ছোটগল্পঃ শহরে এক খুনে আগুন্তুক
তিনজনের কাছে চার হাজার টাকা ধার! এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা পাবে সাঈদ- দুই হাজার। কিন্তু সে-ই হচ্ছে সবচেয়ে সজ্জন ব্যক্তি। গত চার মাসে একবারও টাকাটা চায়নি। মনে হয় টাকার কথা সে ভুলেই গেছে। বরং মাঝখানে কয়েকবার টানাটানি দেখে নিজ থেকেই ধার দিতে চেয়েছিলো। একবার তো জোর করে নিয়ে হাজীতে বিরায়নী খাইয়ে এনেছিলো। নিয়ম হচ্ছে সজ্জন ব্যক্তিকে সজ্জন থাকতে দিতে হয়! তাই শাকেরের উচিত হবে সাঈদের টাকাটা দিয়ে দেওয়া! কারন তাকে আজকে টাকা দিলে, কালকে আবার ধার পাওয়া যাবে। এক মাঘে শীত যায় না। কিন্তু রহমান আর এরশাদ টাকার জন্য তাঁর কান ঝালাপালা করে ফেলল। উঠতে বসতে টাকার খোটা দেয়। এইতো সেদিন দুইজন প্লাজায় আড্ডা মেরে দেরীতে ক্লাশে আসার কারনে, কুইজে শাকেরের পাশে বসতে পারে না। আর এটা নাকি শাকেরের দোষ। এইজন্য সারা ক্লাশের সামনে তাকে কী অপমানটাই না করলো! “ছোটলোক, নিমকহারাম। টাকা নিয়ে খেয়ে বসে আছিস, কিন্তু শোধ দেবার নাম নেই। অকৃতজ্ঞ কোথাকার”।যদিও দুইজনই টাকা ফেরত পাবার আশা ছেড়ে দিয়েছে। শাকেরকে অপমান করে টাকাটা কিছুটা উসুল করাই যেন দুইজনের কাজ!
শাকের ভাবে সবাইকে চমকে দিলে কেমন হয়! তিনজনকে এক হাজার করে টাকা দিয়ে দিলে কেমন হয়? এতে সে সবদিক থেকেই সেইফ সাইডে থাকতে পারবে। শাকের ভাবে টাকাটা দেয়ার সময় তাকে একটা আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সে যে ছোটলোক পরিবারের সন্তান নয়, তারও যে একটি সুবর্ণ, সমৃদ্ধ অতীত আছে-সবাইকে এটা বোঝাতে হবে।
“এই নে ভাই! তোদের টাকা। আমরা সৈয়দ বংশের পোলাপাইন। বাড়ির পাশে এখনো বৃটিশ আমলের প্রসাদ আছে। শুধু ভাঙ্গা আর জরাজীর্ণ আর কি! মন্যুষ বাসের অনুপোযোগী। সৈয়দ বংশের পোলারা কথা দিলে কথা রাখে। একটু দেরি হতে পারে কিন্তু টাকা মেরে খাওয়ার ইচ্ছে তাদের নেই।”
এসব ভাবতে ভাবতে শাকের প্যান্টের ডান পকেটে হাত দেয়। ইশ! কী উষ্ণ! আট হাজার টাকা তাঁর পকেটে। ভাবতেই কেমন জানি অন্য রকম লাগছে! স্বর্গীয় অনুভূতি। এইজন্যই বুঝি বলে, মানি ইজ নেক্সট টু গড!শাকেরের খুব ইচ্ছা করে ওর আব্বুকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, সর্বশেষ কবে আট হাজার টাকা এক সাথে দেখেছে? কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে অভিমান জমা হয়। কী হবে এই লোকটাকে ফোন দিয়ে। এইলোকটি যদি ঠিক মতন কাজকর্ম করত-তবে তার, তার আম্মুর, তার ভাই-বোনদের এমন মানবেতর জীবনযাপন করতে হতো না! কিন্তু লোকটি সবসময় সৈয়দ বংশের জাবর কেটে গেছে।
“আমি হাটে যাবো গরু বিক্রি করতে? এটা তুমি কি বলো সালেহা? মানুষ ঢি ঢি করবে না? সৈয়দ বংশের ছেলেরা যাবে হাটে গরু বিক্রি করতে?সময়টা একটু টানাটানি চলছে । তাই বলেই কি আমি আমার বংশের মুখে চুনকালি দিবো?”
“একটু না, অনেকটাই টানাটানি চলছে”! শাকেরের মা বলে, “এই গরুটা আমি কষ্ট করে পালছি বলেই তুমি এটা বিক্রির টাকা দিয়ে খেয়ে পড়ে বেচে থাকতে পারবা, আর তোমার সৈয়দ বংশের জাবর কাটতে পারবা!”
“সালেহা”! ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বলে শাকেরের বাবা, “তুমি ভুলে যাচ্ছো, তুমি কার সাথে কথা বলছো! তুমি আমাদের বাড়ির বঊ হওয়ার যোগ্য না! ছোটলোক বাড়ির মেয়ে কোথাকার?”
“আমি ছোটলোক বাড়ীর মেয়ে বলেই তোমার ছেলেটা কলেজে পড়তে পারছে? তোমার সৈয়দ বংশের ঘিয়ের ঘ্রাণ অনেক আগেই ফুরিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে কেবল ঘরের পাশের ঐ ইটের ডিবিটা।”
শাকেরের বাবা আর কথা বাড়ায় না। সে বহুল ব্যবহৃত জীর্ণ শালটি কাধে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। যদিও সে মনে করে এটি তার বংশ মর্যাদাকে ফুটিয়ে তুলবে, আসলে এই শালটি তার বর্তমান দুর্দশাকেই দু’চোখে আজ্ঞুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
টাকা উপার্জন এত সহজ! শাকের অবাক হয়ে যায়। মাসে বারো কি ষোল দিন তুমি একটা গাধানতন ছাত্রের সামনে বসে থাকবে, আর মাস শেষে আট হাজার টাকা। অবশ্য তার অন্য বন্ধুরা বলে টিউশনি করা নাকি অনেক কষ্টের। শাকের তাদের কথা শুনে হাসে। আসল কষ্টটা তারা করেনি বলেই, তাদের কাছে টিউশনি করাটা কষ্টের বলে মনে হচ্ছে। শাকের যে কষ্টের সময়টা পার করে এসেছে, সেই তুলনায় সে এখন তো স্বর্গেই আছে বলা যায়।
যেমন ধরো এখন বর্ষাকাল চলছে! গ্রামে থাকলে খুব ভোরে তোমাকে গরুর জন্য কচুরিপানা কেটে আনার জন্য নৌকা নিয়ে বের হতে হত। ছাগলের জন্য ধনচে পাতা। মাঝে মাঝে বিল থেকে শাপলা তুলে নিয়ে হাটে বিক্রি করতে হতো। তিন ঘন্টা কষ্ট করে তোলা শাপলা বিক্রি করতে হত ত্রিশ টাকায়। এক কেজি চাউলও যা দিয়ে কেনা যাবে না। কি আর করবে তুমি উপোশ করো। আর পানির “কামড়ানি”টা হচ্ছে বোনাস। পাপের শাস্তি। কিংবা অন্যসময় মানুষের জমিতে দিন মজুরি। সারাদিনে দেড়শ টাকা, আর দুপুরে আটার রুটি সাথে শুটকির ভর্তা কিংবা আখের গুড়। মজা তো বোঝনি চান্দুরা, তাই টিউশনিকে কষ্টের মনে হয়। সারাদিন কাজ কিংবা ক্লাশ করে রাতে টিঊশনি করতে হত শাকেরকে। টিঊশনিতে সে পেত পার ছাত্র ১০০ টাকা। কেউ কেউ তাও দিত না। সারাদিনের পরিশ্রমের পরে রাত দশটা বাজলে আর শরীর চলত না। পড়াশোনার কিছুই হত না। “আমি হয়ত আইল্যাও হতে পারছি না, জাইল্যাও হতে পারছি না”- এই বোধটা নিয়েই শাকের প্রতি রাতে ঘুমাতে যেত।
এসব ভাবতে ভাবতে শাকের আড়ং এর উল্টাপাশে মানিক মিয়া এভিনিউতে এসে দাঁড়ায়। গন্তব্য তেজকুনি পাড়া। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বাস না পেয়ে শাকের ভাবে, রিকশা নিয়ে গেলে কেমন হয়?
“তোরে কি ভাই কুত্তায় কামড়াইছে? দশটা টাকার জন্য দুইদিন না খেয়ে থাকার কথা কি ভুলে গেছিস? হেটে হেটে যা!ওইতো খামার বাড়ি দেখা যায়”- নিজের সাথে কথা বলার অভ্যাসটা অনেক পুরনো। “তিন হাজার টাকা দিয়ে ধার শোধ করলে হাতে থাকবে পাচ হাজার টাকা। আগামি মাসের খরচ চার হাজার টাকা। এক হাজার টাকা আম্মুকে পাঠাতে হবে। শার্ট কেনার টাকা কৈ? দুইটা পুরোনো শার্ট দিয়ে আর কতদিন? ইশ যদি আর দুই হাজার টাকা বেশি পেতাম!”
শাকের হেসে ফেলে। নিজের ভাবনা নিজের কাছেই হেঁয়ালি লাগে। এইতো সেদিন সে ভাবত পাচ হাজার টাকা রোজগারের ব্যবস্থা হলেই সে বেচেবর্তে যেতো! আর এখন আট হাজার টাকায়ও তার অভাববোধ যাচ্ছে না? তবে কি সে এই শহরের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাচ্ছে?
এইসব ভাবতে ভাবতে শাকের সেজান পয়েন্টের সামনে চলে আসে। ভীড় দেখে এগিয়ে যায়। দেখে কয়েকজন মিলে একজন মধ্য বয়স্ক লোককে পেটাচ্ছে। “কী হয়েছে ভাই?” শাকের কৌতুহলি হয়। “আরে পকেট মাইর।” ভীড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন উত্তর দেয়। শাকের তাকে খুঁজে পায় না। চড়-থাপ্পড় খাওয়া লোকটি ক্রমাগত প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। শাকের জানতে চায়, “কার পকেট মারা গেছে?” সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। কিন্তু কেউ দাবী করে না। শাকের অনেক রিস্ক জেনেও লোকটিকে উদ্ধার করতে এগিয়ে যায়। “কার না কার পকেট মাইর হয়েছে, আর কে করেছে-কিছুই না জেনে এই মানুষটাকে পেটানো হচ্ছে!”এতক্ষন যারা নাটক দেখছিলো, তাদের মধ্যে কেউ কেউ শাকেরের প্রতি রুষ্ট হয়। এমন একটা আনন্দের উৎস নষ্ট করে দিলো। মানুষের অপমান দেখার আনন্দের মত আনন্দ আর নেই। কেউ কেউ একটু উচ্চবাচ্য করার চেষ্টা করে, শাকেরও পকেট মার দলে সদস্য-এই বলে। ক্ষুদ্র একটা অংশ আফসোস করে। “ইশ! কেমন ভালো মানুষটাকে মেরেছে!”যদিও তারাও এত্তোক্ষন মার মার শালারে মেরে ফেল বলে তালি দিচ্ছিলো।
শাকের লোকটিকে হাত ধরে বসায়। কেউ একজন পাশ থেকে একটি পানির বোতল এগিয়ে দেয়। হাপাতে থাকা লোকটির দিকে শাকের ভালো করে তাকায়। দেখে সম্ভ্রান্ত ঘরে ভদ্রলোকই মনে হয়। শু, প্যান্ট আর ইন করে শার্ট পরে আছে লোকটি। জামা-কাপড়ের বয়স আর কন্ডিশনে লোকটির অভাবী সংসারেরই স্বাক্ষি দিচ্ছে। শাকেরের তার বাবার কথাই মনে পড়ে যায়। সে কান্না চাপতে ভিড় ঠেলে বাইরে চলে আসে।
ভীড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে সে প্রথমে তার প্যান্টের ডান পকেটে হাত দেয়-সব ঠিক আছে কিনা, নিশ্চিন্ত হতে। খালি কেন? তার বুকটি ধপ করে উঠে। অন্য পকেটে রেখেছি বোধ হয়। এইভাবনা থেকে সে বাম পকেটে হাত দেয়। তারপর খুব দ্রুত বুক পকেটে। আরও দ্রুত প্যান্টের ডান পকেট-বাম পকেট-পিছনের পকেট-বুক পকেট। কয়েকবার। তার মুখটি বিষাদের কালো মেঘে ডেকে যায়। পরক্ষণেই তার চেহেরা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। সে ঘুরে দৌড় দিয়ে ঢুকে যায় ভীড়ের মধ্যে।
“খানকির পুতেরে পিডাস না ক্যারে?”-বলে শাকের লোকটির বুক বরাবর একট লাথি মারে। লোকটি মাটিতে পরে যায়। হাতের পানির বোতলটি ছিটকে পরে দূরে। উদ্ধারকারী লোকটিই পেটাচ্ছে দেখে-সবাই অবাক হয়। কিন্তু আগের চেয়েও দ্বিগুন উৎসাহে তারাও হাত চালায়।
ক্লান্ত লোকটি তার সর্বশক্তি দিয়ে দুইবার বাধা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইজরায়েলি কামানের সামনে প্যালেস্টাইনের পাথরের ন্যায়ই ব্যর্থ হয় সব বাধা। তারপরও লোকটি তৃতীয়বারের মত বাধা দেওয়ার জন্য হাত তুলে। কিন্তু এইবার লোকটি মাটি থেকে মাত্র হাফ ইঞ্চ উপরে উঠাতে পারে তার হাতটি!
গল্পের পিছনের গল্পঃ কয়েদিন আগে অশ্রু হাসান তার পিক পকেট হয়েছে জানিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই এই গল্পটি লেখার আইডিয়া পাই।
উৎসর্গঃ রহস্যগল্প পছন্দ করা ব্যক্তিটিকে। যদিও আমি রহস্যগল্প লিখতে পারি না এবং এটা কোন রহস্য গল্প নয়।
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন