somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অজানা আমাজন অরন্য...

২৬ শে জুন, ২০১০ সকাল ১১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ছোটবেলায় তিন গোয়েন্দার "ভীষণ অরণ্য" বই পড়তে গিয়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। আমাজনের জঙ্গল নিয়ে লেখা বইটি খুব চমৎকার লেগেছিল। তখন থেকেই আগ্রহ ছিল আমাজনের ব্যাপারে। তাই সুযোগ পেয়ে একটা পোষ্ট দিয়ে ফেললাম আমাজনকে নিয়ে।


আমাজন বা আমাজন রেইনফরেস্ট (The Amazon rainforest) এর কথা বলতে গেলেই একটি কথা কয়েকবার বলতে হবে; তা হল-- "পৃথিবীর সবচে বড়..."। যেমনঃ পৃথিবীর সবচে বড় বন এটি, পৃথিবীর সবচে বড় রিভার বেসিন (নদীর অববাহিকা) এই আমাজনে, পৃথিবীর সবচে বড় আয়তনের নদী এই অঞ্চলে.....ইত্যাদি।


আমাজন বন হল আমাজন বেসিনে (আমাজন নদীর অববাহিকায়) অবস্থিত পৃথিবীর সবচে বড় নিরক্ষীয় বন (আয়তন সাড়ে ৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার বা ৩.৪ মিলিয়ন বর্গ মাইল), যা দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তরভাগে অবস্থিত ৯টি দেশের অন্তর্ভুক্ত। দেশগুলো হলঃ ব্রাজিল (আমাজনের মোট আয়তনের ৬০% ব্রাজিলে), পেরু (১৩%), বলিভিয়া, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, সুরিনাম, ফ্রেঞ্চ গায়ানা এবং গায়ানা। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের মোট আয়তনের ৪০% এই বনের দখলে। আমাজন বন অত্যন্ত দুর্গম। তবে দ্ক্ষ গাইড সহ নদী পথে ভ্রমন এই নিরক্ষীয় বনের প্রাকৃতিক বিস্ময় দেখার সবচে ভাল উপায়।


ইতিহাস--যেটুকু না জানলেই নয়ঃ
প্রাচিনকাল থেকেই অভিযাত্রীরা আমাজনে যাত্রা করে মূলত স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ধন-রত্নের খোঁজে। পর্তুগীজ অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করত, বিশাল এ বনের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে "এলডোরাডো" (Eldorado) নামক এক গুপ্ত শহর যা পুরোপুরি সোনার তৈরি। এই ভ্রান্ত ধারণাটি এসেছে গ্রীক পৌরাণিক গল্প থেকে যেখানে বলা হয়েছে যে "এলডোরাডো" নামক সোনায় মোড়ানো শহরটি পাহারা দেয় এক শ্রেণীর বিশেষ নারী যোদ্ধারা; যাদেরকে গল্পে "আমাজন" নামে অভিহিত করা হয়েছে। পর্তুগীজ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রীরা প্রতিযোগীতায় নামে এই "এলডোরাডো" শহর আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু কেউ এই কাল্পনিক শহরের সন্ধান পায়নি। শহরের সন্ধান না পেলেও স্থায়ী হয়ে যায় সেই গ্রীক নারী যোদ্ধাদের নাম। তাদের নামানুসারেই এই জঙ্গলের নাম হয় "আমাজন" জঙ্গল।


বনের আবহাওয়া, প্রাণিকুল, বৈচিত্র....
আমাজনকে রেইনফরেস্ট (The Amazon rainforest) বলা হলেও এর অর্থ কিন্তু এই না যে এখানে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয়। বরং রেইনফরেস্ট বলা হয় এখানকার অত্যধিক আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত (বর্ষা মৌসুমে) এবং গরম আবহাওয়ার কারনে। প্রচন্ড গরমের কারনে এখানে বাষ্পীভবনের হার অনেক বেশি যা আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার অন্যতম কারন।
এই গরম আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্রতার কারনে এ বনে উদ্ভিদ ও প্রানিকুলের বৈচিত্রময় সমাহার দেখা যায়। এখানে আছে ১২০ ফুট উঁচু গাছ, ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ২.৫ মিলিয়ন প্রজাতির কীট-পতঙ্গ, ১,২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রানি সহ হাজারো প্রজাতির অজানা জীব-অনুজীব। এখানকার প্রানিবৈচিত্র অতুলনীয়। মজার বিষয় হল হাজারো রকমের প্রানির সমাহার থাকলেও এখানকার ইকোসিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী যা মিলিয়ন বছর ধরে টিকে আছে।

স্তন্যপায়ীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জাগুয়ার, গোলাপি ডলফিন (একমাত্র প্রজাতির ডলফিন যা স্বাদু পানিতে বাস করে), তামানডুয়া (Tamandua), তাপির (Tapir), মানাতি (Manatee), ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, বাদুড় ইত্যাদি।


জাগুয়ার


গোলাপি ডলফিন


তামানডুয়া (Tamandua)


তাপির


মানাতি (Manatee)

পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ঈগল (harpy eagle), টুকান (Toucan), হোয়াটজিন (Hoatzin), দ্রুতগামী হামিং বার্ড (Humming Bird) এবং আরো রঙ-বেরঙের অনেক পাখি।



টুকান (Toucan)


হোয়াটজিন (Hoatzin)


হামিং বার্ড


সরীসৃপের মধ্যে আছে বিখ্যাত সাপ বোয়া যা তার শিকারকে পেঁচিয়ে ধরে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে। তাছাড়া রয়েছে কুমির, অ্যালিগেটর, কচ্ছপ প্রভৃতি।


বোয়া


অ্যানাকোন্ডা


অ্যালিগেটর


উভচর প্রানির মধ্যে লাল চোখ বিশিষ্ট গেছো ব্যাঙের নাম না বললেই নয়--


গেছো ব্যাঙ


মাছের মধ্যে আছে মাংসাশী লাল পিরানহা, বিপদজনক বৈদ্যুতিক মাছ (Electric Eel) এবং স্বাদু পানির অন্যতম বড় মাছ--পিরারুকু (Pirarucu); যার ওজন ১৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।


লাল পিরানহা


বৈদ্যুতিক মাছ (Electric Eel)


পিরারুকু (Pirarucu)


এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়া, হাতের তালুর সমান বড় তেলাপোকা, রঙ-বেরঙের প্রজাপতি, শুঁয়োপোকা আর জানা অজানা হরেক রকমের পোকা-মাকড়ের বসতি এই আমাজনে।


নীল প্রজাপতি


তবে এ বন শুধু জীবজন্তু আর উদ্ভিদের জন্যই স্বর্গরাজ্য নয় বরং এখানে অনেক মনুষ্য বসতিও আছে। হাজার বছর ধরে এখানে আদি ইনডিয়ানরা বসবাস করে আসছে। বর্তমানে এখানে বসবাসরত ইনডিয়ানের সংখ্য প্রায় ২ লাখ।

বিভিন্ন জীবের পাশাপশি কিছু ক্ষতিকর প্রানিও আছে আমাজনে। তাদের মধ্যে পিরানহা, রক্তচোষা বাদুর, বিষাক্ত ব্যাঙ, বৈদ্যুতিক মাছ, রেবিস, ম্যালেরিয়া, ইয়েলো ফিভার, ডেঙ্গু ফিভারের জীবানু উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া জাগুয়ার এবং অ্যানাকোন্ডা-ও অনেক সময় বিপদের কারন হতে পারে।

আমাজন বনের কিছু বিস্ময়কর তথ্যঃ
১। বিশ্বের নিরক্ষীয় বনের অর্ধেকের বেশি অঞ্চল এই আমাজনে

২। প্রানিকুলের সনাক্তকৃত এক দশমাংশ প্রাণী এই অঞ্চলে বাস করে।

৩। প্রথিবীর সকল পাখির এক পঞ্চমাংশ পাখি এই বনের অধিবাসী।

৪। গড়ে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৭৫,০০০ ধরনের বৃক্ষ পাওয়া যায়।

৫। বিশ্বের মোট ঔষধের ২৫% কাঁচামাল আসে এ বনের মাত্র ৪০০ প্রজাতির গাছ থেকে।

৬। পেরুর একটি মাত্র গাছে ৪৩ প্রজাতির পিঁপড়ার সন্ধান পাওয়া গেছে যা সমগ্র গ্রেট ব্রিটেনের চেয়ে বেশি।

আমাজন নদ
আমাজন বেসিনে অবস্থিত এ নদী হল আয়তনের দিক দিয়ে পৃথিবীর সবচে বড় নদী এবং নীল নদের পরে দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। এর প্রায় ১,১০০টি উপনদী আছে যার মধ্যে ১৭টির দৈর্ঘ্য ১০০০ মাইলের বেশি। এ নদী আমাজন অঞ্চলের প্রানবৈচিত্রের প্রধান উৎস এবং হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এ জঙ্গলের সুতিকাগার।








এ নদীর কয়েকটি বিস্ময়কর তথ্যঃ
১। এ নদীর আয়তন আমেরিকার সবচে বড় নদী মিসিসিপির আয়তনের ১১ গুন।

২। বর্ষা মৌসুমে এ নদীর মুখ (আটলান্টিকের সাথে যেখানে মিলিত হয়) প্রায় ৩০০ মাইল চওড়া থাকে।

৩। বর্ষা মৌসুমে এ নদীর মোহনা দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫,৭৮৭,০৩৭ ঘনফুট পানি আটলান্টিকে নিক্ষিপ্ত হয়।

৪। আমাজন নদী থেকে যে পরিমান পানি প্রতি দিনে আটলান্টিকে প্রবেশ করে তা দিয়ে পুরো নিউইয়র্ক শহরের ৯ বছরের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব।

৫। এ নদীর পানি প্রবাহের গতি এত বেশি যে আটলান্টিকে প্রবেশের পর তা লোনা পানির সাথে মেশার আগেই সমুদ্রের বুকে ১২৫ মাইল দুরত্ব অতিক্রম করে।

৬। প্রতিদিন ১০৬ মিলিয়ন ঘনফুট পলিমাটি আমাজনের পানির সাথে আটলান্টিকে গিয়ে পড়ছে।

৭। পৃথিবীর মোট স্বাদু পানির এক পঞ্চমাংশ স্বাদু পানি আসে আমাজন নদী থেকে।

শেষকথাঃ
আমাজন হল বিশাল এবং জটিল এক জায়গা যেখানে প্রকৃতি তৈরি করেছে অদ্বিতীয় এক ভৌগলিক ও জৈবিক সমন্বয় যা পৃথিবীর অন্য কোথাও অনুপস্থিত। আমাজনের রহস্য এবং ভয় আমাদের একই সাথে জয় করতে হবে এবং সাথে সাথে জিইয়ে রাখতে হবে। নতুবা বিশ্বায়নের এই যুগে আমাজনের রহস্য নিয়ে আমরা হয়ত আর বেশিদিন গর্ব করতে পারব না।




আগের পোষ্টঃ রহস্যময় উত্তর মেরু.......

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১০ সকাল ১১:১৬
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×