রাজাকার কাদের মোল্লার বিচারে শাহবাগ মুভমেন্টে'র ভূমিকা ছিল। এ কথা স্বীকার করতে হবেই। কিন্তু আমাদের তরফ থেকে নির্দৃষ্টভাবে ধন্যবাদটা পাবে কে? বা কারা?
ধন্যবাদ নিয়ে এই বিভ্রান্তি'র কারন, গণজাগরন মঞ্চ একটা বিক্ষিপ্ত এনটিটি। শাহবাগের রাজপথে শুরু থেকে ছিল ৪টি গ্রুপ,
এই পোস্টে সেটাই ব্যাখ্যা করছি, প্রথম অংশে দেখাবো কোন গ্রুপটা কেন এককভাবে ধন্যবাদ পাচ্ছে না, দ্বিতীয় অংশে বিশ্লেষন করে বের করবো যে, তারা কে কতটুকু ধন্যবাদ প্রাপ্য।
১- ব্লগ জগতে অন্যতম অখ্যাত মুখ ডাঃ ইমরান গ্রুপ, (ইমরান-রুদ্রপ্রতাপ-গোলাম মারুফ)
২- ছিল ব্লগার-অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ব্যানারে সকল বাম-নাস্তিক ব্লগার গ্রুপ, (পারভেজ আলম-ফারুক ওয়াসিফ-লাকি আক্তার)
৩- এরপর এসেছে ছাত্রলীগ ( সোহাগ-সিদ্দিকি নাজমুল) এবং
৪- মিডিয়া ব্যাক্তিত্বরা। ( জাফর ইকবাল- অঞ্জন রায়- নাসিরউদ্দিন বাচ্চু-আনিসুল হক)
প্রথমেই বলা দরকার যে, ব্লগার না হওয়া স্বত্ত্বেও ডাঃ ইমরান'কে ফোকাসে আনা হয়েছিল কারন প্রথম দিকে শাহবাগের ঐ ভীড়ে ওর চেয়ে ডিসেন্ট প্রোফাইলধারী কেউ ছিল না, সব বেকার-ছাত্র বা অল্পশিক্ষিত খুচরা পেশাজীবিদের মধ্যে ডাঃ পদবীধারী এবং চেহারাসুরত ভাল একজন ইমরানের সাক্ষাৎকারই উঠে এসেছিল। তার উপর ইমরান অনেক আগে থেকেই তার ছাত্রলীগ ও সরকার সমর্থক চিকিৎসক গোষ্ঠি স্বাচিপের পরিচয়ের দ্বারা সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো'র সাথে যোগাযোগ রাখতো। এবং এমন একটা জনসমাগম নিয়ন্ত্রনের জন্য সেই ছিল বেস্ট চয়েজ।
দলীয় পরিচয়ে বেশী পরিচিত অথবা প্রশ্নবোধক ব্যাক্তিত্বের কারনে প্রকৃত ব্লগাররা ফ্রন্টে যেতে পারে নাই। সেকারনেও ইমরানের মত অপরিচিত একজনকেই নেতৃত্ব দেয়া হয়।
সুতরাং গণজাগরণের জন্য ইমরান ধন্যবাদটা পাচ্ছে না কারন, সে মুখপাত্রই ছিল, এর বেশি কিছু নয়।
শাহবাগে ব্লগার-অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টরা ইমরানের চেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে শুরুতে, শাহবাগ কেন্দ্রিক ব্লগারদের যেই আনাগোণার চল এটা মূলত এই ব্লগার-অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টদেরই শুরু করা। বেশ কিছু ব্লগারেরই ছবির হাট কেন্দ্রিক আড্ডা ছিল। ইসলাম বিদ্বেষের কারনে অথবা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আবেগের কারনেই হোক, এরা ব্লগস্ফিয়ারেও রাজাকার বিচারের মেনিফেস্টো অনেক দিন যাবৎ চালিয়ে গেছে।
ব্লগার অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট সংগঠনের সদস্য নন, কিন্তু অনলাইনে রাজাকার বিচারের পক্ষে যারা যারাই লেখালিখি করেছে তাদের এই দলে ফেলার পরও বলতে হয়, এরা মূলত অনলাইনেই এ্যাক্টিভ ছিল কিন্তু গণজাগরন মঞ্চে'র শুরু'র ২-৩ দিনের মধ্যেই বামদলগুলোসহ এসব ব্লগারদের মঞ্চ থেকে উৎখাত করা হয়। পরে থাবা বাবা'র মৃত্যু'র পর তো এরা গণজাগরন মঞ্চের ভিলেন রুপে আবির্ভুত হয়।
তাই ধন্যবাদ এই ব্লগার এ্যাক্টিভিস্টরাও পাচ্ছে না, কারন গণজাগরন মঞ্চে'র সাফল্যের চেয়ে ব্যার্থতায় এদের দায় বেশি।
এখন দেখি ছাত্রলীগের অবস্থান। আমার মতে এই গণজাগরনের পেছনে মূল কান্ডারী হলো এই ছাত্রলীগ! হ্যা, আমি উপযুক্ত বিবেচনা করেই বলছি, বদি সোহাগ আর সিদ্দিকি নাজমুল যেভাবে সরকারের সাথে শাহবাগে সমবেত মানুষজনের একটা প্রোটোকল মেন্টেইন করেছে, এবং জনসমাবেশটিকে একটি আপাত নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বজায় রেখে, ব্যাপক মানুষের শো-ডাউন করে কন্টিনিউ করে নিয়ে গেছে সেটা আসলেই একটা ঘটনা।
ছাত্রলীগ সম্পূর্ণ কন্ট্রোল হাতে রেখে, নিজেদের মিডিয়া ও সাধারন মানুষের চোখের আড়ালে রেখে খুবই ম্যাচিউর্ড আচরন করেছে। আমার ধারনা, অনাকাঙ্খিত কিছু না হলে সোহাগ এবং নাজমুল ২জন আগামীতে জাতীয় রাজনীতিতেও অনেক দুর যাবে।
ধন্যবাদটা'র সুযোগ্য দাবীদার যদিও এরাই, কিন্তু ধন্যবাদ ছাত্রলীগকে দেয়া যাবে না কারন, মনে রাখতে হয় যে, শাহবাগের সমাবেশটা ছাত্রলীগের ডাকা সমাবেশ ছিল না। এমনকি সরকারের মনোভাব অন্যরকম থাকলে এই সোহাগ-নাজমুলরাই ইমরানদের পিটায়া শাহবাগ ছাড়া করতো।
বাকী থাকলো মিডিয়া, এরা মূলত লাভের গুড়খোর। কিন্তু শাহবাগ সমাবেশের শুরু থেকেই এদের শাহবাগে উপস্থিতিটাই প্রথম ৩ দিন ওখানে সাধারন মানুষদের যোগ দিতে উৎসাহিত করেছে। এরা না গেলে মিডিয়ার ক্যামেরাও শাহবাগ যেত না, আর সাধারন তরুন-তরুনীরা ক্যামেরাহীন শাহবাগে যেত না। তার বাইরে এই মিডিয়া ব্যাক্তিত্বরাই প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় শাহবাগের মেসেজটা রটিয়ে দিয়েছে। শাহবাগের সমাবেশ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিটা এদের কল্যাণেই পেয়েছে।
কিন্তু পুরো ধন্যবাদটা এরাও পাচ্ছে না, কারন এরা সেখানে সম্ভাবনা দেখেই গেছে, প্রচারনার সুযোগ তৈরী করে না দিলে এরা নিজেরা কখনোই যেত না!
তাহলে দেখা যাচ্ছে ধন্যবাদ কারো পকেটেই যাচ্ছে না!!!
কিন্তু ঘটনা একটা ঘটেছে এবং এর জন্য ধন্যবাদ কাউকে না কাউকে পেতেই হবে।
তাই আমার বিচারে শাহবাগের জন্য ১৮% ধন্যবাদ ডাঃ ইমরান গ্রুপ'কে। ১০% একেবারে প্রথম প্রহরে উপস্থিত হবার জন্য আর ৮% শিক্ষাগত ও সরকারের সাথে কানেকশন রাখার যোগ্যতার জন্য।
১৭% ধন্যবাদ ব্লগার এ্যাক্টিভিস্ট ও বাম দলগুলো'কে। ১০% একেবারে প্রথম প্রহরে শাহবাগ যাবার কারনে, ৫% ভিন্নধর্মী প্রতিবাদ ও আন্দোলনটাকে নিরপেক্ষ রাখতে ভূমিকার জন্য এবং ২% লাকি'র বিখ্যাত স্লোগানগুলোর জন্য।
৩০% ধন্যবাদ পাচ্ছে ছাত্রলীগ, ১৫% ধন্যবাদ জনসমাবেশটিকে আপাত নিরপেক্ষ রূপ দিতে সাহায্যের জন্য, কারন ছাত্রলীগ চাইলেই সমাবেশ দখল করতে পারতো। ১০% সমাবেশে মানুষ আগমন এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আর বাকী ৫% সরকারকে ম্যানেজ করার জন্য।
৩৫% ধন্যবাদ পাচ্ছে মিডিয়া। এর ভেতর ২০% ধন্যবাদ পাচ্ছে, ফেব্রুয়ারী মাসের সাংস্কৃতিক আমেজের ভেতর পুরো ঢাকাবাসীকে একটি অত্যন্ত ইমোশনাল বিপ্লবী হাইপ খাইয়ে দেয়ার জন্য এবং সমাবেশে সাধারন মানুষদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করার জন্য। ৮% ধন্যবাদ নিজেরা উপস্থিত থেকে বিক্ষোভ সমাবেশটিকে একটি অহিংস গ্ল্যামারাস উৎসবে রূপান্তর করে মানুষ আকৃষ্ট করার জন্য। ৭% পুরো সমাবেশটিকে সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর দায়িত্ব অর্পনের জন্য।
----------------
তো, রাজাকার বিচারের শুভক্ষনে শাহবাগ মুভমেন্টের ভূমিকা বিশ্লেষন করে দেয়া ধন্যবাদটার নিজ নিজ অংশটুকু বুঝে নিবেন।
বাংলাদেশ চিরজীবি হোক!