁজে বের করা যায় না কি?
সব বাদ, আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে না। আমরা শুধু একটু হাঁসি মুখে তাঁদের সাথে কথা বলি? একটু? অন্তত একটু? আমরা কি পারি না? আমাদের মায়েরদের কেবল মাত্র ১ দিনের জন্য না রেখে জন জনমের জন্য ভালো রাখতে?
সহজ উত্তর পারি। যতক্ষণ মায়ের সামনে থাকবো, ততক্ষণ অন্তত বাহিরের ব্যপার নিয়ে মাথা ঘামাব না কিংবা অন্য কারণে মন খারাপ হলে তাতে মাকে দোষারোপ করবো না। আমরা সত্যি ই কি পারবো?
মা, তুমি মিশে আছো পূর্ণতায়, আত্মায়, বিশুদ্ধতায়, ভালোলাগায় আর অনেক টা বেশি পরিমাণ ভালোবাসায়।
পৃথিবীর সব মায়ের ভালো থাকুক জন জনমের জন্য !!!
---গোলাম রাব্বানী
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৬ সকাল ৮:৫৬