একদা আমার মা-বাবা এবং নানা আমাকে নিয়ে সপ্ন দেখেছিলেন আমাকে উনারা মোল্লা বানাবেন।এবং যেনতেন মোল্লাও নয় একেবারে কোরয়ানে হাফেজ মোল্লা। তো এত কিছু থাকতে আমার মা-বাবা এবং নানা কেন আমাকে এই মোল্লা বানানোর সপ্ন দেখলেন?! কারন বা উনাদেরতো অবশ্যই একটা প্রেরনার জায়গাও ছিল,সেটি কি রকম?কোন ভাবে তারা জেনেছিলেন একজন কোরয়ানে হাফেজ বিনা হিসাবে ১০জন মানুষ কে বেহেস্তে নিতে পারবে এবং একজন সন্তান কে কোরয়ানে হাফেজ বানানো বাবা-মা জন্য ধর্মীও দিক থেকেও সম্মানের। তাই তারা আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে একটা সৎ ও মহৎ কাজের সূচনা হিসাবে দেখা শুরু করলেন এবং বেহেস্তে যাওয়ার একটা ভিসারও বন্ধোবস্তের ব্যাবস্থা হয়ে যাচ্ছে এই ভাবনার আনন্দে দিন যাপন করা শুরু করলেন।
আর এইদিকে আমার অবস্থা উনাদের থেকে একদম ভিন্ন একটি বিন্দুতে। আমাকে একটা কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় নূরানি বিভাগে।নূরানি বিভাগটাতে আরবি অক্ষর চেনানো থেকে শুরু করে অর্থ না বুঝে আরবি গড়গড় করে পড়ে যাওয়া ও সাধারন যে ধর্মীও রীতিনীতি সম্পর্কে জানানোর তিন বছর এর একটি কোর্স ।এক বছর পড়ার পর মাদ্রসার পড়াশুনার উপর বিরক্ত হওয়া শুরু করলাম।বিরক্ত হবার কারন আমার কাছে আজও নিশ্চিত কিছু নেই। কিন্তু মাদ্রাসার হুজুরদের কঠিন নিয়মের জগৎ আমার ভালো লাগেনি। নিয়ম গুলো ছিল সারাক্ষণ এইটা করা যাবেনা, ওইটা করা যাবেনা, চারদিকে শুধু গুনাহ আর গুনাহ। কিছু করতে গেলেই গুনাহ’র দেয়াল দাঁড়িয়ে যায় । আমাদেরকে সারা দিন নিজেদের মতো করে কাটানোর একতা মুহূর্তও দেওয়া হতোনা।সব কাজে বাধা।ক্রিকেট ফুটবল খেলা সরাসরি না করা হতোনা, কিন্তু বলা হতো এইগুলো ইহুদিদের খেলা।হইহুল্লড় করা যাবেনা,পারলে সকল খেলাধুলা থেকে আমাদের নিবৃত করতে পারলে হুজুরা খুশি হন।এমনিতে যদিও আমরা খেলাদুলার জন্য খুব কমই সময় পেতাম। এবং পড়া না পারলে এবং বিভিন্ন নিয়ম ভঙ্গের জন্য কঠিন শাস্তি এবং অমানবিক শাস্তি।
হুজুররা ছিলেন প্রাগৈতিহাসিক যুগে বসবাস করা কিছু মানুষ যারা মনে করতেন শারীরিক শাস্তি ছাড়া একজন মানুষ কিছু শিখতে পারেনা,তাই আমদের বিভিন্ন শারীরিক শাস্তি দেওয়া হতো।এর কিছু নমুনা দিচ্ছি, শাস্তির এই নমুনা গুলো অবিশ্বাস্য শুনালেও এইগুল আমার অভিজ্ঞতায় সত্যিকার শাস্তির নমুনাঃ
১।৩০-৬০মিনিট পর্যন্ত কুমড়াচেঙ্গি বা বসে পায়ের নিচে দিয়ে হাত দিয়ে কান ধরে রাখা। যা ৫ মিনিত থাকাও চরম কষ্টের,অথচ ৩০-৬০ যখন এই শাস্তি দেওয়া হতো আমার মনে পড়ে তখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়তাম কেউ কাউ। তাতে কি যায় আসে!! হুজুর খুব আনন্দ পেতেন আমাদেরকে এই ভাবে শাস্তি দিয়ে।
২।বেত দিয়ে ইচ্ছে মতো পিটানোতো কোন ঘটনাই নয়।এটি ছিল নিয়মিত রুটিন এর অংশ। তাছাড়া আমরা জুব্বা ধরনের পাঞ্জাবি পরতাম,এটি পরা অবস্তায় মাথার উপর উঠিয়ে মার দেওয়া সম্ভবত হুজুর এর জন্য চরম পছন্দের একটা ব্যাপার ছিল।
৩। হাত বেঁধে গায়ে পিঁপড়ার বাসা ভেঙ্গে দিয়ে হুজুর মজা দেখতেন।এই শাস্তি আমি সরাসরি না খেয়ে থাকলেও এটি দেখে আমার ওই বয়সটাতে যে পরিমান ভয় পেয়েছিলাম তা আজও আর হয়ত আমার পক্ষে ভুলা সম্ভব নয়।
৪।১০০থেকে শুরু করে ইচ্ছে মতো কান ধরে উঠবস করানো।
৫।কলম আঙ্গুলের এর মাঝে রেখে জোরে চাপ দেওয়া।
৬।মাথার চুল কেটে দেওয়া।
৭। সূর্যের দিকে মুখ করে দাড় করিয়ে রাখা হুজুরদের ইচ্ছে মতো সময়।
এই রকম আরও অনেক অনেক ধরনের শাস্তি ছিল আমাদের জন্য। তো আমার যখন মাদ্রাসার ওই জীবনটা খারাপ লাগা শুরু হলো আমি তখন মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে এদিক সেদিক গুরাগুরি শুরু করলাম। মাঝেমাঝে বাসায়ও চলে যেতাম(মাদ্রাসাটি ছিল আবাসিক) ।প্রথম প্রথম বাসায় তেমন কিছু না বললেও বাবা-মা যখন দেখলেন উনাদের বেহেস্তের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাওয়ার অবস্থা। তখন উনারাও আমার উপর ঈমানি দায়িত্ব নিয়ে মার দেওয়া শুরু করলেন।
মাদ্রাসায় হুজুরদের মার বাসায় বাবা-মার ঈমানি মার আমকে অস্থির করে ফেলে।তারপর নানা ফতোয়া দিয়ে আমার উপর দেওয়া মার কে ঈমানি দিক থেকে জায়েজ করা শুরু হয়।সেটি কি রকম; মার দেওয়ার পর আমাকে বলা হচ্ছে আমার উপর শয়তানের আচর পড়েছে ,এখন মাইরা এই শয়তান তাড়ান লাগবে।আর হুজুররা ইতোমধ্যে হাদিস পড়িয়ে পেলেছেন যে অস্তাদ এর মার শরীরের যে অঙ্গে লাগবে তা বেহেস্তে যাবে।এইটা বলে হুজুররা মার দিয়ে আমকে বেহেস্তে পাঠান মোটামুটি প্রায় নিচ্ছিত করে পেলেছিলেন।
দ্বিমুখী মার খেয়েও যখন আমি আর লাইনে আসতে পারছিলামনা তখন আমার বাবজানের মাথায় শুভ বুদ্ধির উদয় হইল । আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। যে জীবন মাদ্রাসা জীবন থেকে সুখের মনে হওয়াতে আমি মোটামুটি পড়াশুনা চালিয়ে গেলাম এখনও যাচ্ছি।
আমার বাবা-মা এর আমাকে মোল্লা বানানোর সপ্ন, আমার জন্য আমার শিশুকালকে বীভৎস করে দিয়েছে।এই বীভৎসতার কিছু স্মৃতি আজও আমার মন থেকে মুছে পেলতে পারিনি।আমি চাইনা কারো শিশুকাল আমার মতো নষ্ট সময় এর স্মৃতি হয়ে থাকুক। আমি কিছুই শিখতে পারিনি মাদ্রাসার ওই সময় গুলো থেকে। ওই সময়টা আমার জীবনের একটা নষ্ট অধ্যায়। (এটি একান্তই আমার নিজস্ব অনুভুতির জায়গা থেকে লেখা,কাউকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়) ।