দ্বিজেন্দ্রনাথ স্যার সিরিয়াস মুডেই থাকেন। কালে ভদ্রে উনার মুখে হাসির একটা অনুজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়। কাল ফিজিক্সের ক্লাসে উনার সাথে আমাদের লঙ্কাকান্ড হয়ে গেল, অথচ স্যারের মুখে ভালই হাসিখুশি ভাব ছিল!
আমি রঞ্জন এর পাশে প্রথম বেঞ্চে বসে একটা পাপ করে ফেলেছিলাম। স্যার বেশ ফুটফুটে মেজাজ নিয়ে সবাইকে বলেছিলেন, পড়া শিখে আস কিংবা না আস, ব্যাপারটা গুরুত্বপুর্ণ না। বুঝলে, আজ আরো গুরুত্বপুর্ণ কিছু ব্যাপার নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই। কি রাজি তো?
আমাদের মধ্যে কেউই আপত্তি করলো না। মৌনং সম্মতিলক্ষণম হিসেব করলে আমরা সবাই রাজি। কিন্তু দু একজন ছাড়া আর কেউই আসলে ব্যাপারটা বুঝতে কিংবা সেটা নিয়ে ঘাটাতে সাহস পায় না। ক্লাসের ১ নম্বর ছাত্রী হিসেবে শায়লা খুব চটপটে! ওর আবার স্যারের এইসকল প্রাকটিক্যাল ব্যাপার স্যাপারে মন বেশিই ঝুঁকে।
ওর মধ্যে একটা বিপদজনক শক্তি আছে। বেচারি অকপট চেয়ে থাকতে পারে যে কারোর দিকে। এমনভাবে দেখবে যে, অন্য বেচারি কিংবা বেচারা সম্মোহিত হয়ে পড়বার সম্ভাবনা আছে। প্রায় গোলাকার দুটো স্বচ্ছ চশমা দিয়ে সে তখন স্যারের দিকেই দৃষ্টিটা দিল। এটও ঠিক, হ্যারি পটারের সাথে তার চেহারার ভাল মিল আছে বৈকি!
সে যাক, শায়লাকে তিনি দাঁড়াতে বললেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, বলতো, তোমার এইম ইন লাইফ কি?
মনে হয় এমন আচমকা প্রশ্ন তাকে বহুদিন কেউ করেনি। হাজার হোক শায়লা একজন মেয়ে! সে চোখের পলক কয়েকবার ফেলে সংকোচ দুর করার ব্যর্থ চেষ্টায় সে উত্তর দিল- ডাক্তার। কিন্তু মুখটা কাঁচুমাচু করতেই হলো তাকে।
স্যারের মুখে এবার সত্যি সত্যি একগাল হাসি দেখা গেল। আচ্ছা! ডাক্তার হবার কারণ কী?
- ইয়ে মানে, স্যার, আ- আমি দেশের সেবা করব, গরিব মানুষের...
- ব্যস ব্যস! আর বলতে হবে না। (এবার আমার দিকে এক নজর তাকিয়ে বললেন) এই জিশান, তোরটা বলতো?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, সায়েন্টিস্ট!
- ওয়াও! কি ভাল ব্যাপার!! তা কোন বিষয়ে?
- রসায়ন স্যার!
- গুড! তা রসায়নিক হবে কেন?
- ইয়ে, স্যার রসায়ন পড়ে দেশের জন্য কিছু আবিস্কার করব। দেশের মুখ উজ্জ..
এবারে স্যারের মেজাজ সিরিয়াস মুডে চলে গেল! ব্যাপারখানা বুঝবার মতো আক্কেল এই ক্লাস নাইনের ছাত্রছাত্রীদের কারোরই নেই! তো এরপর পেছনের সিট থেকে আরেকটা ছেলেকে তুলে জিজ্ঞেস করতে সে বললো পাইলট হবে!
- তা পাইলট হতে হইলে তো ম্যাথ ভাল থাকতে হবে। তোর তো সেটা একদম নাই! কি করবি?
- ইয়ে স্যার, মন দিয়ে পড়াশোনা করব।
- হুম। ধরলাম পাইলট হয়েই গেলি? এরপর?
- এরপর দেশের...
- স্টপ! স্টপ!! বুঝেছি!!!
মেজাজটা খারাপের দিকেই চলে গেছে স্যারের। এখন আর কাউকে জিজ্ঞেস করলে যদি দেশের কথা বলে তাহলে নির্ঘাত একটা কিছু উল্টাপাল্টা ঘটবেই! সেটা আমি নিশ্চিত!
ধীরে ধীরে মাথা অনেকটা নুয়ে, হাঁটতে হাঁটতে সোহেলির দিকে তিনি এগিয়ে গেলেন। এরপর কিছুটা কড়া করে জিজ্ঞেস করলেন-
- তোর?
- ইয়ে স্যার, আমার তো তেমন কিছু উদ্দেশ্য নাই।
- বেশ।
এরপর মাঝের দিক থেকে কলিকে জিজ্ঞেস করলেন- তোরটা বলতো?
- স্যার পুলিশ হব।
- ঘুষ খাবি?
- না স্যার।
- বেশ। তাহলে বল, পুলিশ হওয়ার ইচ্ছে কেন হইলো তোর?
- স্যার, দেশের অন্যায় অবিচার সব বন্ধ করার জন্য আমি..।
এইসময় স্যার আর স্থির থাকতে পারলেন না। রেজিস্টার খাতা ছুঁড়ে মারলেন ওর দিকে! ঠিক যেটা আমি অনুমান করেছিলাম। স্যার না হয়ে অন্য কেউ হলে হয়তো বলতো- তোরা বালের জন্য এইসব করছিস। কি দেশ? কোথাকার দেশ? পাঠ্যবইয়ে পড়ে পড়ে ঐসব আওড়াচ্ছিস। না?
শোন, দেশপ্রেম হলো একটা ভ্রান্তি! মানুষ ঠকানোর ছল। যদি দেশপ্রেম বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকতো, তাইলে ঐ যে মুনিম খান, উপজেলা চেয়ারম্যান সে সেইটা বেশি চর্চা করতো, ঐ যে এহসান শহিদ, এমপি। সে সেইটা বেশি জানতো! তোগোর হেডমাস্টারে করে দেখাইতো! তোরা দেইখ্যা দেইখ্যা শিখতি।
ঐ বালের এম-পি নিজেই বর্ডার থাইক্কা টনের পর টন বিদেশি মদ-হেরোইনের ব্যবসা করে কোটিপতি হইতেছে থানা পুলিশরে ক্ষেমতা দিয়া আটকাইয়া। ঐ ওসি কি করে জানিস? ঘুষ খাইয়া গরিব মাইনশের মামলা না নিয়া জুলুমগারগো পক্ষে কলম লিখে। ঐ শালারপুত সাংবাদিক সেইটারে সাপোর্ট কইরা পত্রিকা ভইরা দেয়। এইসব দেইক্ষা তোগোর বড় ভাইরা বিদেশে গিয়া পরিবার লইয়া আরামে আছে। তারা ঐসব দেশের আইন মানে। সেইসব দেশের উন্নত থাইক্কা আরো উন্নত করতে কাম কাজ করে। আর আমরা এইখানে ভেজাল খাইয়া, ক্যান্সার লইয়া, অসুখ লইয়া এইখানে পইচ্চা আছি।
ক্যান পইচ্চা আছি জানিস?
স্যারের এমন ক্ষেপে যাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই ভাল কারণ আছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে ভাবার সুযোগ তিনি দিচ্ছেন না। তাঁর মুখ থেকে অজস্র কথার তীর আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে!
- এই আমি ক্যান পইচ্চা আছি জানিস? আমার সামর্থ্য নাই। আমি ছোট থাকতে, আমি ছোট থাকতে এইরকম বলছিলাম! আমি কি প্রাইভেট পড়াই না? সরকারে টেকায় চলে না বলেই তো পড়াই! ঠিক না?
- আসলে আমরা বেশিরভাগই হইলাম হিপোক্রেট। ভন্ড! ভন্ড! ভন্ড!
- জানিস? আমরা নিজেরাই নিজের সাথে ভন্ডামি করি! যাক, করতেছি যখন, করেই যাই আমরা। অন্তত তোগোর যাতে এই ভন্ডামি করতে না অয় সেজন্য আমি কইতাসি!
"স্বার্থপর হও, বাকিদের জন্য ভাবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিও না। তোমার স্কিল, তোমার দক্ষতা এত বেশি দরকার নাই যাতে বস সুনাম করে। ন্যায়, নীতির পক্ষে কখনোই এগিয়ে আসার দরকার নাই। উন্নত মানসিকতার নামে ফালতু টপিক মাথা থাইক্কা ঝাইড়া ফালাও! দেখবা তোমার জীবন সুন্দর! কলাগাছের মতো তড় তড়, তড় তড় কইরা বাইড়া উঠতাছে।"
আমাদের প্রয়াত স্যারের বক্তব্যটা মোটামুটি এইরকমই ছিল। আমার তখন মনে হচ্ছিল একটাই দৃশ্য! হিটলার তার জেনারেলদের সামনে যেভাবে শাসানি দিচ্ছে সেই দৃশ্যটা ঠিক এই ক্লাসরুমের মতই নয় তো?
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:০৯