আমার প্রিয় ব্যাক্তিত্ব, আদর্শ, ভাবগুরু ছিলেন, হুমায়ুন আহমেদ। তাকে ধারন করার মত শব্দ আমার ভান্ডারে নেই। তবু শুধু এটুকুই বলতে চাই, উনার মৃত্যু'র সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় তার প্রতি মানুষের ভালবাসা দেখে আমার দুঃখ সব উধাও হয়ে গেছে।
এমন একটি জীবনাবসানে দুঃখ করার কিছুই নেই।
মানুষ তো নয়ই, এমনকি, সকল প্রাণীর মাঝেও সার্বজনীন কোন মিল না থাকলেও সকল প্রাণী'র একমাত্র মিল হচ্ছে সবাই মরনশীল!!!
সুতরাং, মৃত্যু নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোন লজিক নেই!!!
মৃত্যু'র চেয়ে বড় সত্য নাই!
হুমায়ুন আহমেদ এ কথাটি জানতেন, মৃত্যু নিয়ে তিনি ভাবতেন। তিনি মৃত্যু'র জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে দেশে এসে ঘুরে গিয়েছেন, মায়ের সাথে , প্রিয় মানুষগুলোর সাথে দেখা করে গেছেন, প্রিয় বাংলাদেশকে দেখে গেছেন, তার কথা বার্তা এমন লেখাগুলো দেখে সহজেই বুঝা যায় এই মানুষটি মৃত্যু'র ব্যাপারে সচেতন ছিলেন!
এটি আল্লাহ'র অনেক বড় রহমত!
পরিবারের বড় ছেলে ছিলেন তিনি, পড়াশোনা করে সর্বোচ্চ ভাল ফলাফল করে তিনি সংসারের হাল ধরে পারিবারিক দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে পালন করেছিলেন।
আমেরিকায় পিএইচডি করে সেই ৭০'র দশকে শুধুমাত্র দেশপ্রেম থেকেই বাংলাদেশে ফিরে এসে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রসায়ন বিজ্ঞানে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন, ছিলেন জনপ্রিয় অধ্যাপক।
প্রফেসর রাজ্জাক, আহমেদ ছফাদের প্রিয়পাত্র ছিলেন প্রথাবিরোধী, দেশপ্রেমিক, প্রকৃতিপ্রেমিক, বাংলাদেশ প্রেমিক হুমায়ুন আহমেদ। দুই বাংলায় তার জনপ্রিয়তা ছিল অভূতপূর্ব!
টিভি-সিনেমা-নাটক-গান-সাহিত্য-বিজ্ঞান, সবকটি সেক্টরে বাংলাদেশের শীর্ষপর্যায়ে উঠেছিলেন আমাদের হুমায়ুন আহমেদ!
অসংখ্যা যুবক'কে পরিনত করেছিলেন হিমু'তে, বাকের ভাইয়ের জন্য রাস্তায় মানুষ নামিয়েছিলেন, একজন লেখকের জন্য এটি অভুতপূর্ব এক সাফল্য। আমাদের হুমায়ুন আহমেদই পেয়েছিলেন সেই সাফল্য! এর বাইরেও, মিসির আলী, শুভ্র, বড় চাচা, ফুপা, মাজেদা খালা, রুপা, নিতু'র মত চরিত্রগুলো কোটি কোটি মানুষের কাছে প্রিয় করে তুলেছিলেন! আর কোন লেখক'টা আছে যার বইয়ের চরিত্রগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পরিচিত???
অপটিমিস্ট, সরল, কোমল, উদাসী, যুক্তিবাদী, মেধাবী ও সৎ মানুষটি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের দেশের একটি প্রজন্মের মানসিকতা গঠন করে গেছেন।
৮০'র দশকের প্রজন্মগুলো'র জীবনে জোৎস্না বিলাস, সমুদ্র বিলাস, বৃষ্টি বিলাস, কদম ফুল, বর্ষা'র প্রথম বৃষ্টি, বৃক্ষপ্রেম উস্কে দিয়েছিলেন অধ্যাপক ডঃ হুমায়ুন আহমেদই!
তর্কাতীতভাবেই হুমায়ুন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় সেলিব্রেটি ছিলেন, তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য্য পরশ পাথর!
এমন বর্ণাঢ্য জীবন তিনি যাপন করে গেছেন, নিজ গুনেই তিনি অমরত্ব লাভ করেছিলেন।
সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী হুমায়ুন আহমেদ বহু লেখায় মৃত্যু সম্পর্কে লিখে গেছেন, সত্যি বলতে, মৃত্যু'কে সহজভাবে নিতে আমাকে তিনিই শিখিয়ে গেছেন।
আমার মত অসংখ্য বাংলাদেশী'র অভিবাবক তিনিই ছিলেন, শৈশব-কৈশর-তারুন্যে তার হাত ধরেই বেড়ে উঠেছি, আমার মানসিকতা প্রচন্ডভাবে তার দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ ও দেশপ্রেম এর ব্যাপারে আমার আদর্শ মানুষ!
আজ রাতে এবং আগামী কাল, বাংলাদেশের না হলেও অন্তত ৫ কোটি মানুষ তার জন্য প্রকাশ্যে বা মনে মনে কাঁদবে। একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে সুন্দর সমাপ্তি আর কি হতে পারে?
আমার একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন তিনি, প্রিয় মানুষের জন্য এত মানুষের ভালবাসা দেখে আমার অনেক গর্ব হচ্ছে!
হুমায়ুন আহমেদ এমনই একটি জীবন যাপন করে গেছেন, যার সামনে মৃত্যুও মলিন হয়ে গেছে!!!
এমন অবস্থায়, এই দুনিয়া থেকে এভাবে তার প্রস্থানে আমার কেন দুঃখ হবে? তার চেতনা ধারন করেই তাকে আমার সাথে রেখে দেব, যেমনটা ছিলেন এতদিন, আমি শপথ নিচ্ছি আমার মাঝেই তাকে বাঁচিয়ে রাখবো। আমাদের মাঝেই তাকে ধরে রাখবো। যতদিন পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকবো, হুমায়ুন আহমেদও আমার সাথেই, আমার মনে, আমার চেতনায়, আমার লেখায় থাকবেন!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১২ ভোর ৪:০৯