somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সহজ ইতিহাস : আর্মেনিয়ান গণহত্যা*** !!!

০৮ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১০:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অটোমান সাম্রাজ্যের ৬০০ বছরের শাষনের সমাপ্তি নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। আজকে এর শেষ সময়ের একটি বিতর্কিত অধ্যায় নিয়ে কিছু লেখার আশা করি। যা পরিচিত "আর্মেনিয়ান গণহত্যা" নামে।

বিষয়টা ভয়াবহ বিতর্কিত। ২ পক্ষের দাবী একে অপরের চেয়ে অনেক বেশী ভিন্ন। এবং এর পাঠকদেরও নিরপেক্ষ থাকতে দেয় না। তাই বিষয়টির কোন সরাসরি বিচার না করারই চেষ্টা করবো, তবে বিচারের ভার পাঠকের হাতেই।




অটোমান সাম্রাজ্যের শেষের দিকে মুসলমান সমাজের সাথে অন্যান্য ধর্মালম্বী সমাজের পার্থক্য ব্যাপক আকার ধারন করে। অর্থনৈতিক শক্তিতে বিধর্মীরা অগ্রনী ছিল, কিন্তু প্রশাসনে ও রাজনীতিতে তাদের স্থান ছিল না। ইউরোপের নব্য ক্ষমতাশালী খ্রিস্টান দেশসমুহ এবং রাশিয়ার কাছ থেকে নিয়মিত শিক্ষা ও সাহায্যে পুষ্ট অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মতই আর্মেনিয়রা তাদের সামাজিক অধিকারের দাবীতে বেশ প্রেশার ক্রিয়েট করে সুলতানের উপর।

সুলতান বেশ কয়েকবার সামাজিক বৈষম্য ঘুচানোর চেষ্টা করলেও ( তাঞ্জিমাত, ইসলাহাত) তা চুড়ান্ত সফলতার মুখ দেখে না।

১৮৯৬ সালে পূর্ব আনাতোলিয়ার ( বর্তমান তুরস্ক) আর্মেনিয় বাসিন্দাদের বিদ্রোহ কঠোর ভাবে দমন করে সুলতান আব্দুল হামিত।





১৯১৩ সালে আর্মেনিয়রা তাদের পূর্ব আনাতোলিয়ায় তাদের জনসংখ্যার নিরাপত্তার জন্য বিদেশী "জেন্ডার্ম" দাবি করে। ( মানে, পুলিশি ভুমিকায় সামরিক বাহিনী)! এবং তৎকালীন "তরুন তুর্কী" সরকার ( নির্বাচিত রাজনৈতিক দল, সিইউপি এর নীতিনির্ধারকদের তরুন তুর্কী বলে অভিহিত করা হয়) ব্রিটেনের সাথে এই বাহিনী গঠনের জন্য আলাপ করে এবং ব্রিটেন ফ্রান্স ও রাশিয়ায় সাথে আলাপ করে। এবং ১৯১৪ সালে একজন নরওয়েজিয়ান এবং একজন ডাচ ইন্সপেক্টর নিয়োগ দেয়া হয়।

কিন্তু অটোমান-জার্মান চুক্তি অনুযায়ী , রাশিয়া যুদ্ধে যোগদানের পর পর অটোমান প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যায়!

ঘটনার শুরু এরপরই।






রাশিয়ার সামরিক শক্তি এবং যুদ্ধে রাশিয়ার সম্ভাব্য বিজয় ধরে নিয়ে ( যা বিরাট ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছিল) এবং তুর্কীদের সাথে পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরন করে অনেক আর্মেনিয়ান সরাসরি রাশিয়ান আর্মিতে যোগদান করে, অনেকে আবার গেরিলা হয়ে যায়!

পূর্ব আনাতোলিয়ায় ( বর্তমান তুরস্কের পূর্বাংশ) অটোমানের সাথে রাশিয়ার সম্মুখ যুদ্ধে অটোমান পরাজিত হয়, এবং পরাজয়ের প্রধান কারন হিসেবে ব্যাপক সংখ্যক আর্মেনিয়'র রাশিয়ার পক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করা কে চিন্হিত করা হয়!

এই ঘটনা ইস্তানবুলের নেতাদের ব্যাপক ক্রুদ্ধ করে।
এবং বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়া যুদ্ধে থেকে বিদায় নেয়।

তখন লোকাল কুর্দি জনগণের সাথে আর্মেনিয়দের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এবং অটোমান শাষকগোষ্ঠি পুরো আর্মেনিয়ান জনসংখ্যাকে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে আগামীতে রাশিয়ানদের হয়ে অটোমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে না পারে।

১৯১৫-১৬ সালের দিকে আর্মেনিয়দের পুরো জনগোষ্ঠিটাকেই সিরিয়ার মরুভুমি'র মাঝখানের যুদ্ধক্ষেত্রে স্থানান্তরিত করা হয়।

এই স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় জবরদস্তিমুলক মরুভুমির পথযাত্রায় , ক্ষুধা-তৃষ্ণায় এবং তৎসংলগ্ন এলাকার লোকাল জনসংখ্যার, মুলত কুর্দিদের আক্রমনে ব্যাপক সংখ্যক নিরস্ত্র অভিবাসী আর্মেনিয় মারা যায়।

এ নিয়ে আজো বিতর্ক চলছে, প্রকৃত মৃতের সংখ্যা বের করা যায় নাই আজো। এবং একে এখন পর্যন্ত মাত্র ২০টি দেশ গণহত্যার স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং তুরস্ক এর প্রতিবাদ করে।

তবে বিতর্ক মুলত ৩ টা ক্ষেত্রে হয়,

১ম : এই স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে, তুর্কী সমর্থকদের দাবী, যুদ্ধাবস্তায় তাদের এমন বিশ্বাসঘাতকতার পর ওদের বিশ্বাস করার কোন উপায় ছিল না। বিশ্বস্ত আর্মেনিয় এবং রাশিয়ান সমর্থক আর্মেনিয় আলাদা করে চেনার কোন উপায় ছিল না বলেই তাদের স্থানান্তর করা ছাড়া কোন পথ ছিল না।

কিন্তু অপরপক্ষ বলে, এই স্থানান্তর শুধু রাশিয়ানদের সাথে হয়ে যাওয়া যুদ্ধের এলাকাতেই সীমিত ছিল না বরং ইস্তানবুল ও অন্য অঞ্চলের আর্মেনিয়দেরকেও স্থানান্তর করা হয়েছে।

২য় বিতর্ক মৃতের সংখ্যা: তুর্কীর ঐতিহাসিকগন দাবী করে স্থানান্তরের ফলে মৃতের সংখ্যা ২ লক্ষ , অপর দিকে আর্মেনিয়রা এর দশগুন পর্যন্ত বেশী দাবী করছে। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে ধারনা করা হয় ৬ থেকে ৮ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল।

৩য় বিতর্ক হচ্ছে জটিল, গণহত্যা আসলেই হয়েছিল কি না?

তুর্কী পক্ষের দাবী হচ্ছে পূর্ব আনাতোলিয়ায় তখন যুদ্ধাবস্থা এবং রাশিয়ানদের সমর্থক আর্মেনিয়দের সাথে তুর্কী সমর্থক কুর্দিদের এলাকা দখলের লড়াই হয়েছে , যাতে অটোমান সরকারের দায় খুবই কম। কেননা, অটোমান সরকার কোন অবস্থাতেই আর্মেনিয়দের গণহত্যা করার পলিসি গ্রহন করে নাই।

এবং সিরিয়ায় সেখানকার কুর্দিদের হাতে আর্মেনিয়দের হত্যার ঘটনায় নিরাপত্তা বিধানে অটোমানদের ব্যার্থতা প্রকাশ করে কিন্তু গণহত্যা সংগঠনের দায় তাদের নয়।

মোট কথা ,বর্তমান তুরস্কের দাবী যে, কোন ধরনেরই নথি-পত্র প্রমান করে না যে অটোমান সরকার আর্মেনিয়দের হত্যার পরিকল্পনা করেছিল।

কিন্তু অপরপক্ষের দাবী, "আনাদোনিয়ান পেপার্স" নামে বেশ কিছু নথি রয়েছে যা প্রমান করে অটোমান গণহত্যা পলিসি গ্রহন করেছিল। যা মুলত কনস্যুলার জেনারেলের সংস্লিষ্ট দেশে পাঠানো বার্তা । ব্রিটিশ ও আমেরিকান প্রকাশনা থেকে পাওয়া এসব নথি কে যুদ্ধাকালীন প্রোপাগান্ডা বলে তুর্কী উড়িয়ে দিলেও , তাদের মিত্র জার্মানীর তৎকালীন বেশ কিছু নথি , যা আর্মেনিয়ানদের উপর অত্যাচারের কথা বলে সেসব উড়িয়ে দিতে পারে নাই।


তবে নিরপেক্ষ বিচারে এটুকু বলা যায় যে, সরাসরি অটোমান সরকারকে এই হত্যার সাথে জড়িত করতে না পারলেও ধারনা করা হয়, তরুন তুর্কী দলের একটি "ইনার সার্কেল" এই পলিসি গ্রহন করে।

এবং এমন ব্যাবস্থা গ্রহন করে যা লাখো আর্মেনিয়কে মৃত্যের মুকে ঠেলে দেয়।







এটাই হচ্ছে ব্যাপক আলোচিত আর্মেনিয়া ইস্যু'র একটি সারসংক্ষেপ। আধুনিক ইতিহাসের প্রথম গণহত্যা বলে দাবী করা হয় এটিকে। আর্মেনিয়দের জন্য ব্যাপক বেদনার একটি অধ্যায় এবং বর্তমান তুরস্কের জন্য একটি বিব্রতকর অধ্যায়।

বিষয়টি ব্যাপক বিতর্কের বিষয় এবং খুবই সেনসেটিভ, তাই অনেক কিছু খেয়াল করে লিখতে হয়েছে।

আর্মেনিয় এবং তুর্কীরা এই ইস্যুতে ব্যাপক সিরিয়াস। বহু বছর ধরে গুপ্তহত্যা এবং হত্যা সংগঠিত হয়েছে এ নিয়ে।

এমন বিষয়ে নিরপেক্ষ হয়ে লেখাটা খুবই ঝামেলার, তবে, আশা করি নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছি।




ইতিহাসের এই ঘটনাটি সহজ করে জানাতে পারলেই আমি ধন্য। কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১১:৩৪
২১টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×