☗☗☗
(১)
আচমাকে ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেলো একটু আগে। রাস্তাঘাটে তার চিহ্ন পড়ে রয়েছে।এখানে ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গাছের পাতা-ভাংগা ডালপালা,কাগজের টুকরো, ছেড়া কাপড় আর রাজ্যের সব জিনিসপত্র। জায়গায় জায়গায় পানি জমে আছে। বৃষ্টি ধোয়া পরিস্কার আকাশ, চাঁদ নেই কিন্তু তারা ঝলমলে।
কয়েকদিনে তীব্র দাবদাহের পরে, এই বৃষ্টিতে প্রতিটি মানুষ খুঁজে নিয়েছে প্রশান্তির ঘুমকে।তবুও এই রাত তিনটায় ঢাকা শহরের কিছু কিছু মানুষ প্রশান্তির ঘুমকে খুঁজে পায়নি। তারা হয়ত অন্যকিছুকে খুজতে খুজতে ঘুমকে হারিয়ে ফেলেছে কিংবা না ঘুমিয়ে অন্যকিছু খুজছে।
এমন এক নির্জন রাতে,নির্জন রাস্তা দিয়ে যুবকটি হেটে যাচ্ছে। যুবকটি গভীর আগ্রহ নিয়ে রাস্তার পাশে একটি সাগর কিংবা নদী নিদেনপক্ষে একটি পুকুর খুঁজে চলছে। সে একটু আগে একটি খুন করে এসেছে।পাপ ধুয়ে ফেলার জন্য তাঁর অনেক পানির দরকার, অনেক পানির।
☗☗☗
(২)
বৈকালিক ঘুম থেকে উঠে নিচে গিয়ে চা-নাস্তা করে, সিগারেট ফুঁকে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রতিদিনই মাগরিবের সময় পেরিয়ে যায়। আজও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি। বাসায় এসে টিভি রুমে বসে রাহাতের মনে পড়ল আজ সারাদিনে তো একবারও স্মিতা ফোন দেয়নি। রাহাতেরও ফোন দেবার কথা মনে পড়েনি। সবসময় স্মিতাই ফোন দেয়। গত একবছরে রাহাত নিজ থেকে ফোন দিয়েছে এমন কোন নজির রাহাতের মনে পড়ে না। ওর ফোন দেবার দরকারও ছিলো না। স্মিতা নিজেই একটু পরপর ফোন দিত, মাঝে মাঝে এত ঘনঘন ফোন দেবার কারনে রাহাত বিরক্তও হত।
-আরে বাবা! আমি ল্যাবে আছি, রিডিং নিচ্ছি। তুই একটু পরে ফোন দে। এখন রাখ।
-আমি ফোন দিলেই তুমি খালি রাখ রাখ করো!
-ল্যাবে ঢুকার আগেই না তোর সাথে কথা বললাম। আর ল্যাবে আসছি দশ মিনিটও হয়নি।
-চুপ কর! তরে আমার বালেও আর ফোন দিবনা!
এমন করেই আচমকা রেগে যেত স্মিতা। রাহাত জানত দশ মিনিট পরে ঠিকই স্মিতা আবার ফোন দিবে এবং স্মিতা দশ মিনিট পরে ফোন দিয়ে বলেছিলো, এই বান্দর! আমি রাগ করছি, আমার রাগ ভাংগাতে ফোন দিলি না কেন?
কিন্তু আজ সারাদিনেও একটি বারও ফোন দিলো না! আশ্চর্য! কালকে রাতে সে কি জানি বিয়ের কথা না কিসের কথা জানি বলছিলো, রাহাতের মনে পড়ে।
-তুমি তোমার বাসা থেকে লোকজন পাঠাও। আব্বার স্ট্রোকের পরে উনি আমার বিয়ে দেয়ার জন্য পাগল হয়ে পড়ছেন।
-মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম, এখন বাসায় বিয়ের কথা বলি কেমন করে?কয়েকটা দিন ওয়েট করো, আমি বাসায় এসে আব্বু-আম্মুকে বুঝিয়ে বলি, তারপর......।
-আমার পক্ষে আর ওয়েট করা সম্ভব না। তোমাকে অনেক সময় দেয় হয়েছে।
-ধুর বাল! আমি আছি বিপদে, তোমার সাথে যখনই একটু রোমান্টিক মুডে কথা বলতে যাই তুমি তখন খালি বিয়া নিয়া ক্যাচাল করো।
-তুমি বোঝ না কেন, আমার ভাই করে রাজনীতি। কেইস খেয়ে বাসায় থাকতে পারেনা। আব্বার মাথায় ঢুকছে মৃত্যু চিন্তা। উনি তাই আমার একটা গতি করতে চান।
স্মিতা আরও বলে, তোমাকে তো আমি এখনি আমাকে বিয়ে করে বাসায় উঠাতে বলছি না। তুমি তোমার বাসা থেকে লোকজন পাঠাও, উনারা আমার আব্বার সাথে কথা বলে যাক। আর কেউ না আসুক, তোমার বড় কাকাকে পাঠাও তাইলেই হবে। তিনি শুধু একবার কথা বলে যাক। আর শোন ইউ উইল গেট এনাফ টাইম। মনে রেখ আমার বাপ ফকিরা না।
-আচ্ছা দেখা যাক! আগে তো বাসায় আসি।
-না, তুমি কালকেই পাঠাও উনাদেরকে।
- বিয়া করাইলে করাও, নাইলে পুবে যাইগা! আজব কাল সকালে পাঠাই কিভাবে। রিলেশনের শুরু থেকেই এই বালের বিয়া বিয়া করে আমার মাথাটা তুমি খারাপ করে দিলা।
আসলেই সম্পর্কের শুরু থেকেই স্মিতার মুখে এই কথাটি রাহাত বেশি শুনেছে। কোনটা যে সিরিয়াস আর কোনটা যে সিরিয়াস না, এইটা নিয়ে রাহাত সব সময়ই কনফিউশনে থাকত।
-তোর ফোন ধরতে এত দেরি হলো কেন?
-আরে বইলো না, বাড্ডা থেকে এক পোলার মায় আইছে আমারে দেখতে। আট কাঠা জায়গা উপর নাকি বাড়ী আছে।
-তবে বিয়ের দাওয়াত পাচ্ছি কবে?
-আপনার এত খুশি হবার কারন নাই?
রাহাত খুশি হয় কিন্তু হতাশ ভংগিতে বলে, কেন?
-আরে আব্বায় বিয়া দিবো না। একে তো নয়া ঢাকা তাঁর উপর আবার বাড্ডা। কয়দিন আগেও তো ছিলো বিল।
এত সাত-পাচ ভাবতে ভাবতে রাহাত নিজেই ফোন দেয়ার কথা চিন্তা করলো। অসুখ-টসুখও করতে পারে, মরে নাই এইটা ঠিক। মারা গেলে রাহাতের ফ্রেন্ডরা ফোন দিয়ে জানাত। একটু পরে বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ডের খেলা শুরু হবে। তাই রাহাত চাইলো তারাতারি ফোন দিয়ে তারাতারি কথা শেষ করতে, আবালটা আবার কথা বলা শুরু করলে থামতে চায় না।
-ওই সারাদিন ফোন দিলি না ক্যান?
-ফোন দিয়ে আর কি হবে, হয়ে গেছে!
-হয়ে গেছে মানে, কী হয়ে গেছে?
-আমার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের বোনেরা আসছিলো দেখতে। দেখে পছন্দ হওয়াতে ছেলেকে আর কাজীকে ডেকে এনে বিয়ে পড়ানো হয়।
-ফাইজলামি করিস না তো!
-না রে ভাই ফাইজলামি না, সত্যি!
রাহাত অনেক কথা বলতে পারত। তুমি আমাকে জানাওনি কেন যে তোমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? আমি তো বাসা থেকে লোক পাঠাতে পারতাম। আমি জানি নাকি এত সিরিয়াস? কিংবা একেবারে যৌক্তিক প্রশ্ন, তোমার আব্বা-আম্মা হুট করেই বিয়ে দিয়ে দিলো? ছেলে ভালো না মন্দ, বংশ পরিচয় কি, কিছুই না জেনে!
এসব কোন প্রশ্নই রাহাত করতে পারেনি। সে চুপচাপ বসে বাংলাদেশের জয় দেখা শুরু করলো। খেলার মাঝে একটা ফোন এসেছিলো। রাহাতের বন্ধু সুমন করেছিলো।
-তোর স্মিতার তো বিয়ে হয়ে গেলো!
-হরে! কি আর করার নতুন একটা প্রজেক্ট খুঁজে বের করতে হবে। নিজেকে স্ট্রং প্রমান করার জন্য রাহাত বলে।
-শোনলাম স্মিতার নাকি প্রেম করে বিয়ে হয়েছে?
-হ্যা! প্রেম করে বিয়ে হয়েছে, কিন্তু স্মিতার প্রেমিকের সাথে নয়।
☗☗☗
(৩)
ইউনাইটেড হসপিটালের অপজিটে দাঁড়িয়ে রাহাত আর তাঁর বিয়াই সিগারেট টানছে। বিয়াই মানে ওর বড় কাকার পুত্রবধুর খালাতো ভাই। রাহাত এসেছে ইউনাইটেড হসপিটালে তাঁর বড় কাকাকে দেখতে। উনার একটা মেজর অপারেশন হয়ে গেছে। এখানে এসে বিয়াই এর সাথে দেখা। তারপর বিড়ি ফুকতে ফুকতে আলাপ। বিভিন্ন বিষয়ে হাতি-ঘোড়া মেরে তারা এখন রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছে। বলা যায় রাহাত কেবল শুনছে।
-আপনাদের এলাকায় তো ছাত্রদল আগে অনেক স্ট্রং ছিলো। এখন তো মরা মরা। আপনারেও তো আর দেখা যায় না।
-এমনিই ভাই। সংসারই ভালো লাগে না আবার রাজনীতি।
-আপনাদের এলাকার ছাত্রদলের হেডাটার নাম জানি কি?
-আপনি কি অপু ভাইয়ের কথা বলছেন?
-হ্যা! অপু ভাইয়ের কথা বলছি। উনি তো আগে অনেক একটিভ ছিলেন, পাওয়ারও ভালো ছিলো। উনার এক বোনের তো বিয়া হয়েছে আমাদের এলাকায়। মালই একটা। যেমন সুন্দর, তেমন লম্বা।
রাহাত মনে মনে হাসে। আমার এক্স-গার্লফ্রেন্ডের গল্প আমার সাথে করতে আসছো মিয়া!
বিয়াই অনেক কথাই বলে চলেন, রাহাত কেবল হু হা করে। এই লোকটি তাকে স্মিতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তিন বছর আগের পুরোনো স্মৃতিরা আবার জেগে উঠবে। কত রাত তাকে নির্ঘুম কাটাতে হবে, কতদিন সে খেতে পারবে না- রাহাত তা জানে না। এমন একটা মানুষকে সে ধরে রাখতে পারেনি। ঘৃনা নিজেকে। এমন প্রেম সে কোথায় পাবে? কার কাছে পাবে? এমন অকৃত্রিম আর গভীর ভালোবাসা সবাই পায় না, সবাই দিতে পারে না। রাহাত ভাবে, আসলে আমি ওর যোগ্য ছিলাম না। আই ডোন্ট ডিজার্ভ হার। আমার মত একটা অকর্মণ্য, আইলস্যা, ভীতু ছেলে ওকে ডিজার্ভ করে না। ওকে সুইডেন প্রবাসি, কর্মঠ আর স্মার্ট ছেলেটিই ডিজার্ভ করে।
কিন্তু বিয়াইয়ের একটী কথা রাহাতের মনযোগ আকর্ষণ করে। সে কনফার্ম হবার জন্য আবার জিজ্ঞাসা করে, আপনি শিউর তো?
-আরে আমি সিউর মানে, ১০০% শিউর। ৫০০ টাকার স্ট্যাম্প আনেন আমি লিখিত দেই, ওদের প্রেম করে বিয়ে হয়েছে। আর পোলায় আমার বন্ধু মানুষ।
রাহাত দাঁড়িয়ে পরে। কিছু প্রশ্নের জবাব তাকে আজকেই পেতে হবে।
☗☗☗
(৪)
বাসায় ঢুকতেই যেই জিনিসটা চোখে পরে,সেটা হলো স্মিতার একটি ছবি। রাহাতই তাঁর বন্ধু ইমনের ডিএসএলআর দিয়ে তুলেছিলো ছবিটি। তাঁর আনাড়ি হাতে এত ভালো ছবি আসবে সে ভাবতে পারেনি। মডেল হিসেবে স্মিতাও অনেক সুন্দর! ছবিটির দিকে তাকালে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে, অন্তত রাহাত তাই মনে করে। খুবই নিষ্পাপ চেহেরার একটি মেয়ে যাকে এই পৃথিবীর পাপ-পংকিলতা স্পর্শ করেনি- আনমনে তাকিয়ে আছে।
রাহাতকে দেখে সেই আগের মতই খুশি হয় স্মিতা। আর কন্ঠে ঝরে পরে আনন্দ।
-আপনি আসেন না কেন এইদিকে? আমার জামাই তো আর দেশে থাকে না।
কিসের যেন ইঙ্গিত স্মিতার কথায়। রাহাত সব ইঙ্গিত উপেক্ষা করে বলে, তোর কাছে আমার চারটি প্রশ্ন আছে। ঠিক ঠিক জবাব দিবি।
-সারাজীবন তো তুমিই চেয়ে গেলে, আমার কি কিছুই চাইবার নেই?
-আমার প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দে, কথা প্যাচাইস না!
- বলো কি তোমার প্রশ্ন, যে জন্য এত রাতে তোমার এমন হন্যে হয়ে ছুটে আসা?
প্রশ্ন-০১: দানিয়েলের সাথে বিয়ে হবার পর সবাই কেন বলেছে, এটা প্রেমের বিয়ে?
প্রশ্ন-০২: ছেলের বোনরা আসল, দেখল আর বিয়ে হয়ে গেল-ব্যাপারটি কি এতই সরল?
প্রশ্ন-০৩: তুই মাঝে মাঝেই বলতি কেউ একজন তোকে সুইডেন থেকে ফোন দেয়, সেই লোকটিই কি এই দানিয়েল?
প্রশ্ন-০৪: কেনইবা তুই সেদিন রাতেই বললি, কালকে সকালেই আমাদের বাসা থেকে লোক পাঠাতে হবে?
☗☗☗
(৫)
অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল রাহাতের। গতকাল রাতে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে ওর গলা বসে গেছে। বুয়াকে চায়ের কথা বলে অভ্যাসমত সিগারেট জ্বালিয়ে পত্রিকা নিয়ে বসল সে।
পত্রিকার দ্বিতীয় পেইজে একটি খবরে চোখ আটকে গেল তাঁর। রাজধানীতে গৃহবধুর রহস্যজনক মৃত্যু। পাশে ভিকটিমের একটি ছবি দেয়া। ছবিটি দেখে রাহাত স্বগোক্তি করে উঠে, ওরা এই ছবিটি ছাপিয়েছে কেন? মেয়েটিতো এত নিষ্পাপ নয়!
★★★ উৎসর্গঃ জুন আপ্পিকে । এই মাসেই উনার জন্মদিন। আর জন্মদিন উপলক্ষে আমার নগন্য উপহার। শুভকামনা আপ্পি। সুন্দর থাকুন, আনন্দে থাকুন সদা সর্বদা।