মুহাম্মদ জাফর ইকবালের আমার বন্ধু রাশেদ পড়েননি এমন ব্লগার হয়তো খুব কমই আছেন। রাশেদ নামের সেই দুরন্ত,সাহসী কিশোর চরিত্রটি আমার মনে গেঁথে ছিল অনেকদিন। বইটি কৈশরে যারা পড়েছে রাশেদের জন্য দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েনি এমন কিশোর হয়ত খুব কমই আছে।তাই সাধারণত এমন জনপ্রিয় এক চরিত্রকে চলচ্চিত্রতে রূপায়িত করা পরিচালকদের জন্য রীতিমত দুঃস্বপ্ন।কিন্তু ছবিটি দেখার পর বলতে হয় পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম দর্শকের হৃদয় ছুঁতে সক্ষম হয়েছেন তার পরিচালিত এই ছবিটি দিয়ে। এর আগেও জাফর ইকাবালের আরেকটি শিশুতোষ গল্প দীপু নম্বর টু এর কাহিনী তিনি চলচ্চিত্রে রূপ দিয়ে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছিলেন।
হ্যাঁ। হয়তো বাজেটের সীমাবদ্ধতা অথবা সেই ধরণের শক্তিশালী কিশোর অভিনেতা খুঁজে না পাওয়া,স্ক্রিপ্টে ইংরেজি শব্দের আধিক্য,ক্লোস শটের অতিরিক্ত আধিক্য ইত্যাদি কারণে মুভিটার কিছু দুর্বলতা রয়েছে ঠিকি; কিন্তু তারপরও বলতে এই ধরণের একটি ছবিকে হলে গিয়ে দেখলে আপনি নিরাশ হবেন না। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র বিকাশে রুচিশীল দর্শকদের হলমুখী করার জন্য এবং নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তুলে ধরার জন্য এই ধরণের ছবিকে উৎসাহ দেওয়া আমাদের নাগরিক কর্তব্যের মধ্যেই পরে বলে আমি মনে করি। সবচেয়ে ভাল লেগেছে যখন দেখলাম অনেক মা তাদের ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে এসেছেন।এবং ছবিটির সাথে দর্শকরা ভালভাবেই মানিয়ে নিতে পেরেছেন।একটু কমেডি,একটু একশন,একটু প্রেম,একটু দুরন্তপনার সংমিশ্রণে সাবলীল গতির একটি ছবিটি।
আমার বন্ধু রাশেদের যেই দিকটি আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে তা হল, সম্ভবত এই প্রথম কোন বাংলা চলচ্চিত্রের যুদ্ধাপরাধের সাথে জামায়াতে ইসলামীর নাম উল্লেখপূর্বক সংশ্লিষ্টতার কথা তুলে ধরা।এর আগে কেউ বোধহয় এই ধরণের সৎসাহস কেউ দেখাননি।তাছাড়া ছবিটির মাঝে আরও কিছু ম্যাসেজ দিয়ে পরিচালক বুঝিয়ে দিয়েছেন আসলে পাকিস্তান থেকে মুক্তি মানে আমাদের ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তচিন্তার দিকে যাত্রা। তাছাড়া পাকিস্তানীদের বর্বরতা এবং তাদের এই দেশীয় দোসর রাজাকার আলবদরের ৭১ ভূমিকাও এই ছবিতে খুব ভালভাবে ফুটে উঠেছে।এই জন্য পরিচালকে মোরশেদুল ইসলামকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
কাহিনী সংক্ষেপ ঃ "ছবিটির প্রেক্ষাপট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে মফস্বলের ছোট একটা শহর। আর চরিত্রগুলো হচ্ছে কয়েকজন স্কুলছাত্র। মূল চরিত্র রাশেদ হঠাৎ স্কুলে হাজির হয়। তার নাম আসলে রাশেদ নয়, স্কুলের শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের নিয়ে রাশেদকে এই নামটি দিয়েছিলেন। ছবিতে দেখা যায়, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলো যখন ছোট ছোট ছেলেরা বুঝতে পারছে না, রাজনীতিসচেতন রাশেদ তখন ঠিক তার মতো করে সেটা সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
একসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং একদিন এই ছোট শহরেও তারা এসে হাজির হয়। ভয়ংকর এক ধ্বংসলীলার সাক্ষী হয়ে থাকে রাশেদ। স্বাধীনতাসংগ্রামের শুরুতে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে সে। সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু। সম্মুখযুদ্ধে বন্দী হয়ে যায় তাদের পরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধা। একদিন রাশেদ ও তার বন্ধুরা তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে।
কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলে রাশেদ ও তার বন্ধুদের একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয়। রাশেদ আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব বন্ধু যখন আবার একত্র হয় ছোট্ট শহরটিতে, তারা আবিষ্কার করে রাশেদ নামের বিচিত্র ছেলেটি আর নেই। কিন্তু রাশেদের স্মৃতি তার বন্ধুদের হূদয়ে বেঁচে থাকে চিরদিন।"
উপরের কাহিনী সংক্ষেপ অংশটুকু প্রথম আলোর এখান হতে নেওয়া।
ছবিটির শুটিং হয়েছে দিনাজপুরে।আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে লোকেশনটি। ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ড এতই প্রাসঙ্গিক এবং মনোমুগ্ধকর যা আপনাকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে অতীতের সেই সময়টিতে।
পীযূষ বঙ্গোপাধ্যায় এবং রাইসুল ইসলাম আসাদের মত দুই অসাধারণ অভিনেতার উপস্থিতি ছবিটিকে করে তুলেছে আরো প্রাণবন্ত।তাছাড়া রাশেদ চরিত্র অভিনয় করা জাওয়াতা আফনানকেও যথেষ্ট সাবলীল মনে হয়েছে আমার। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা অভিনেত্রীরাও যথেষ্ট দক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন।
সব মিলিয়ে বলতে হয় অসাধারণ এই ছবিটি হলে গিয়ে দেখলে আপনার জীবনের ভাল কিছু সময়ের মধ্যে হয়তো আরো একশ মিনিট যুক্ত হবে। সবাই হলে গিয়ে ছবিটি উপভোগ করবেন আশা করি।
ছবিটির অফিশিয়াল ওয়েবসাইট পাবেন এখানে ।