কোন একটি বিষয়ভিত্তিক টপিকের উপর চলচ্চিত্র নিয়ে লেখা শুরু করতে গেলে আমার প্রথমেই যে সমস্যায় পড়তে হয় তা হল উপযুক্ত মুভি খুঁজে বের করা।এই সুবিশাল মুভি জগতের মধ্য থেকে টপিক অনুযায়ী মুভিকে শর্ট-লিস্ট করা অত্যন্ত দুরহ একটি ব্যাপার।নারীনীতি নিয়ে ইদানীং অনেক হইচই শুরু হওয়াতে এবার ভাবলাম নারীদের দুর্দশা,কষ্ট,অবহেলা এসব নিয়ে একটি মুভি ব্লগ লেখা যাক। পশ্চিমা সভ্য দেশ হতে অন্ধকারাচ্ছন্ন আফ্রিকা অথবা পশ্চাৎপদ ভারতবর্ষ থেকে শান্ত ওশেনিয়া সবখানেই কিন্তু লিঙ্গ বৈষম্য কম বেশী রয়েছে।সে যাই হোক,মুভি নিয়ে পোস্ট লিখতে বসে যে ঝামেলাই পড়লাম তা হল শুধু মাত্র আমার কালেকশনে থাকা মুভিগুলোর মধ্যেই এই টপিকে ২৩টা মুভি পেলাম।এবং এদের সবগুলোই আলাদাভাবে পোস্ট দেওয়ার যোগ্য। অবশেষে কোনরকমে শর্ট-লিস্ট করে কয়েকটি পর্ব আকারে এই সিরিজটি প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে।
সবার প্রথমে যেই মুভিটি নিয়ে আলোচনা করা না করলেই নয় সেটি হল বেলজিয়ান একটি মুভি রসেটা ।
রসেটা /Rosetta নামের এই মুভিতে আপনি দেখবেন রসেটা নামের ১৭ বছর বয়সী এক টিনএজ মেয়েকে যার অনুভূতি শূন্য,শুধু সাদাকালো জীবন হয়তো আপনাকেও কাঁদাবে।জীবনের নির্মমতা,তিক্ততার কারণে সে কখনো স্বপ্ন দেখতে শিখেনি।প্রেম,ভালোবাসা,বন্ধু তার কাছে শুধু বিলাসিতা মাত্র।তার আবাস তার এলকোহলিক মায়ের সাথে শহর থেকে অদূরে এক ট্রেইলার হোমে।জীবনযুদ্ধ যে অনেকের জন্য কতটা কঠিন হতে পারে তা এই ছবিটি না দেখলে বোঝা যাবে না।আমরা একটু জ্যামে,একটু লোডশেডিং হলেই কাতর হয়ে ভাগ্যকে অভিশাপ দিই।কিন্তু ভাবিনা আমাদের চেয়ে অনেকের জীবন আরো কষ্টের।আপনার নিজের জীবন নিয়ে হয়ত আপনাকে দ্বিতীয়বার ভাবাবে এই ছবিটি।
কানাস ফিল্ম ফেস্টিভালে সর্বোচ্চ সম্মানের পুরস্কার পালমে ডি ওর তথা গোল্ডেন পাম জেতা পুরো মুভিটির বেশীরভাগ শটই হ্যান্ড হেল্ড ক্যামেরা দিয়ে তোলা এবং প্রতিটি শটেই রয়েছে রসেটার উপস্থিতি। এইসব কারণে হয়তো মুভিটি আপনার বিষণ্ণ এবং হতাশাপূর্ণ লাগবে।কিন্তু আপনাকে এই বিষণ্ণ ভাবটা দেওয়াই এই ছবির পরিচালক ডারডিনে ব্রাদার্স এর উদ্দেশ্য। কারণ রসেটা চরিত্রটিই যে আসলে বিষাদময়। সেই সাথে অভিনেত্রী এমিলি ডেকুইন্যের অসাধারণ সাবলীলতা রসেটা চরিত্রটিকে পূর্ণাঙ্গতা দিয়েছে।
এখানে ডারডিনে ব্রাদার্সদের সম্পর্কে দুটো কথা না বললেই নয়।জ্যেন পিয়েরা ডারডিনে এবং লুক ডারডিনে এই দুই বেলজিয়ান পরিচালক ভ্রাতৃদ্বয় আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত একটি নাম। তাদের পরিচালিত ল্যা ইনফ্যান্ট এবং সাইলেন্স ডি লরনা বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভালে এর আগে বহুল আলোচিত হয় এবং ল্যা ইনফ্যান্টও পাল্মে ডি ওর জেতে কানাসে।
রসেটা ছবিটি দেখলে আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন মানুষ টিকে থাকার জন্য কতটুকু বেপরোয়া হতে পারে।রিকেট নামে যে ছেলেটি তাকে সাহায্য করে, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়,নিজের চাকরীর জন্যে রসেটা সেই রিকেটকের চাকরীই কেড়ে নেয়।
ছবিটি দেখার পর কিছুটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা হয়তো আপনাকে ছুঁয়ে যাবে।মুভিপ্রমীকরা না দেখলে মিস করবেন।কিন্তু যারা একটু ভারী মুভি দেখতে অভ্যস্ত নন তারা হয়তো মুভিটি দেখে খানিকটা নিরাশ হবেন।তারপরও সবাইকে আমি অনুরোধ করব মুভিটি দেখার জন্য।
টরেন্ট ডাউনলোড লিঙ্ক
দা মিল্ক অফ সরো নামে পেরুভিয়ান ছবিটি যারা দেখেছেন তারা হয়তো ইতিমধ্যে ফাউস্তা চরিত্রের রুক্ষতার পরিচয় পেয়েছেন। মিল্ক অফ সরো নামে একটি অস্বাভাবিক রোগের শিকার হয় ফাউস্তা।যদি গর্ভাবস্থায় মা ধর্ষিত হন তবে পরবর্তীতে মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে এই রোগটি মেয়ে শিশুর মাঝে ছড়িয়ে পরে।রোগটির লক্ষণ হল আক্রান্ত মেয়েটি ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত সবসময় ধর্ষণের ভয়ে ভীত থাকে।বলা বাহুল্য এই কাল্পনিক রোগটি পরিচালক রূপক অর্থ ব্যবহার করেছেন এখানে।
আশির দশকের শুরু থেকে নব্বই দশকের প্রথম পর্যন্ত পেরু মারাত্মক অভ্যন্তরীণ গণ্ডগোলের মধ্য দিয়ে যায় এবং ফলশ্রুতিতে সত্তর হাজারেরও অধিক লোক মারা যায় যাদের অধিকাংশ হল বেসামরিক জনগণ।সেই সময়ে এক ধর্ষিতার সন্তান হল ফাউস্তা।যে ছোট থেকেই মায়ের দুধপান করার সময় থেকে মায়ের মুখে সেই বিষাদময় সুরগুলো শুনে অভ্যস্ত।সহিংসতা কতটুকু সহিংস হলে এক প্রজন্মে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পরবর্তী প্রজন্মের মানসিকতাতেও তার আঘাতের চিহ্ন রেখে যেতে পারে এই ছবিটি দেখলে হয়ত তা খানিকটা আঁচ করা যাবে। ফাউস্তা কখনো ভায়োলেন্সের মুখোমুখি হয়নি,কিন্তু তারপরও তার ভেতরে পুরুষের প্রতি যে পরিমাণ ভয় তা দেখলে নিজেরই শিউরে উঠতে হয়।
আবেগ প্রকাশে ল্যাটিন আমেরিকানরা এমনিতেই কাটকোট্টা।সেই সাথে তাদের চরিত্রের রুক্ষতা,দৃঢ়তা মিলিয়ে তৈরি ছবি দা মিল্ক অফ সরো পেয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক প্রশংসা।যদিও নিজ দেশে পেরুতে এই মুভি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে।
ছবিটির অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে লেখা আছে "A voyage from Fear to Freedom" যা আক্ষরিক অর্থেই এই ছবিকে সামারাইজ করে।ভীত সন্ত্রস্ত ফাউস্তার চাকরী নিয়ে প্রথম গুটি গুটি পায়ে ঘর থেকে বের হওয়া এবং পরবর্তীতে মা এর মৃত্যুর পর তার মায়ের লাশ নিজে তাদের গ্রামে নিয়ে যাওয়া সব কিছুই যেন এই টাইটেলকে পূর্ণতা দেয়।একিই সাথে পরিচালক এবং অভিনেত্রীর কারিশমা ছবিটিকে নিয়ে গিয়েছে অন্যরকম এক উচ্চতায়।
ছবিটির ধীরগতির শুরু দেখে কিন্তু মোটেও বিচলিত হবেন না।ধৈর্য ধরে পুরোটি দেখে মেটাফোরটি ধরতে পারলে নিশ্চিত ভাল লাগবে।সেই সাথে খানিকটা হলেও পরিচিত হবেন ল্যাটিন আমেরিকার কালচারের সাথে।
টরেন্ট ডাউনলোড লিঙ্ক
এবার আলোচনা করা যাক আরেকটি অসাধারণ মুভি ভ্যভিয়েন নিয়ে।
ভ্যভিয়েন শব্দটি তুর্কী একটি শব্দ।যার মানে হল এমন সার্কিট সিস্টেম যার মধ্যে থাকে দুইটি সুইচ এবং এই দুইটি সুইচ দিয়ে দিয়ে একই জিনিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অনেকটা বেডসাইড সুইচ এবং মেইন সুইচের মত।দুই সুইচ দিয়েই চাইলে আপনি ইচ্ছামত লাইট জ্বালাতে নেভাতে পারবেন।এমন একটি অদ্ভুত নাম দিয়ে যখন হয় ছবি তৈরি হয় তখন তা স্বাভাবিক ভাবেই দর্শকদের মনে আগ্রহ তৈরি না করে পারেনা।
ভ্যভিয়েন ছবিটি একটি ব্ল্যাক কমেডি।তুরস্কের পারিবারিক মূল্যবোধ,চিন্তাধারার সাথে আমাদেরও যে খানিকটা মিল আছে তা এই ছবি দেখলে বোঝা যায়।এবং সেখানকার নারীরাও যে আমাদের দেশের মত পারিবারিক নির্যাতনের স্বীকার তা এই ছবি দেখে ভালভাবেই অনুধাবন করা যায়।
চেলাল এবং স্যাভিলের অসুখী পরিবারই হল এই ছবির কাহিনীর মূল পরিমণ্ডল।স্যাভিলে তার স্বামীর প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং আস্থা রাখলেও চেলাল তার নিজের জীবন নিয়ে খুবি ক্লান্ত।স্যাভিল চরিত্রটি হল এখানে একবারেই বোকা,সহজ-সরল এক নারীর প্রতিকৃতি ।কিন্তু অন্যদিকে চেলাল তার ধূর্ততা দিয়ে বারবারই বোকা বানায় স্যাভিলেকে।এবং সব সময় মানসিক পীড়ার মধ্যে রাখে।একসময় চেলাল স্যাভিলের লুকিয়ে রাখা কিছু টাকা পায় এবং ভাবে এই টাকাগুলো দিয়ে সে তার পরবর্তী জীবন নিজের মত করে কাটিয়ে নেবে।এই ভেবে সে একসময় স্যাভিলেকে খুনের চেষ্টাও করে।কিন্তু তা ব্যর্থ হয়।
চেলাল এই ভয়ে ভীত থাকে যে স্যাভিলে হয়ত জানে যে সে ইচ্ছাকৃত ভাবে তাকে খুন করতে চায়। এই ভেবে সে পরবর্তীতে স্যাভিলের সাথে কোনরূপ খারাপ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে।খুব সাদামাটা কাহিনী মনে হলেও স্যাভিলে চরিত্রে অভিনয় করা অসাধারণ অভিনয় করা অভিনেত্রী বিন্নুর কায়ার কারণে এই ছবিটি মন কাড়বে আপনারও।এত নির্যাতন,দুর্ব্যবহার সহ্য করা এরকম আরও কত স্যাভিলে আমাদের আশে পাশেই আছে তা আপনারাও জানেন। শুধুমাত্র পরবর্তী জীবন একা কাটাতে হবে এই ভয়ে ভীত হয়েই সারা বিশ্বে যে কত স্যাভিলে মুখ বুজে থাকেন তার হিসেব কে রাখে।শুধু আইন,নীতি এসব দিয়েই যে নারীর প্রতি পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ করা যাবেনা তার প্রমাণ এই ছবিটি। প্রয়োজন আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের।
এই ছবিটি আন্তর্জাতিকভাবে তেমন সাড়া না জাগালেও তুরস্কের সেরা ছবি বলে নির্বাচিত হয় ২০০৯ সালে।ছবিটি আগের দু'টো ছবি শুধু মুভিপ্রেমিকদের জন্য হলেও এই ছবিটি সবার জন্য।খানিকটা কমেডি,খানিকটা মেলোড্রামার এই ছবিটি দেখে আশকরি ভালো কিছু সময় কাটবে সবার।
টরেন্ট ডাউনলোড লিঙ্ক
****পরবর্তী পর্বে আরো কয়েকটি ছবি নিয়ে আসবো আপনাদের কাছে খুব শীঘ্রই।মোট চারটি পর্ব করার ইচ্ছে আছে এই থীম নিয়ে।এবং সব পর্বেই থাকবে এই থীমের উপর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু ছবি নিয়ে আলোচনা। ****
****টরেন্টে লিঙ্কগুলো আমাদের দেশের নেট স্পীড বিবেচনা করে দেওয়া।****