আয়না বসাইয়া দে মোর কলবের ভিতর!
এই জনপদের বহুল প্রচারিত একটা গান "দয়াল বাবা"। আয়না ব্যাপারটা নিয়ে তখন থেকেই আমার একটা আকর্ষণ ছিল। এই যুগে এসে আয়নার ব্যাপকতা কমে সেটা 'গ্লাস' হয়ে গেলেও জিনিসটার ব্যবহার কমেনি। বহুক্ষেত্রে সেটা ছড়িয়েছে আর ব্যবহারের ক্ষেত্রও প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু হলিউডের সায়েন্স ফিকশন মুভি "ইনসেপশন" এর আদলে যে চেনা শহরের পথঘাট, বন্দর ব্যবহার করেই এত অসাধারণ থ্রিলিং সিনেমা কেউ করে ফেলতে পারবে সেটা মাথায় আসেনি।
☉ আয়না!
আয়না! একজন (পুরুষ) মানুষের নাম। আচ্ছা! এটা আবার নাম হয় নাকি? সারাফাত করিম আয়না! মিস্ট্রিয়াস একটা মানুষ! দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ চোখ দিয়ে রহস্য কি খুঁজে পাওয়া যায়? মোটেও না। হলে বসে সিনেমাটা দেখার সময় এবং পরবর্তীতে আমার ভাবনা জগতে একটা ব্যাপার ঘুরেফিরে মাথায় আসতে থাকল। উমম, আমার আশেপাশে এমন কেউ নেইতো? যে হুট করে হাওয়া হয়ে যায়? আবার স্বাভাবিক মানুষ হয়ে ফিরে আসে? কিংবা এই টাইপ অন্য কোন ব্যাপার??
আয়না নামের সাথে দুরত্বটা ঘুঁচে যাবে আপনার কাছেও। আমারও খটকাটা কেটে গিয়েছিল অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। চঞ্চল চৌধুরীর মাঝে হয়তো আপনি নিজেকে সঁপে দিবেন অল্প সময়ের মধ্যেই! একজন আয়নাকে একাধিক রুপে আপনি পাবেন। প্রকৃতি প্রদত্ত একটি ক্ষমতা আছে আয়নার কাছে। আর সেটা হলো হিপনোটাইজ করতে পারাটা! একেবারে ৪র্থ শ্রেণির মানুষ থেকে শুরু করে হাই সোসাইটির পাবলিক/ইয়ো ইয়ো জেনারেশনের পাবলিককে সে হিপনোটাইজ করতে পারে।
☉ আয়নাবাজিঃ
আয়নাবাজি ব্যাপারটা প্রথম দিকেই বুঝে নিয়েছিলাম। এটাকে অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা বলা যায়। কিন্তু এই যোগ্যতা নায়ক ব্যবহার করে অপরাধ করতে গিয়ে!
কয়েক বছর আগে ইত্যাদি'তে দেখেছিলাম এক ডাক্তারের চেম্বারে এক জোড়া মানুষ আসে এদের যুগপৎ বচন সমস্যা নিয়ে! চরম ফানি ব্যাপার ছিল। ঠিক এই ব্যাপারটার মতো দৃশ্য থাকলেও আসলে এটার মিনিং তা নয়। আয়নাবাজি এক প্রকার সম্মোহিতকরণ বলা চলে!! কিন্তু একই সাথে থ্রিলিং ও কমেডি শো হিসেবে সিনেমাটোগ্রাফি করা হয়েছে!!
☉ প্লটঃ
আয়না অভিনয় শেখায় বাচ্চাদের। গতানুগতিক একজন আয়না অনেকটা গোবেচারা ধাঁচের লোক। স্কুল শিক্ষকের মতই চলাফেরা। সে বাজার করে সেখান থেকেই যেখানে আমরা বাজার করি। যে জায়গাটায় বসে বসে আমরা আড্ডা দেই সেখানে সেও আড্ডা দেয়।
এককথায় চেনা শহরের অচেনা কারো গল্প! সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর আরেকটা পরিচয় আছে। সেটা হলো কুক(বাবুর্চি)! কিন্তু কোনও একজনের কাছে সে হয়ে ওঠে রহস্যময় একজন মানুষ! সে আয়নার অতীতে হাত ঢুকিয়ে উদ্ধার করে এক করুণ বৃত্তান্ত! তার মা ছিলেন যাত্রার অভিনেত্রী! মায়ের সাথে থেকে থেকেই সম্ভবত সে অভিনয় শেখে।
ক্রাইম রিপোর্টার সাবের! এক সাধারণ উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে নাবিলার ব্যাপারে খোঁজ করতে এসে কিছুটা সফল হয় সে। ক্লু নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে! একসময় সে জনগণ ও বিচারব্যবস্থার সাথে চরম রকমের প্রহসন আবিস্কার করে! কিন্তু কী সেই প্রহসন?? (সেটা জানতে হলে ছবিটা দেখতে হবে।)
(ভাত ছাড়া ৩ মাস দিনযাপনের পরে ১ম ভাত খাওয়ার সময়...)
☉ যাপিত জীবন
আমাদের চেনা জগতে অচেনা কিছু আছে। সাধারণ চোখে তা কমই ধরা পড়ে। আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে অভিনেতা! একদম জ্যান্ত অভিনয়। আয়নার ভাষায়- প্রতিটি রাজনৈতিক নেতাই এক একজন অভিনেতা। সেখানে হাজার হাজার মানুষ হচ্ছেন দর্শক, আর নেতারা অভিনেতা।
অভিনেতারা সবসময় মিথ্যা কথা বলেন। আমাদের যাপিত জীবনে এইরকম অভিনেতার সংখ্যা কী কম? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখতে পারেন। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে আইনের/নীতি নৈতিকতার ফাঁক দিয়ে দুর্নিতি নামক ক্যান্সার কিংবা অনৈতিক চরিত্র ধারণ করে আমরা ধ্বংসের অতলে ক্রমাগত নিয়ে যাচ্ছি সেটা সুনিপূণভাবে তুলে ধরেছেন নির্মাতা!
স্বার্থের জন্য কিংবা ভালবাসার জন্য মানুষের বিবেক/আবেগের প্রভাব কোথায় নিয়ে যেতে পারে আমাদের? বঞ্চিত মানুষদের জীবন নিয়েও চমকপ্রদ উপস্থাপন আছে এই চলচ্চিত্রে!!
☉ একজন অমিতাভ রেজা ও কিছু জল্পনাঃ
অমিতাভ রেজা! ছোটপর্দায় উনার সফলতা অনস্বীকার্য! আয়নাবাজি সিনেমা দিয়ে বড় পর্দায় অভিষেক করলেন গত ৩০'শে সেপ্টেম্বর(২০১৬)। সাহসের প্রশংসা করতেই হয়। পরিচালক হিসেবে অভিষেকে নায়িকারও অভিষেক! বড়পর্দায় তো বটেই, ছোটপর্দায়ও নাবিলা নামে কোন নায়িকা/সেলিব্রেটির কথা শোনা যায়নি।
জিরো ডিগ্রি নিয়ে যে পরিমাণ হৈ চৈ হয়েছিল সেটা আয়নাবাজিতেও হচ্ছে! স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠেছে- ০ ডিগ্রির মতো কি একই দশা হচ্ছে? এমন দুরুদুরু আশা নিয়ে আমরা ৪ জন ফুরফুরে মেজাজে ব্লকবাস্টারের ট্রানজিশন হলে গিয়ে পৌঁছুলাম শো'র ১৫ মিনিট আগে। ওমা!! কেউ নেই??
বিশেষ করে আমি তো সেই মাপের হতাশ!! এত বড় একটা ব্যাপার!! অথচ কেউ নেই? এই কয়েকজন?? যেখানে বেশি টাকা দিয়ে ঘুরপথে টিকিট কেটে কাল রাতেও ভেবেছিলাম লাড্ডু মেরে দিয়েছি!
হলের আশেপাশেও তেমন ভীড় দেখিনি। সে যাই হোক, বের হয়ে পপকর্ণ/ঠান্ডা কিনে এসে দেখি অবস্থা জম্পেশ! হুট করেই হলটা ভরে গেছে!
কোনও এক ইন্টারভিউয়ে নাবিলা বলেছিলেন ৩ ঘন্টা ভাল সময় কাটবে!! একদম মিথ্যে কথা না। আমরা সবাই সন্তুষ্টচিত্তেই ফিরে এসেছি। কাউকে এমন পাইনি যে কোনপ্রকার বিরক্তি প্রকাশ করেছে।
☉ অভিনয়ঃ
অমিতাভ রেজার দক্ষ হাতের কাজ! কিন্তু এর মাঝেও কথা আছে। ঠিক মনে নাই! তবে দু-এক জায়গায় কেমন যেন মেকি মেকি লাগছিল।
মিরাক্কেলের বিখ্যাত জামিলের হাবভাব খুব দারুণ লেগেছে!
[
কয়েক জায়গায় দেখেছিলাম পার্থ বরুয়াকে নিয়ে সংশয়ের কথা! কিন্তু আমি ওঁর অভিনয়ে ১০০ তে ৯৯.৯৯ দেব! এত ভাল অভিনয় হলিউডি ফিল্মেই কেবল দেখা সম্ভব!! সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার সাবের হোসেন! অ্যালকোহলিক!! ঘুনেধরা সমাজের মাঝে খাঁটি মনন পুষে রাখা একটা মানুষ! যার চেষ্টা থাকে একটা কিছু অন্তত করা! এই দেশ, এই সমাজ, এই মাতৃভুমির জন্য!! কিন্তু সে কি পারে?
আরেফিন শুভকে চমক হিসেবে আমিও পেয়েছিলাম। লোকটার অভিনয় দক্ষতা নিয়ে আমার ভাল অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু আয়নাবাজিতে কয়েক মিনিটের জন্য হলেও ভাল পারফর্ম করেছে।
☉ গানঃ
দয়াল বাবা'র গান অপ্রাসংগিক হলেও আমার মনে হয়েছিল সিনেমায় এই গানটা থাকতে পারে! তবে এটা নাট্যকুশলীদের ব্যাপার! দেয়া না হলেও লাগ-ভেলকি-লাগ গানটা চরম হয়েছে! এটা নিয়ে আইটেম সং বানানো উচিত ছিল।
বাকি গানগুলোও ভাল হয়েছে!! বিশেষ করে "পাপ জমাই" গানটা সিরামম!
এই লিংকে গেলে গানগুলো পাওয়া যাবে!
☉ রেটিংঃ ৯.৮/১০
☉ শ্রেষ্টাংশেঃ চঞ্চল চৌধূরী, পার্থ বড়ুয়া, নাবিলা।
☉ থিওরিটিক্যাল ট্রেইলারঃ
☉ খুটিনাটিঃ
এ ছাড়া রাশেদ জামানের সিনেমাটোগ্রাফি, ইকবাল কবির জুয়েলের সম্পাদনা এবং রিপন নাথের সাউন্ড রয়েছে। আমার মনে হয়েছে, এই তিনজন এ মুহূর্তে এ দেশের সেরা টেকনিক্যাল পারসন।'' এই চলচ্চিত্রে প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী ও উপস্থাপিকা মাসুমা রহমান নাবিলা। সিনেমার মূল কাহিনী ও ভাবনা গাউসুল আলম শাওনের। চিত্রনাট্য লিখেছেন অনম বিশ্বাস ও গাউসুল আলম শাওন। আয়নাবাজিতে আরও অভিনয় করছেন লুত্ফর রহমান জর্জ, শওকত ওসমান, গাউসুল আলম শাওন, এজাজ বারী প্রমুখ। কনটেন্ট ম্যাটার লিমিটেড প্রযোজিত এবং হাফ স্টপ ডাউন লিমিটেড নিবেদিত 'আয়নাবাজি'র নির্বাহী প্রযোজক এশা ইউসুফ। গানগুলো তৈরি করেছেন ফুয়াদ, অর্ণব, হাবিব ও চিরকুট ব্যান্ডের সদস্যরা।
☉ শেষকথাঃ
৬ ফুট নায়কের ধুম-ধারাক্কা অ্যাকশন কিংবা কৃত্রিম সুতোয় রোমান্টিক দৃশ্য তো আর কম দেখা হলো না। থার্ড পারসন সিংগুলার নাম্বার ওয়ান কিংবা মনপুরা টাইপ সিনেমা আমাদের কম হয়। আয়নাবাজি একটা মাস্টারপিস বলা চলে কারণ সাসপেন্স রয়েছে কমেডি শো এর আড়ালে আড়ালে!! ইনসেপশন মুভি'র কথা বারবার মনে হচ্ছিল হলে থাকাবস্থায়! তবে একদম ভিন্ন প্লটে এইসকল দৃশ্যপটের পরিবর্তন!
মোটের ওপর অমিতাভ রেজা তার প্রথম চলচ্চিত্রেই বাজিমাত করে ফেলেছেন মনে হলো। হলের দর্শকরা প্রদর্শনের পুরোটা সময় জুড়ে উপভোগ করেছেন এবং ভাল মানের করতালির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন তাদের পয়সা মার যায়নি মোটেও! মোটামুটি কয়েকদিনের মধ্যেই দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখে সিনেমাটির বাণিজ্যিক সফলতা বোঝা যাবে। আমাদের দর্শকরা হারিয়ে গেছে! এই ধরনের ক্রিয়েটিভ ছবি হতে থাকলে বাংলা সিনেমার সুদিন আসতে বেশি দেরি নেই। কারণ কপি-পেস্টের বাইরের ক্রিয়েটিভিটি খোদ বলিউডেই অনেক কম। আমাদের তরুণ নির্মাতাদের একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে অনেকটাই! কে কতটা ভিন্নধারার সৃজনশীলতার প্রয়োগ করতে পারেন! এটা খুব ভাল লক্ষণ! বাংলা সিনেমার তথৈবচৈ অবস্থার উত্তরণের পথ খুলে গেছে! এখন হাঁটতে হবে সেই পথে। কলাকুশলীরা সেদিকে পা দিয়েছেন। আমরা দর্শকরা পা দিলেই হলো এবার!!
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৬ ভোর ৫:২৫