নিজেকে জানলে ব্যক্তির কি লাভ হবে, এ প্রশ্ন মানুষের মধ্যে আছে। লাভ হবে, মানুষ সুখদুঃখের উপরের স্তরে অবস্থান করতে পারবে। সাধারণ মানুষ এই সুখদুঃখের অতীত যে তত্ত্ব, তার দ্বারা আকৃষ্ট হয় না। কেননা তার দৃষ্টিতে সেখানে সুখ নেই, দুঃখও নেই-সে তো গাছ পাথরের মত অবস্থা! জড়ত্ব! এই রকম আশঙ্কা তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু সুখদুঃখের অতীত অবস্থা পাথরের অবস্থা নয়। পাথরেতে সুখদুঃখের প্রকাশ নেই শুধু নয়, সুখদুঃখ সেখানে নেই। এই যে সুখদুঃখের পরের অবস্থা, এটি জড় অবস্থা নয়। সুখদুঃখের কারণ হচ্ছে অজ্ঞান। যত দূর অজ্ঞানের রাজত্ব তত দূর সুখদুঃখেরও রাজত্ব। সেখানে তারা আছে, হয় প্রকাশিতরূপে না হয় অনভিজ্ঞব্যক্ত, অপ্রকাশিতরূপে। তাই যতক্ষণ অজ্ঞান, ততক্ষণ সুখদুঃখ থেকে নিষ্কৃতি নেই। আত্মাকে জানা হলে, আত্মার স্বরূপ বোঝা হলে, নিজেকে আত্মা বলে গ্রহণ করতে পারলে সুখদুঃখের বেড়া পার হওয়া যায়। আর এটিই চরম কাম্য সাধনায়রতদের যে, সুখদুঃখের বেড়া পার হবো। কেন, সুখের বা দুঃখের বেড়া পার হবো? দুঃখ আমরা এড়াতে চাই ঠিকই; কিন্তু সুখকে তো এড়াতে চাই না। যা কিছু অনিত্য, তা দুঃখময়। সুখও অনিত্য এবং দুঃখময়। যে-সুখের সঙ্গে সাধারণ মানুষ পরিচিত, সে-সুখ দুঃখেরই এক রূপান্তর মাত্র। সুতরাং এই সুখকে দুঃখেরই এক রূপান্তর বুঝে পরিহার করতে হবে। অর্থাৎ সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে যেতে হবে-আত্মজ্ঞান লাভ করে। আত্মজ্ঞ হলেই সুখদুঃখ থেকে মুক্তি।
আত্মজ্ঞ অতিশয় দুঃখকর, অতি আয়াস-সাধ্য দর্শন। কেন আয়াসসাধ্য? যেহেতু আত্মা দেহের মধ্যে কোথায় যেন এক গোপন কোণে লুকিয়ে আছে। গূঢ় গহন সাধারণের অগম্য এমন একটি স্থলে লুকিয়ে আছে। অজ্ঞানের ভেতরে নিজেকে ঢাকা দিয়ে রয়েছে, আবরণের দ্বারা নিজেকে ঢেকে রেখে হৃদয়-গুহাতে অবস্থান করছে। তাকে আমরা সংসারধর্মবর্জিতরূপে অনুভব করতে পারি, আমরা তাকে হৃদয়-গুহাতে অবস্থিতরূপে জানতে পারি যেখানে অবস্থিত থেকে আমাদের সমস্ত জ্ঞানের উদ্ভাসন করছে, সমস্ত জ্ঞানকে প্রকাশিত করছে। হৃদয়-গুহাতে অবস্থান করে আমাদের চিন্তা প্রবাহের সমস্ত বৃত্তিকে উদ্ভাসিত করছে। আমাদের চিন্তা জগতে যত তরঙ্গ, সেগুলি নিজেরা প্রকাশ পায় না। আত্মা হৃদয় গুহার ভেতরে থাকায় তারা প্রকাশিত হচ্ছে। হৃদয় আলো আমাদের জ্ঞানের কেন্দ্রের উৎস মুখ যা মস্তিষ্কের মাধ্যমে বিকশিত হয়।
জ্ঞানযোগ অত্যন্ত কঠিন। জীবেরা অন্নগত প্রাণ, তাতে আয়ু কম; আর দেহবুদ্ধি কোনমতে যায় না। দেহবুদ্ধি না গেলে জ্ঞান হয় না।
এক জানা জ্ঞান, বহু জানা অজ্ঞান। আবার নানা জ্ঞানের নাম অজ্ঞান।
অদ্বৈত জ্ঞানের পর চৈতন্য লাভ হয়। তখন মানুষ দেখতে পায় যে, একে তিনি বিরাজ করছেন। চৈতন্যলাভের পর আনন্দ। তাই-'অদ্বৈত- চৈতন্য-নিত্যানন্দ'। চৈতন্যলাভ হলে তবে চৈতন্যস্বরূপকে অর্থাৎ নিজকে জানতে পারা যায়। আত্মাকে সাক্ষাৎকার করার নামই জ্ঞান। এ নয়, ও নয়, জগৎ নয়, এইরূপ বিচার করতে করতে, যখন চিন্তাজগৎ স্থির হয়, সব চিন্তা একে লয় হয়, তখনই ঠিক জ্ঞান হয়। কর্মের স্থূল, সূক্ষ্ণ, কারণ, মহাকারণ এর মাঝ দিয়ে চললে জ্ঞান লাভ হয়। এই জ্ঞান যে কি, তা কেউ মুখে বলতে পারে না। এই জ্ঞান উপলব্ধির বস্তু।
জ্ঞান-অজ্ঞানের পার, পাপ-পূণ্যের পার, ধর্ম্মাধর্ম্মের পার, শুচি-অশুচির পার, সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ তিন গুণের পার, প্রকৃতিরও পার। বিষয়বুদ্ধির, কামিনি-কাঞ্চনের আসক্তি থাকলে, জ্ঞান হয় না।
যতক্ষণ বোধ হয় গুরু হেথা সেথা- অর্থাৎ দূরে, ততক্ষণ অজ্ঞান। যখন হেথা হেথা- অর্থাৎ 'তিনিই ইনি'-এই হৃদয়-মধ্যে বিরাজ করছেন দেখা যায়, তখনই জ্ঞান। শুরু হয় আত্মজ্ঞান।
সাধকরা তপস্যার ভিতর দিয়ে পেয়েছেন সত্যের আলো-নন্দনের আনন্দ সংবাদ। আমিটিকে শুধু ভুলে যাও-আর কিছু না পার-শুধু নিজেকে বিলিয়ে দাও শুভ-সাধনায়। বহুজনের সেবায় ধন্য হও, পূণ্য করো তোমার জীবন। মহৎ কিছু পেতে হলে তোমাকে মহৎ মূল্য দিতেই হবে-সইতে হবে অনেক দুঃখের তাপ, ফেলতে হবে চোখের জল, কত প্রতীক্ষার প্রহর কেটে যাবে, এরপর আসবে উজ্জ্বল সেই কাল। যেমন দীর্ঘরাত্রির পর আকাশে ফোটে আলোর কুঁড়ি, আলোর ফুল-তেমনি তপস্যার ভিতর দিয়েই পেতে হয় দুর্লভের সন্ধান, আবাদ করতে হয় সোনার ফসল।
একটি নিয়মের অধীন হয়ে না চললে জীবন গঠন হয় না। যেদিন ভাল লাগল, সেদিন গুরুকে ডাকবো আর যেদিন ভাল লাগল না, সেদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবো, অলস সুখে ঝরে পড়বে মুহূর্তের অফোটা কুঁড়ি, বৃথা জল্পনায় কাটবে দিন-এ সমীচীন নয় মোটেই।
সামান্য সাড়ে তিনহাত শরীর-তার পুষ্টি ও পরিণতির জন্য কত অন্নজল, কত যত্ম ও সেবার প্রয়োজন হয়-আর যে চিন্তা প্রবাহ অসীম, কুটিল যার গতি, অশেষ যার রহস্য, প্রচণ্ড যার শক্তি-তাকে দু'দিনের চেষ্টায় জানবে, তার পরিচয় পাবে? এজন্য চাই তীব্র আকাঙ্খা, ত্যাগ এবং দীর্ঘ দুশ্চর তপস্যা। বহু বহু সংস্কার নিয়ে গঠিত যে জীবন চলার পথ- একদিনে তা দিব্য রূপান্তর অসম্ভব।
অস্থির জীবন-মৃত্যু যার অনিবার্য পরিণতি, অকারণে তাকে নষ্ট না করে, কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে-কোনো মহৎ আদর্শের তলে তা নিঃশেষে নিবেদন করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এখানে জয় ও পরাজয় দুই-ই গৌরবময়।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১০ দুপুর ২:৪৫